Advertisement
E-Paper

একতরফা নহে

সে কালে ভারতীয় জীবনের প্রথম আশ্রম, অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য পালনের সময় গুরু–শিষ্য সম্পর্ক শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় আবদ্ধ ছিল না। বরং তাহা পারিবারিক বন্ধনে উপনীত হইত।

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০১৭ ০০:২৪

শিশুদের ‘সিলেবাস’ নামক দিস্তা দিস্তা কাগজ গিলাইবার পদ্ধতিটির যে কোনও সারবত্তা নাই, তাহা রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন। কিন্তু পাঠ্যক্রম-নির্মাণকারীরা বুঝেন নাই। তাই বইয়ের বোঝা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে এবং তিন না পুরিতেই শিশুদের এক-একটি তোতা বানাইবার প্রক্রিয়াতেও সম্পূর্ণ ছেদ পড়ে নাই, মনস্তত্ত্ববিদ এবং শিক্ষাবিদদের নিরন্তর সাবধানবাণী সত্ত্বেও। তবে, শিক্ষা বিতরণের ভার যাঁহাদের উপর, সেই শিক্ষকদের আচরণ পড়ুয়াদের প্রতি কেমন হইবে, তাহা লইয়া কিছু ভাবনা এবং উদ্যোগ সম্প্রতি এই শহরেই দেখা গেল। এক নামী স্কুলের উদ্যোগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লইয়া একটি কর্মশালার আয়োজন করা হইয়াছিল। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে আরও সুন্দর করিবার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হইয়াছে সেখানে। আলোচনায় উঠিয়া আসিয়াছে, শিক্ষককে শিক্ষার্থীর বন্ধু হইতে হইবে। ক্লাসরুম শিক্ষকের পাণ্ডিত্য দেখাইবার ক্ষেত্র নহে, বরং বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়াই পড়ুয়াদের জানিবার আগ্রহকে বৃদ্ধি করিবে।

যথার্থ ভাবনা। যাথার্থ্যের একটি সূত্র প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাপদ্ধতিতে খুঁজিলে পাওয়া যাইবে। সে কালে ভারতীয় জীবনের প্রথম আশ্রম, অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য পালনের সময় গুরু–শিষ্য সম্পর্ক শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় আবদ্ধ ছিল না। বরং তাহা পারিবারিক বন্ধনে উপনীত হইত। গুরুগৃহে শিক্ষার সঙ্গে সাংসারিক অনেক দায়িত্বও শিষ্যকে পালন করিতে হইত, ‘সিলেবাস’-বহির্ভূত বিষয় হিসাবেই। বিপরীতে, শিষ্য অসুস্থ হইলে গুরুমশাই-ই তাহার সেবার ভার লইতেন। ইহাই প্রকৃত গুরু-শিক্ষক সম্পর্ক। ইহাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষার এহেন সর্বাঙ্গীণ রূপটির আয়োজন আধুনিক শিক্ষালয়ের নির্দিষ্ট কয়েক ঘণ্টায় করা যায় নাই, সংগত কারণে। কিন্তু গুরুকুলের একমাত্র চিহ্ন হিসাবে গুরুমশাইয়ের গাম্ভীর্যটুকু রহিয়া গিয়াছে শিক্ষকের ভাবে। সেই ক্ষেত্রে বিরাট কোনও যুগ-পরিবর্তন ঘটে নাই। অনেকেই মনে করেন, তিনি শিক্ষক, তিনিই সর্বজ্ঞ। নির্দিষ্ট সময়ে বেতনের বিনিময়ে পড়ুয়াদের তিনি তাঁহার অপরিসীম জ্ঞানভাণ্ডার হইতে যৎসামান্য দান করিয়া ধন্য করিয়া দেন। এই ভাবনার বিপরীতে যাঁহারা, অর্থাৎ ক্লাসরুমকে নিছক জ্ঞানবিতরণ কক্ষ ভাবিতে যাঁহারা রাজি নহেন, শিক্ষকসমাজে তাঁহারা প্রায়শই বিদ্রুপের শিকার হন। কারণ, রক্ষণশীল চক্ষে তাঁহাদের আচরণ যথেষ্ট ‘শিক্ষকোচিত’ নহে।

এই প্রাগৈতিহাসিক ভাবধারার দ্রুত অপসারণ প্রয়োজন। বৃহত্তর শিক্ষার স্বার্থেই। শিক্ষক সর্বজ্ঞ হইতেই পারেন। কিন্তু তাহাতে শিক্ষার্থীর লাভ নাই, যতক্ষণ না সে সেই জ্ঞানভাণ্ডার হইতে নিজ আনন্দে কিছুটা আহরণ করিতে পারিতেছে, এবং বিনিময়ে তাহার নিজস্ব জগতের, কল্পনার কিছু ভাগ শিক্ষককে দিতে পারিতেছে। কারণ, ক্লাসরুম শুধুই জ্ঞান উপুড় করিবার জায়গা নহে। প্রতি মুহূর্তে কিছু শিখিবারও জায়গা, ছাত্রেরও, শিক্ষকেরও। সাম্প্রতিক কর্মশালার বক্তব্যও ইহাই। সেই জন্যই বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ। তবে, বন্ধুত্ব এবং ভয়ের মধ্যে সুন্দর এক ভারসাম্যেরও প্রয়োজন, যে কথাটি শোনা গিয়াছে এক প্রবীণ শিক্ষক তথা শিক্ষাবিদের মুখেও। প্রাচীন কালের গুরুগৃহের শৃঙ্খলা এবং আধুনিক কালের ছাত্র-শিক্ষক জড়তাহীন সহজ সম্পর্কই একমাত্র শিক্ষালাভকে সার্থক করিয়া তুলিতে পারে।

Classroom Teachers Children
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy