গরিবের মসিহা? আইআইটি দিল্লির অনুষ্ঠানে মার্ক জুকেরবার্গ। ছবি: পিটিআই।
শেষ পর্যন্ত মার্ক জুকেরবার্গও! অ্যালেন গিনসবার্গ, জর্জ হ্যারিসন থেকে স্টিভ জোবস হয়ে এ বার ফেসবুকের অধীশ্বরের মুখেও ভারতীয় আধ্যাত্মিকতার প্রশস্তি শোনা গেল। জানালেন, তাঁদের সংস্থার ইতিহাসে ভারতের গুরুত্ব প্রভূত। ‘হাউল’ থেকে বিটল্স-এর গান, অথবা ম্যাকবুক এয়ার থেকে অধুনা দেড়শো কোটি নেটিজেনের ‘ফেসবুকিস্তান’, ভারত দেখছি অনেক কিছুতেই অতি ন্যায্য ভাবে নিজের কৃতিত্ব দাবি করতে পারে!
তবে, জুকেরবার্গের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের গভীরতা শুধু অতীতেই আটকে নেই। সিলিকন ভ্যালিতে নরেন্দ্র মোদীর সফরের পর জুকেরবার্গ ভারতে এলেন, দিল্লি আইআইটি-র ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দিব্য সময় কাটালেন। কেন, অনুমান করতে পারলেও কোনও বাড়তি নম্বর নেই। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ভারতে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তেরো কোটি। ২০১৯ সালে তা দাঁড়াবে প্রায় সাতাশ কোটিতে। চার বছরে দ্বিগুণ। হিসেব বলছে, ভারতই ফেসবুকের বৃহত্তম বাজার হবে। ফেসবুকেরই অ্যাপ ‘হোয়াটস্যাপ’ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতীয়রা গোটা দুনিয়ায় এক নম্বর। ইতিহাস-টিতিহাস বাদ দিলেও, শুধু বাজারের আয়তনেই জুকেরবার্গের কাছে ভারত গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, নিজের সংস্থার সবচেয়ে বেশি গ্রাহকসংখ্যার বাজারে খানিক সময় কাটানোর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণেই জুকেরবার্গ ভারতসফরে এসেছেন। এখনও দুনিয়ার প্রায় সাড়ে চারশো কোটি মানুষের পক্ষে ফেসবুকের খদ্দের হওয়া অসম্ভব, কারণ তাঁদের কাছে আজও ইন্টারনেট পৌঁছোয়নি। এই মানুষগুলোর একটা বড় অংশের ঠিকানাও ভারত। তাঁদের জন্য জুকেরবার্গের ঝুলিতে রয়েছে ফ্রি বেসিকস— আগে যার নাম ছিল ইন্টারনেট ডট অর্গ। এখনও অবধি যাঁরা ইন্টারনেট পরিষেবার বাইরে, তাঁদের নিখরচায় প্রাথমিক নেট পরিষেবা দেওয়াই এর লক্ষ্য। গত এক বছর ধরে দুনিয়াময় ফ্রি বেসিকস ফিরি করে বেড়াচ্ছেন জুকেরবার্গ। ইতিমধ্যেই ১৯টি দেশের একশো কোটিরও বেশি মানুষ এই পরিষেবার আওতায় এসেছেন। জুকেরবার্গের ভারত সফরের পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল এই প্রকল্পের সমর্থনে জনমত তৈরি করা।
অস্বীকার করার উপায় নেই, সে দিকটা একটু ঘেঁটে আছে। বেচারা জুকেরবার্গ! হয়তো ভেবেছিলেন, গোটা দুনিয়া তাঁকে মাথায় তুলে রাখবে। তা নয়, অভিযোগের অন্ত নেই। যাঁরা নেট নিউট্রালিটির পক্ষে, তাঁরা তুলোধোনা করছেন। তাঁদের পক্ষে যুক্তি আছে। ফ্রি বেসিকস-এ সব ওয়েবসাইট দেখতে পাওয়ার প্রশ্নই নেই। ফেসবুক, উইকিপিডিয়ার মতো কিছু সাইটের ‘হালকা সংস্করণ’ এবং আর কিছু ওয়েবসাইট দেখা যাবে মোবাইল ফোনে। যত বেশি লোকের কাছে এই নিখরচার ইন্টারনেট পৌঁছোবে, ফেসবুকেরও ততই লাভ। আফ্রিকায় ইন্টারনেট ডট অর্গ চালু হওয়ার পর এ বছরই এক সমীক্ষায় দেখা গেল, ৫৮ শতাংশ লোক ইন্টারনেট বলতে শুধু ফেসবুকই বোঝেন!
জুকেরবার্গকে যত অভিযোগের মুখে পড়তে হচ্ছে, সেগুলোকে মোটামুটি চারটে গোত্রে ভাগ করে নেওয়া যায়। এক, তিনি ডিজিটাল জাতপাতের পথ তৈরি করছেন। যাঁরা ‘উচ্চবর্ণ’, তাঁদের জন্য ইন্টারনেটের দুনিয়ার সব দরজা খোলা, আর ‘নিম্নবর্ণের’ লোকেদের জন্য হাতে গোনা কয়েকটা ওয়েবসাইট— যেন দেওয়াল ঘেরা বস্তিতে জীবন কাটাতে বাধ্য তাঁরা।
দ্বিতীয় আপত্তি হল, গরিবকে নিখরচায় ইন্টারনেট দেওয়া মোটেই পরার্থপরতা নয়, এর পিছনে কূট উদ্দেশ্য রয়েছে। এটা আসলে ইন্টারনেটের দুনিয়া দখল করে নেওয়ার চাল। সেটা সম্ভব হলে ভবিষ্যতের হাজারো উদ্ভাবনের সম্ভাবনা হয়তো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবে।
তৃতীয় আপত্তি, এই প্রকল্পে ফেসবুকের গায়ে মোটেই কোনও আর্থিক আঁচ লাগছে না, ওটা মোবাইল পরিষেবা সংস্থার ওপর দিয়ে যাবে।
চার, সবার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবার ব্যবস্থা করতে ইতিমধ্যেই সরকারি স্তরে পরিকল্পনা হচ্ছে।
যুক্তি বলছে, জুকেরবার্গের সমালোচকরা ভুল। প্রথম আপত্তিটাই ধরুন। আসল ডিজিটাল জাতপাতপ্রথা কী জানেন? যে ব্যবস্থায় ইন্টারনেট ৮০ শতাংশ মানুষেরই নাগালের বাইরে থেকে যায় আর ২০ শতাংশ মানুষ সবটুকু পায়। আগে সবাই খানিক হলেও ইন্টারনেট পরিষেবার নাগাল পান, তার পর না হয় নেট নিরপেক্ষতার কথা ভাবা যাবে। ফ্রি বেসিকস-এর মাধ্যমে গরিব মানুষের কাছে যেটুকু ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছোবে, একেবারে কিছু না পাওয়ার চেয়ে সেটা ঢের ভাল। আমাদের দেশে এখনও ৮০ শতাংশ মানুষ নেট পরিষেবার বাইরে। বাকি কুড়ি শতাংশের জন্য নেট নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে গিয়ে এই ৮০ শতাংশকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হলে সেটা মারাত্মক রকম ভুল হবে।
দ্বিতীয় আপত্তিটিও জোলো। যদি কর্পোরেট লাভের পথেই উন্নয়ন ক্রমে সর্বজনীন হয়, অভিজ্ঞতা বলছে, সেই পথটা কর্পোরেট সদিচ্ছা বা সামাজিক দায়িত্বশীলতার ওপর নির্ভর করার চেয়ে ভাল। কারণ, মনে রাখা প্রয়োজন, কোনও কারণে খরচ ছাঁটতে হলে প্রথম কোপ কিন্তু পড়ে দানছত্রের ওপরই। এই কর্পোরেট দানের পিছনে যদি কোনও সরকারি বাধ্যবাধকতা না থাকে, তবে তা হাওয়ায় উবে যেতে খুব বেশি সময় লাগে না।
উল্টো দিকে, ভারতের ই-বাণিজ্যের বাজার এখন এক বিচিত্র অবস্থায় রয়েছে। জনসংখ্যা প্রচুর, কিন্তু বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারত এখনও দুনিয়ার সেরা দশটা দেশের তুলনায় ঢের পিছিয়ে। আরও বেশি মানুষের কাছে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছোলে স্বভাবতই বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রচুর। কাজেই, ফেসবুকের মতো সংস্থাগুলি ভারতে আগ্রহী। ব্যবসার মডেল পরিষ্কার— যত বেশি লোকের হাতে ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছোবে, ভবিষ্যতে ই-বাণিজ্যের ক্রেতার সংখ্যা ততই বাড়ার সম্ভাবনা। মনে রাখতে হবে, শুধু ফেসবুক নয়, ২০১১ সাল থেকেই ভারতের ই-বাণিজ্যে বিদেশি লগ্নির পরিমাণ বিপুল ভাবে বেড়েছে। বাজারের স্বার্থেই যদি ইন্টারনেট পরিষেবা গরিব মানুষের নাগালে আসে, তাতে ক্ষতি নেই, বরং লাভ।
যাঁরা ফ্রি বেসিকস-এর মাধ্যমে ইন্টারনেটের নাগাল পাবেন, ফেসবুকই কি তাঁদের ই-দুনিয়া গিলে নেবে? গোড়ায় যে ফেসবুকই আধিপত্য করবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু, ফ্রি বেসিকস-এর সীমিত পরিসরেও অনেকেই ইন্টারনেট দুনিয়ার আসল স্বাদ পাবেন, এবং তাঁরা নিজেদের তাগিদেই ফেসবুকের গণ্ডি ছাড়িয়ে বেরিয়ে পড়বেন বৃহত্তর পরিসরে। আয় বাড়লে তাঁদের মধ্যে অনেকেই হয়তো পুরো পরিষেবা কিনবেন। অভিজ্ঞতা বলছে, গোড়ার সামান্য সুযোগটুকু ব্যবহার করেও অনেকে নেট দুনিয়া থেকে অসম্ভব কার্যকর সব দক্ষতা অর্জন করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
ভারতে বিনিয়োগ করে জুকেরবার্গ কি ঝুঁকি নিচ্ছেন না? অবশ্যই নিচ্ছেন। জনসংখ্যার নিরিখে ভারতের বাজারের আয়তন বড় হতে পারে, কিন্তু আর্থিক হিসেবে এই বাজার এখনও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। প্রশ্ন হল, ভারতে ফ্রি বেসিকস-কে ফেসবুক কী চোখে দেখবে? তাকে কি সত্যিই অর্থবহ করে তোলার চেষ্টা হবে, নাকি গ্রাহককে ইন্টারনেট প্ল্যান কিনতে উদ্বু্দ্ধ করাই তার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে? উত্তর পাওয়ার জন্য আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। ভারতে বিনিয়োগকে ফেসবুক একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত থেকে দেখবে বলেই আমার অনুমান।
শেষে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, সবার নাগালে ইন্টারনেট নিয়ে আসার জন্য প্রত্যেক গ্রামে অন্তত একটা কমন সার্ভিস সেন্টার তৈরি করার প্রস্তাব প্রথম অনুমোদিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। ন’বছর কেটে গিয়েছে, এখনও কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। সরকারি উদ্যোগ এই গতিতেই চলে। নরেন্দ্র মোদীর ডিজিটাল ইন্ডিয়া মস্ত বড় পরিকল্পনা, কাজেই তার গতিও যে শামুকের তুলনায় খুব বেশি হবে না, আঁচ করা চলে। সবার মোবাইলে ইন্টারনেট পৌঁছে দিতে হলে আগে স্পেকট্রাম বাড়ানোর ব্যবস্থা করুক সরকার।
গত কয়েক মাসে ইন্টারনেটে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব করার পথে কেন্দ্রীয় সরকার বেশ কয়েক বার হেঁটেছে। আশার কথা, দেশ জুড়ে তুমুল প্রতিবাদের ধাক্কায় সরকার প্রত্যেকের ফোনে অন্তত নব্বই দিন সব মেসেজ জমিয়ে রাখার আইন তৈরির প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিসরে রাষ্ট্রীয় খবরদারির প্রবণতাটি স্পষ্ট। অতএব, সরকারের হাত ধরে ইন্টারনেট সর্বজনীন হবে, সে বিষয়ে খুব আশাবাদী হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।
ফ্রি বেসিকস-এর মাধ্যমে জুকেরবার্গ যে চেষ্টা করছেন, তাতে কিছু ‘লাইক’ তাঁর প্রাপ্য। আমি অবশ্য দিতে পারব না, কারণ আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্টই নেই!
টাফ্টস ইউনিভার্সিটি-র ফ্লেচার স্কুলে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস অ্যান্ড ফিন্যান্স-এর সিনিয়র অ্যাসোসিয়েট ডিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy