Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
গৌরী লঙ্কেশ: জন্ম, যা মৃত্যুর অতীত

এই আঁধারে কে জাগে

কন্নড় ভাষা পড়তে পারত না বেচারি একেবারেই। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সম্পাদিত কাগজটি সম্পাদনা করতে করতে মাতৃভাষা কন্নড় ঢুকে যায় রক্তে। জেদি মেয়ে পনেরো বছর কাগজটি চালিয়েছে বহু প্রতিকূলতার মধ্যে, বিজ্ঞাপন ছাড়াই।

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:২৩
Share: Save:

জানুয়ারির ২৯ তারিখ সকালে মেয়েটির জন্ম। মায়ের মনে হয়েছিল, এত সুন্দর শিশু তিনি কখনও দেখেননি। মেয়েটি যখন বেশ ছোট, তখন এক বার বাবা-মায়ের উৎকণ্ঠিত সময় কাটে হাসপাতালে। দুরারোগ্য মস্তিষ্ক-জ্বরে আক্রান্ত মেয়ে চেতনা ফিরে পাবে কি না, অন্ধ হয়ে যাবে কি না চিরকালের মতো, সেই দুশ্চিন্তায় কেটেছে তখন রাতদিন। সুস্থ হয়ে ওঠে সেই মেয়ে। কন্নড় ভাষা পড়তে পারত না বেচারি একেবারেই। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সম্পাদিত কাগজটি সম্পাদনা করতে করতে মাতৃভাষা কন্নড় ঢুকে যায় রক্তে। জেদি মেয়ে পনেরো বছর কাগজটি চালিয়েছে বহু প্রতিকূলতার মধ্যে, বিজ্ঞাপন ছাড়াই।

ইংরেজি সাংবাদিকতায় দেড় দশক বিস্তৃত জমকালো কেরিয়ার ফেলে রেখে নিজের রাজ্যের, নিজের ভাষার দৈনন্দিন ধূলি-রোদে কেটেছে তার ব্যস্ত জীবন। কেবল কর্নাটক নয়, সারা ভারতের ঘটনা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, সংখ্যালঘু-দলিত বিরোধী আক্রমণ, তার ছোট কাগজের সম্পাদকীয় প্রবন্ধের জানালা-পথে ঢুকে আসতে থাকে। সে হয়ে ওঠে বিপন্ন মানুষের আশ্বাসের ভাষা। সে তার মতো মানসিকতার মানুষজনের সঙ্গে অনায়াসে গড়ে তোলে বন্ধুত্ব। বয়স কোনও বাধাই ছিল না এই বন্ধুত্বে। ইউ আর অনন্তমূর্তি, বি ভি করন্থ, কে পি পূর্ণচন্দ্র তেজস্বীর মতো বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী লেখক-নাট্যকারদের সঙ্গে তার সহজ, স্নেহময় বন্ধুত্ব। পিতা পি লঙ্কেশের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে যিনি দূরে সরে গেছেন সেই তেজস্বীকে আদরে আবদারে বিরক্ত করে লেখা আদায় করত এই মেয়ে। আবার রূপান্তরকামী রেবতীর জীবনকাহিনি তামিল থেকে অনুবাদ করিয়ে ছাপতেও ছিল তার সমান আগ্রহ।

গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার পক্ষে বহুমাত্রিক স্বর সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। কিন্তু ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ যখন খবর পেলাম অজ্ঞাত আততায়ীরা নিজেরই বাড়ির দরজার কাছে নিরস্ত্র গৌরীকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে, তখন স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করেছিলাম। একই সঙ্গে শোক ও ক্রোধে অসহায় বোধ করছিলাম।

কিন্তু দেখলাম, নিধনেই সব কিছু শেষ হয়নি। এই হত্যার পর সোশ্যাল মিডিয়াতে যে ন্যক্কারজনক পরিহাস ও মন্তব্য ফুটে উঠছিল, তাতে মনে হচ্ছিল এই কণ্ঠস্বরগুলি যাঁরা স্তব্ধ করে দিতে পারেন এক লহমার নিষেধে, তাঁরা সব কোথায়? ন্যায়ের শাসন বলবৎ রাখার জন্য সংবিধানের শপথ নিয়ে যাঁরা ক্ষমতায় নির্বাচিত হন, তাঁদের স্তব্ধতা কি তা হলে কোনও সংকেত দেয়? গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যু কি তবে এক প্রতিবাদের পরম্পরাকে নিশ্চিহ্ন করে দিল?

আজ বুঝি, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারের মতো যুক্তিবাদীদের হত্যার পর গৌরী লঙ্কেশের হত্যা কেবল আরও একটি লাল কালির ফোঁটা নয়। যে অসহিষ্ণুতা সমস্ত মতানৈক্যকে দেশ-বিরোধী আখ্যা দিয়ে মুছে ফেলতে চায়, এ হত্যা তাদেরই বিপন্ন চিৎকার। এ-ও অনুভব করি, গৌরীর মৃত্যু নয়, তাঁর জীবন ও তাঁর কাজই স্বাধীনতা ও শান্তিকামীদের আশা হয়ে উঠবে।

বন্ধু ও অধ্যাপক চন্দন গৌড়া, গৌরী লঙ্কেশের লেখা নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ, সাক্ষাৎকার ও সম্পাদকীয় থেকে নির্বাচন করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। কিছু লেখা অবশ্য মূল ইংরেজিতেই। তাঁর প্রথম দিকের ইংরেজি সাংবাদিকতার ফসল। এতে গৌরীকে নিয়ে তাঁর বন্ধু ও প্রিয়জনদের লেখাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

লেখাগুলি পড়লে মানুষটি আর তাঁর জীবনবোধ চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কন্নড় মানুষের সহিষ্ণুতা, রাজনীতিনিরপেক্ষ ভাবে যুক্তি ও বুদ্ধিকে সম্মান জানানোর স্পৃহা, পিতা পি লঙ্কেশের আদর্শ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে অথচ ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’র মতো একটি সংবাদপত্র আদৌ চালাতে পারবেন কি না সে বিষয়ে নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাবকে কখনও লুকোতে চাননি। আবেগ, স্নেহ আর সাহসে মণ্ডিত এক জন চিরচেনা অথচ অসাধারণ মানুষ তিনি। অসাধারণ, কারণ যে কোনও অত্যাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্রান্তিক মানুষের অধিকার হরণের ঘটনায় তাঁর হৃদয়তন্ত্রী বেজে ওঠে। রোহিত ভেমুলার অকারণ মৃত্যু তাঁকে ক্রুদ্ধ, মথিত করে; ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী রমণী দয়ামণি বারলার যে লড়াই কোনও জাতীয় সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পায়নি, তাকে সম্মান করে বিশদ নিবন্ধ লেখেন। উত্তর-কর্নাটকের সাভানুরের দলিত ঝাড়ুদার-জমাদারদের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর অভিনব প্রতিবাদও গৌরীর নজর এড়ায় না।

স্বাধীনচিত্ত স্বাবলম্বী নারীর পদসঞ্চার যখন মুখোমুখি হয় পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রবাদী মনোলিথ-এর, তখন আরম্ভ হয় সোশ্যাল মিডিয়ার ঢালের পিছন থেকে তাঁকে ভয় দেখানোর, নিন্দা করার, দেশদ্রোহী চিহ্নিত করার চেষ্টা। গৌরীর ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। কিন্তু এই অপচেষ্টা যে পৃথিবী থেকে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার স্পর্ধা দেখাবে, তা হয়তো তিনি নিজেও ভাবেননি।

গৌরী লঙ্কেশের গভীর আস্থা ছিল গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার, দেশের ও মানুষের প্রতি। সেই জন্য ২০০০ সালে, ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’ সম্পাদনার দায়িত্ব নেওয়ার দু’মাসের মাথায় একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন, ‘নারী হওয়াই আমার সুরক্ষা এই মুহূর্তে। এক জন রাজনীতিক যত সহজে এক জন পুরুষকে ঘৃণ্য ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন, নারী সম্পাদকের সঙ্গে তেমন আচরণ করলে জনমানসে শ্রদ্ধা হারাবেন।’ তিনি জানান, শারীরিক আক্রমণের ভয় তিনি করেন না। তাঁর বিরুদ্ধে হুমকির ঘটনাও কমে এসেছে। অন্যত্র তিনি লিখছেন, তাঁর কাগজের দর্শন ও মূল্যবোধকে সমর্থন করেন বলেই বহু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করে কেস দায়ের করেননি।

পরিস্থিতি বদলাচ্ছে, গৌরী জানতেন। অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, জাত, ধর্ম এনে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার অভিযান আগ্রাসী হয়ে উঠেছে গত কয়েক বছরে, দেশের সর্বত্র। কিন্তু নিজের কাজ, সম্পাদনার সামাজিক দায়িত্ব তাঁকে এতটাই ব্যস্ত রাখত, যে নিজের সুরক্ষার কথা ভাবার মতো সময় তাঁর ছিল না। ‘ব্যাঙ্গালোর মিরর’ কাগজে লেখা একটি প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘দ্বাদশ শতাব্দীতে বাসবান্না থেকে ২০১৫-তে কালবুর্গির হত্যা পর্যন্ত একই হিংসার প্রবাহ চলেছে, অথচ শ্রেণিবিহীন লিঙ্গায়েত সমাজ গড়ার জন্য বাসবান্না নিজের জীবন দিয়েছিলেন।’ নিবন্ধের শেষে গৌরী লিখেছিলেন, ‘আইডিয়াজ, হাওএভার, নেভার ডাই।’ উমর খালিদ তাঁদের ‘মাদার কারেজ’ গৌরীর বিষয়ে লিখেছেন, যখন ওঁদের সুরক্ষা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন, নিজেকে নিয়ে কোনও চিন্তাই মনে আসত না তাঁর।

এই সংকলনে বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত কে ফণিরাজের ‘আক্কাজ মেটামরফোসিস’ লেখাটি বিশেষ মূল্যবান। বর্তমান সহস্রাব্দের গোড়া থেকেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির আক্রমণের মুখে পড়ে ‘লঙ্কেশ পত্রিকে’ এবং তার নবীন সম্পাদক। বাবাবুদানগিরির মন্দির ঘিরে হিন্দুত্ববাদীদের উদ্যমের বিরুদ্ধে কেকেএসভি অর্থাৎ কর্নাটক কমু সৌহার্দ্য ভেদিকে-র মতো একটি মঞ্চ গড়ে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে একজোট করার সাহস দেখিয়েছিলেন গৌরী। সাংবাদিক থেকে অ্যাকটিভিস্ট সাংবাদিক হয়ে ওঠেন কেবল নিজের সাহস ও বিশ্বাসযোগ্যতায়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস করতেন গৌরী। তবু নকশাল আন্দোলনের মূল প্রশ্নগুলি তাঁকে ভাবাত। অতি-বামেদের মূলস্রোতে ফেরাবার উদ্যোগে ‘সিটিজেন’স ইনিশিয়েটিভ ফর পিস’ নামক যে মঞ্চটি তিনি শক্তিশালী করে তুলছিলেন, তাতে নিহিত ছিল বিপুল সাহস ও ঝুঁকি। এমনিতেই হিন্দুত্ববাদীরা যে-কোনও বিরোধীকে নকশালবাদী চিহ্নিত করে দিয়ে থাকে। ‘তাঁর জীবন অকালে নিভে যাওয়ার আগের মাসগুলিতে গৌরী হয়ে উঠেছিলেন সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তিবাদী, স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের হৃদয়প্রতিমা, কর্নাটক থেকে দিল্লি পর্যন্ত’, লিখেছেন ফণিরাজ। তাই কি অস্থির হয়ে উঠেছিল এই সকল মূল্যবোধের বিপরীতে যারা, তাদের পাইক বরকন্দাজ বর্গ?

গৌরীর মৃত্যু আজ অতীত। কিন্তু সামনে আদিগন্ত বিছিয়ে আছে তাঁর স্বপ্নের দেশ ও সমাজ। আগামী কাল গৌরীর জন্মদিন। এই দিনটি তাঁর জীবনের অভিব্যক্তিসমূহকে আমাদের সামনে উজ্জ্বলতর করে তুলুক। অম্লান হোক তাঁর সাহসী, স্নেহমাখা মুখের ছবি। ভাবধারা অনশ্বর।

সূত্র: দ্য ওয়ে আই সি ইট: আ গৌরী লঙ্কেশ রিডার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE