রায়বেঁশে। ছবি: লেখক
মাথায় লম্বা ঝাঁকড়া চুল, দুই হাতে দু’টি গরুর গাড়ির চাকা, জলভর্তি ঘড়া দাঁতে ধরে লম্বা বাঁশ বেয়ে তরতরিয়ে ওঠা, ঘরের চালে উঠে ডিগবাজি খেতে খেতে নীচে নেমে আসার মতো নানা কলাকৌশল জড়িয়ে রয়েছে এই ধারাটির সঙ্গে। এই ধারাটির নাম রায়বেঁশে। আজ নয়, বহু প্রাচীন কাল থেকেই রায়বেঁশে ধারাটি প্রবেশ করেছে রাঢ় বাংলার লোকসংস্কৃতির আঙিনায়। সেই ধারারই বর্তমান উত্তরসাধকদের একাংশের বসবাস কাটোয়া মহকুমার কোশিগ্রামে।
রায়বেঁশে ধারাটির উদ্ভবের মূলে ঠিক কোন প্রেক্ষাপট জড়িয়ে রয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে গিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষকেরা দাবি করেন, এই ধারার উদ্ভবের মূলে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা ও আত্মরক্ষার কৌশল। মুঘল আমলে লেখা বেশ কয়েকটি গ্রন্থে এই রায়বেঁশে সম্প্রদায়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। গবেষকদের একাংশ দাবি করেন, বাইরে থেকে আসা পর্তুগিজ-সহ অন্য বিদেশি বণিকদের এ দেশে প্রবেশের পরে এই সময়ে বাংলার মেয়েদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়। তাঁদের নিরাপত্তার জন্য প্রতিরোধবাহিনী গড়ে তোলেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পুরুষেরা। অস্ত্র হিসেবে তাঁরা ব্যবহার করতেন ‘রায়’ অর্থাৎ উৎকৃষ্ট মানের বাঁশের লাঠি।
অনুমান করা হয়, সেই সময়ে পুরুষেরা দলবদ্ধ হয়ে জলদস্যুদের মোকাবিলা করতেন। কথিত রয়েছে, মগদের ফাঁদে ফেলার জন্য অনেক পুরুষ ‘রাই’ অর্থাৎ রাধা সেজে স্নানের ঘাটে অপেক্ষা করতেন। বাকি দলের লাঠিয়ালেরা লুকিয়ে থাকতেন। জলদস্যুরা মহিলাদের ধরতে এলে ছদ্মবেশী মহিলারা বিকট আওয়াজ ও মুখে নানারকম শব্দ করতেন। হতচকিত হয়ে পড়তেই চারিপাশ থেকে লাঠিয়ালরা এসে জলদস্যুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কোনও কোনও গবেষক অনুমান করেন, এই বাঁশ লাঠি সম্বলিত পুরুষদের দল ছিল মূলত ডোম সম্প্রদায়ভুক্ত। অনেকে অনুমান করেন, পরে তাঁদের বীরত্বে ও বুদ্ধিমত্তায় মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় ভূস্বামীরা তাঁদের প্রতিরক্ষার কাজে নিযুক্ত করেন। কথিত রয়েছে, এই লাঠিয়ালবাহিনীর বিশেষ কৌশল ও অনুশীলনই রায়বেঁশে শিল্পের মূলে রয়েছে। রাঢ় বাংলার বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মেদিনীপুর ও দুই বর্ধমানের কিছু অংশে এই নৃত্যধারা চর্চাকারী মানুষজন ছড়িয়ে রয়েছেন।
শঙ্করলাল মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতীয় নৃত্য ধারায় ইতিহাস’ বইয়ে জানিয়েছেন, রাজকীয় সম্মানীয় ব্যক্তিদের বলা হত ‘রায়’ আর শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর আচরণীয় কৌশলকে বলা হত ‘বিশ’। এই ‘বিশ’ শব্দ থেকে ‘বেশে’ শব্দের উৎপত্তি। অনেক গবেষকের মতে ‘রায়’ একপ্রকার উৎকৃষ্ট বাঁশ যা থেকে উত্তম লাঠি তৈরি করা যায়। ‘বেশে’ মানে সাজ।
কাটোয়া মহকুমায় অজয় নদের তীরে অবস্থিত কোশিগ্রামের (পূর্ব নাম ঢেককুরী) স্থানীয় সামন্ত রাজা দোপ বর্ধনের সময় থেকে ডোম সম্প্রদায়ের মানুষজনের বসবাস। এঁরা বিভিন্ন জায়গায় নিরাপত্তার কাজে যুক্ত ছিলেন। কথিত রয়েছে, ব্রিটিশ শাসনকালে জমিদারি প্রথা চালু হলে ঘন জঙ্গল দিয়ে পালকির যাতায়াতের সময়ে এরা লাঠিয়াল হিসেবে যেতেন। জমিদার ও বিত্তশালী পরিবারের বিবাহ শোভাযাত্রার সামনে পিছনে এই লাঠিয়াল শিল্পীরা ছদ্মবেশে থাকতেন। এই ডোম সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষ কালীকিঙ্কর পণ্ডিতের মুখে এমন নানা রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনা যেত। সেই কাহিনির থেকে অন্তত একটি জিনিস বোঝা যায়, বিবাহ অনুষ্ঠানে লাঠি খেলার প্রদর্শনী-সহ নানা কসরত করতে হত তাঁদের। অন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠানেও খোলা মাঠে নাটমন্দিরের সামনে, খামারবাড়িতে, চাতালে রায়বেঁশে নৃত্য পরিবেশন করতেন অনেকে। গবেষকেরা দাবি করেন, প্রাক স্বাধীনতার যুগ থেকে রায়বেঁশে শিল্পীরা হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন। পরবর্তী সময়ে গুরুসদয় দত্ত রায়বেঁশেকে নতুন করে তুলে ধরার চেষ্টা করেন।
স্বাধীনতার আগে থেকেই কোশিগ্রামের রায়বেঁশে শিল্পীরা জেলার নানা প্রান্তে খ্যাতি লাভ করেন। বিয়ের আসরে রাই সেজে সখীনাচ, বীরোচিত ভঙ্গিমা থেকে শুরু করে লাস্য ভঙ্গিমার নৃত্য— সব কিছুর জন্যই প্রসিদ্ধ ছিলেন এই গ্রামের শিল্পীরা। কালীকিঙ্কর ও তাঁর ভাই শঙ্কর পণ্ডিত ১৯৬১ সালে গড়ে তোলেন ‘কোশিগ্রাম গন রায়বেঁশে সংস্থা’।
এই বংশের বর্তমান পুরুষ দুঃখহরণ পণ্ডিত জানান, স্বাধীনতার পরে জেলার নানা প্রান্তে আত্মরক্ষার মাধ্যম হিসেবে লাঠির কদর কমতে থাকে। ফলে বিপদে পড়েন লাঠিয়াল থেকে শুরু করেন রায়বেঁশের শিল্পীরা। পরবর্তী সময়ে এই শিল্পীদের উত্তরাধিকারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আঙ্গীকটি পুনরুজ্জীবিত করা হয়। তৈরি হয় ‘কোশিগ্রাম রায়বেঁশে লোকসংস্কৃতি সংস্থা’। একই ভাবে বর্ধমানের অন্য কয়েকটি প্রান্তে রায়বেঁশের শিল্পীদেরকেও সংগঠিত করার কাজ শুরু হয়। দুঃখহরণবাবু জানান, দিল্লি, মুম্বই-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক পেয়েছেন রায়বেঁশে শিল্পীরা। বেসরকারি কয়েকটি চ্যানেলের রিয়্যালিটি শোতেও তাঁরা যোগ দিয়েছেন। তিনি জানান, স্টেজ শোতে লাঠি খেলা, বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তির কোলাজ, ঝুলন্ত মানব শৃঙ্খল, মানব পিরামিড, মাথায় উপরে কলসির ব্যালেন্স, লোহার রিঙে চার জনের প্রবেশ, লোহার তৈরি আগুনের বৃত্তের ভিতরে ঝাঁপের মতো নানা শারীরিক কসরত দর্শকদের কছে সমাদর পেয়ে এসেছে। খেলার সময়ে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ঢোল, কাড়া, সানাই প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। কলকাতার সনৎ দাশগুপ্ত ও মনন দাসের তৈরি তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে রায়বেঁশে শিল্পীদের কথা।
দুঃখহরণবাবুর কথায়, ‘‘আগেকার দিনে লাল কাপড়ের ধুতি বা হাফপ্যান্ট এবং গেঞ্জি পরে খেলা দেখানো হত। এখন রঙিন বাহারি ধুতি ও ফতুয়া পড়ে খেলা দেখাতে হয়। মা কালীর বন্দনা করে শুরু হয় অনুষ্ঠান। অধিকাংশ শিল্পীর ঘরের গৃহদেবী হিসেবে পূজিত হন মা মনসা।’’ তাঁর দাবি, রাজ্য সরকারের লোকসংস্কৃতির প্রচারের নানা প্রকল্পে ডাক পান শিল্পীরা। পাশাপাশি, মাসিক ভাতা, সরকারি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ, পোশাক ও বাদ্যযন্ত্রের অনুদান এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পীদের সংস্কৃতিচর্চার পরিবেশকে কিছুটা হলেও সহজ করেছিল। কিন্তু করোনা সংক্রমণ ও তার জেরে তৈরি অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে এই শিল্পকেও। শিল্পীরা বলেন, ‘‘এ বারে পয়লা বৈশাখ-সহ যাবতীয় অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেল। সরকারি স্তরেও সচেতনতা প্রসারে ডাক মিলছে না। এই অবস্থাতেও অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছি। পুজোর সময়ে যে এই পরিস্থিতিতে খুব বড় পরিবর্তন আসবে সে আশাও দূর অস্ত্। এই অবস্থায় শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে নতুন করে পরিকল্পনা করা দরকার।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy