Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Delhi Violence

বিচারের গতি

প্রধান বিচারপতি এস এ বোবডে বলিয়াছিলেন: (দাঙ্গা বা অনুরূপ) ঘটনা ঘটিবার পরেই আদালত সক্রিয় হইতে পারে, তাহা নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য তাহার নাই।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০০:০২
Share: Save:

সর্বোচ্চ আদালতের প্রধান বিচারপতি এজলাসে বসিয়া কোনও বাক্য উচ্চারণ করিলে তাহার ওজন স্বভাবতই বিপুল বলিয়া গণ্য করিতে হয়, এমনকি তাহা ‘মৌখিক মন্তব্য’ হইলেও। বিজেপির একাধিক নেতার ‘হেট স্পিচ’ বা বিদ্বেষভাষণের জন্য কেন তাঁহাদের নামে এফআইআর দাখিল হইবে না— এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার প্রধান বিচারপতি এস এ বোবডে বলিয়াছিলেন: (দাঙ্গা বা অনুরূপ) ঘটনা ঘটিবার পরেই আদালত সক্রিয় হইতে পারে, তাহা নিবারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য তাহার নাই। এই সূত্রেই মন্তব্য করিয়াছিলেন যে, (অধুনা বিবিধ অশান্তির পরিপ্রেক্ষিতে) আদালতের উপর ‘অস্বাভাবিক চাপ’ পড়িতেছে। এই উক্তি অনিবার্য বিস্ময় উদ্রেক করে। সর্বোচ্চ আদালতের উপর নাগরিকদের ভরসার মাত্রা এমনই যে, তাহার সামর্থ্যের সীমারেখা কোথায়, তাহার উপর কত চাপ পড়িতেছে, এই সব কথা শুনিলে তাঁহাদের হৃৎকম্প হওয়া স্বাভাবিক। সুপ্রিম কোর্টের ভূতপূর্ব বিচারপতি সন্তোষ হেগড়ে ঠিকই বলিয়াছেন, প্রধান বিচারপতি কথাটি আরও সূক্ষ্ম ভাবে বলিলে নাগরিকের আতঙ্ক কিছু কম হইত।

কিন্তু প্রশ্ন কেবল বক্তব্যের ভাব বা ভঙ্গি লইয়া নহে, তাহার মর্মবস্তু লইয়াও। প্রধান বিচারপতি যে সমস্যার উল্লেখ করিয়াছেন তাহা কতটা যথাযথ? একটি কথা অনস্বীকার্য। প্রশাসন (এবং আইনসভা) আপন কর্তব্য সততা, নিরপেক্ষতা এবং দক্ষতার সহিত পালন করিলে বিচারবিভাগের উপর চাপ অনেক কম পড়িত। বিচারবিভাগের উপর জনসাধারণকে এত বেশি ভরসা করিতে হয়, তাহার একটি বড় কারণ প্রশাসনের ব্যর্থতা ও দুরাচার। এই সমস্যা বিভিন্ন জমানাতেই দেখা গিয়াছে, যদিও বর্তমান সরকারের আমলে তাহা চরমে উঠিয়াছে, বিশেষত প্রশাসনের সততা ও নিরপেক্ষতা এই ভাবে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিবার দুর্মতি কার্যত অভূতপূর্ব। প্রধান বিচারপতি এই সত্যটি সরাসরি চিহ্নিত করিয়া প্রশাসন তথা তাহার সর্বাধিনায়কদের তিরস্কার করিলে— হয়তো— তাঁহাদের উপর ঈষৎ নৈতিক ‘চাপ’ সৃষ্টি হইত।

কিন্তু প্রশাসন উল্টোরথে চড়িয়াছে বলিয়াই তো জনসাধারণ, বিশেষত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুযোগবঞ্চিত মানুষ, অস্বাভাবিক চাপে আছেন। তাঁহাদের উপর নানা দিক হইতে ক্ষমতা-প্রমত্ত শাসকদের চাপ উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। এবং সেই কারণেই বিচারবিভাগের নিকট ভারতীয় নাগরিকদের গণতান্ত্রিক দাবি আরও বেশি। এমন কোনও অন্যায্য দাবি নহে যে, বিচারবিভাগকে আপন স্বাভাবিক কার্যপরিধির বাহিরে গিয়া প্রশাসনের ভূমিকা পালন করিতে হইবে। কিন্তু এই যুক্তিসঙ্গত দাবি যে, প্রশাসনের (বা অন্য যে কোনও প্রতিষ্ঠান অথবা ব্যক্তির) অন্যায়ের অভিযোগ উঠিলে তাহার সুবিচারে যথাসাধ্য তৎপর হইতে হইবে। সাম্প্রতিক কালে একাধিক ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের সিদ্ধান্তে সেই তৎপরতার অভাব দেখা যায় নাই কি? সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ক্ষমতাবানের হিংস্র এবং কদর্য বিদ্বেষভাষণ— বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়েই বিচারবিভাগের নিকট অনেক দ্রুততর গতি প্রত্যাশিত ছিল না কি? মহামান্য আদালতের বিচার যথাসম্ভব দ্রুত হওয়া আবশ্যক। তাহার জন্য বিচারবিভাগকেই আপন অগ্রাধিকার নির্ধারণ করিতে হইবে। সেই সিদ্ধান্ত সুবিবেচনাপ্রসূত না হইলে কাজের চাপে সুবিচারের হানি ঘটিতে পারে। প্রসঙ্গত, ধর্মবিশ্বাসের সহিত প্রার্থনার অধিকারের বিরোধ নিরসনের দার্শনিক প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ, তাহাতে কোনও সন্দেহ নাই, কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচারের প্রশ্ন কি এই মুহূর্তে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি জরুরি নহে? সর্বোচ্চ আদালত এই প্রশ্নের যে উত্তর দিবেন তাহা অবশ্যই মানিতে হইবে, কারণ সেই আদালতই সর্বোচ্চ। কিন্তু সদুত্তর না মিলিলে প্রশ্ন থাকিয়াই যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Violence CAA Protest Supreme Court SA Bobde
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE