Advertisement
E-Paper

এই তবে আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতার আরাধনা

শুধু ইসলামি মৌলবাদী কেন, ঘরের হিন্দু মৌলবাদীরাও একই কথা বলেন। সেই মিরর ইমেজ। আমরাই যে শ্রেষ্ঠ, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ওরা কত নিকৃষ্ট। আমাদের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মুখ থেকে প্রাচ্য-দর্শনের কথা শুনুন। শুনতে পাবেন ট্রাম্পের বক্তৃতার প্রতিধ্বনি।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৭ ১১:৫৪
অতীত: অনেক রক্তস্নানের পরে সে-দিন আমরা একসঙ্গে নতুন স্বাধীনতা উদ্যাপন করেছিলাম। কলকাতা, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭

অতীত: অনেক রক্তস্নানের পরে সে-দিন আমরা একসঙ্গে নতুন স্বাধীনতা উদ্যাপন করেছিলাম। কলকাতা, ১৫ অগস্ট ১৯৪৭

পাশ্চাত্য সভ্যতা আক্রান্ত, তাকে বাঁচাতে হলে এখনই হাত মেলান।— পোল্যান্ডে এক বিশাল সভায় দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাইরের দুনিয়া হতভম্ব তাঁর কথা শুনে। ট্রাম্প, আর পাশ্চাত্য সভ্যতা? মূল্যবোধ? তাই নাকি? পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রকৃষ্টতম ধ্বজাধারী তিনিই? তাঁর নেতৃত্বেই পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বাঁচাতে হবে? ট্রাম্পের নেতৃত্ব যাঁরা মানেন, তাঁরাও ভারী অবাক, বলেন কী, ‘ওয়েস্ট’ বলতে যা জানি, ট্রাম্প তার থেকে আলাদা বলেই তো ভোট দিয়েছিলাম!

তাঁরা যা জানতেন, জানতেন। ট্রাম্প মশাই কী জানেন বোঝেন পাশ্চাত্য সভ্যতা বলতে? অনুমানের দরকার নেই, ওই বক্তৃতাতেই পষ্টাপষ্টি বলে দিয়েছেন তিনি। বোঝেন ‘গড, ফেথ, ফ্যামিলি’। বোঝেন, ইসলামের বিরোধিতা। কী বোঝেন না? বোঝেন না, গণতন্ত্র। বাক্-স্বাধীনতা। নাগরিক স্বাধীনতা। ধর্মীয় স্বাধীনতা। বোঝেন না, কাকে বলে লিবারালিজম। এ সব শব্দ এক বারের জন্যও উঠে আসেনি ওঁর পাশ্চাত্য সভ্যতা বাঁচানোর জেহাদে।

আসবে কেন? সামাজিক মেলামেশার মধ্য দিয়ে সমাজের ভাল হয়, এ তিনি কোনও কালে বিশ্বাস করেন না। বরং সমাজকে ভেঙে টুকরো করে ‘আমরা এবং ওরা’ বানালেই আমরা-র ভাল হয়, এই তাঁর বিশ্বাস। এটাই তিনি দেশের লোকজনকে বুঝিয়েছেন, সফলও হয়েছেন। বিদেশে গিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার নামে এটাই চালাচ্ছেন তিনি, ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশনস’-এর গপ্পো ফেঁদেছেন। সেখানেও নির্ঘাত সফল হবেন।

হবেন, কেন না আজকাল এটাই চলছে। নতুন করে সভ্যতা সংস্কৃতিকে বোঝানো। আইডেন্টিটির নামে আক্রমণ উসকানো। ইতিহাসের নামে হিংসাভাব চারিয়ে দেওয়া। এই জায়গাটায় ট্রাম্পের সঙ্গে ট্রাম্পের জন্মশত্রু ইসলামি মৌলবাদীদের আশ্চর্য মিল। তাঁরা বলেন, কট্টর ইসলামের ‘গড, ফেথ, ফ্যামিলি’ মহৎ: তাই বাকিদের টুকরো টুকরো করে দাও। ট্রাম্পরাও ওই কথাই বলেন। কেবল উল্টো দিক থেকে। একেই বোধ হয় পণ্ডিতরা বলেন মিরর ইমেজ।

শুধু ইসলামি মৌলবাদী কেন, ঘরের হিন্দু মৌলবাদীরাও একই কথা বলেন। সেই মিরর ইমেজ। আমরাই যে শ্রেষ্ঠ, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, ওরা কত নিকৃষ্ট। আমাদের হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী আর তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের মুখ থেকে প্রাচ্য-দর্শনের কথা শুনুন। শুনতে পাবেন ট্রাম্পের বক্তৃতার প্রতিধ্বনি। একই শব্দ, একই সুর। ভারতীয় সভ্যতা আক্রান্ত। তাকে বাঁচাতে হলে এখনই হাত মেলান। প্রাচ্য সভ্যতা, ভারতীয় সভ্যতার অর্থ কী? ‘গড, ফেথ, ফ্যামিলি।’ আর ভারত-শত্রু মুসলিমদের বিরোধিতা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পছন্দমতো বানিয়ে নিয়েছেন পাশ্চাত্য সভ্যতার সংজ্ঞা। নরেন্দ্র মোদীরা তাঁদের পছন্দমতো বানিয়ে নিয়েছেন ভারতীয় সভ্যতার সংজ্ঞা।

গোটা পৃথিবী জুড়ে আজকাল এই জিনিসেরই দাপট। বিশেষ করে যে যে জায়গায় দিগদর্শী নেতারা ক্ষমতায় বসে পড়েছেন। প্রথমে তাঁরা মিত্রোঁ বলে ডেকে লম্ফঝম্প বক্তৃতা শোনাবেন। তার পর সেই মিত্রভাষণ শুনে দেশসুদ্ধ আমরা মহোৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমাদের সকলেরই সামনে মহৎ লক্ষ্য। সভ্যতা আর সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হবে। ওঁরা বলে দিয়েছেন, আমরা যদি এক্ষুনি সবাই মারামারি কাটাকাটি করে মীমাংসা না করি, সব রসাতলে যাবে। কে বলে, বড় বড় এই সব সভ্যতাগুলোর মধ্যে অনেক দিনের সহন আর বহন পোঁতা রয়েছে? অনেক লোক একসঙ্গে থাকছিল, তাদের আলাদা আলাদা মত ও পথ ছিল, এবং এই আলাদাগুলোকে নিয়ে একসঙ্গে থাকার মতো একটা সমাজ আর রাজনীতি তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছিল বলেই না প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা বেঘোরে মারা যেতে বসেছিল। এখন আমরা এসে গিয়েছি, সভ্যতা রক্ষাকারী ব্রিগেড, আর ভয় নেই। আগুন জ্বালিয়ে, লাঠি পিটিয়ে, গুলি মেরে ঘুণ-ধরতে-থাকা সভ্যতার ভূত ঝেড়ে আমরা সব ফরসা করে দেব।

ঘরের কাছেও নেতাদের ডাক এসে পৌঁছেছে। তিন বছর আগেও পশ্চিমবঙ্গে বসে আমরা যা যা বুক বাজিয়ে করিনি, এখন সবাই মিলে উঠে পড়ে লেগেছি সে-সব কাজে। মন খুলে গড, ফেথ, ফ্যামিলির নতুন ব্যাখ্যান দিচ্ছি। ব্যাখ্যানের মান বাড়াতে ফেসবুকে হুমকি ছড়াচ্ছি— হুঁ হুঁ বাবা, মসজিদ ভেঙে দেখিয়ে দিয়েছি, এ বার মন্দির বানিয়ে বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল। বোমা বেঁধে দেখিয়ে দিয়েছি, এ বার বোমা মেরে দেখাব কার কত মুরোদ। নিজে মহৎ হিন্দু হব বলে উঠতে বসতে মুসলমানদের গালি দিচ্ছি। নিজে ইমানদার মুসলমান হব বলে হিন্দু জবাইয়ের মহৎ কর্ম সম্পাদনে বেরোচ্ছি। মুসলিম বালককে গণপিটুনিতে খুন? বেশ হয়েছে, মনে আছে আওরঙ্গজেব কেমন হিন্দু নির্যাতন করেছিলেন? হিন্দু বালক কাবা-র অসম্মান করেছে? এক্ষুনি তরোয়াল বন্দুক যা আছে নিয়ে বেরিয়ে পড়্, হিন্দু বুড়োবুড়ি বাচ্চাকাচ্চা সবাইকে পুড়িয়ে মেরে বদলা নে।

এই আমাদের ধর্মপালন, সংস্কৃতিলালন, সভ্যতার আরাধনা। আমরা সবাই জানি, আমি ও আমরা, যা বলছি, সেটাই সত্যি, আর অন্য কথা যে যা বলছে, সব মিথ্যে। কেবল মিথ্যে নয়, অভিসন্ধিমূলক অপপ্রচার। যারা আমাদের কথা মানে না, তারা সব লিবারাল দুর্বৃত্ত, ওদের জন্মবৃত্তান্তে গোলমাল আছে। যারা দাঙ্গায় যোগ দিচ্ছে না, তারা ধর্মদ্রোহী, চোখে চোখে রাখতে হবে। প্রথম দলকে সুযোগ পেলেই অপমান করো, একঘর করো, এক হাত নাও। দ্বিতীয় দলকে পথে টানতে, যা করা সহজ সবচেয়ে সহজ সেটাই করো— টাকাকড়ি ছড়াও।

আহা, ট্রাম্প যদি জানতেন, বসিরহাটের মতো বিশ্ব-মানচিত্রে অখ্যাত এক জায়গা কী ভাবে সভ্যতার সর্বব্যাপী পুনর্জাগরণে একটি স্থায়ী দাগ রেখে গেল। সত্যিই, বড্ড উপকার হল দুনিয়াদারির। ধর্ম, সংস্কৃতি, সভ্যতা রক্ষার যুদ্ধটা এত দিন এই সুদূর বাংলায় চুপচাপ পাপের মতো চালাতে হচ্ছিল, ভয়ে ভয়ে, রেখে ঢেকে। এ বার, অবশেষে, সেটা ভেতর থেকে টেনে বার করে আনা গেল, সব ভয় শেষ, সব চাপাচুপির অবসান। বারাসতে, কলকাতায়, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে সর্বত্র এখন সংঘাতের দামামা। নেতারা যা লুকিয়ে করেছেন, জনতা তা প্রকাশ্য করেছে। সভ্যতা রক্ষায় গণতন্ত্রের যা কিছু অর্থ, সেটা এখানেই।

জন-আবেগের এই মহা-উদ্বোধনে তালিয়াঁ থেকে কেউ বাদ যাবেন না, সব দলের সব রঙের নেতানেত্রীরা— গেরুয়া লাল সবুজ! সবাই তাকিয়ে দেখুন, আপনাদের শিক্ষায় দীক্ষায় আমরা কত দূর এগোতে পেরেছি। আপনাদের এত দিনের চুপচাপ ভোটের নামে হিংসাচর্চা, হিংসাবাজদের হাতে এন্তার অর্থ আর অস্ত্র তুলে দেওয়া, কথায় কথায় লাঠিবন্দুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া, আইনশৃঙ্খলার মতো এলেবেলে জিনিসগুলো দেশ এবং রাজ্য জুড়ে শিকেয় তুলে দেওয়া, কিচ্ছুটি বিফলে যায়নি। কেউ কাল করেছেন, কেউ পরশু, কেউ আজ করছেন, কিন্তু সবাই জান দিয়ে খেটেছেন আমাদের সংগ্রাম পোক্ত করতে।

আপনাদের মশাই এলেম আছে। নয়তো এই দুনিয়াজোড়া আমরা-ওরা লড়াইয়ে বাঙালির মতো অলস জাতকে দিয়েও এত কিছু করিয়ে নেওয়া যায়, রিয়্যাল এবং ভার্চুয়াল? বাংলার দুর্নাম ঘুচল, কী বলেন?

Independence Day Freedom of Speech Religion Donald Trump
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy