E-Paper

নদিয়ায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে পর্তুগিজ়েরা

১৮ শতকের প্রথম অর্ধ যদি প্রোটেস্টান্টদের হয় তবে দ্বিতীয় অর্ধ অবশ্যই ক্যাথলিক মিশনারিদের।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৯:২২
প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চে বড়দিনের সাজ। বুধবার কৃষ্ণনগরে।

প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চে বড়দিনের সাজ। বুধবার কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

১৮৩২ সাল। নদিয়ায় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে এলেন মার্টিন লুথারের অনুগামী রেভারেন্ড জে দিরে। তিনি চার্চ মিশনারি সোসাইটি বা সিএমএসের হয়ে প্রোটেস্টান্ট ধর্মপ্রচারের সূচনা করলেন নদিয়ায়। বিশেষজ্ঞেরা অভিমত, পর্তুগিজ়েরা বঙ্গদেশে আসার আগে নদিয়ার খ্রিস্টধর্মের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। নদিয়ায় প্রথম খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু করেন প্রোটেস্টান্টরাই। সিএমএসের সদস্যরা ‘চার্চ’ নয় বলতেন মিশন। তাঁরা প্রচারে গিয়ে সবার আগে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতেন পরে গড়তেন মিশন ভবন বা চার্চ। রেভারেন্ড দিরে কে চার্চ প্রতিষ্ঠার জন্য কিছুদিনঅপেক্ষা করতে হয়।

কৃষ্ণনগর সেন্ট জনস চার্চের ফাদার রেভারেন্ড অশোককুমার মণ্ডল বলেন, “কৃষ্ণনগরে প্রথম প্রোটেস্টান্ট চার্চ বা সেন্ট জনস চার্চ প্রতিষ্ঠা হয় ১৮৩৪ সালে।” সমসাময়িক কৃষ্ণনগরের সিএমএস স্কুলটিও। সেকালে প্রোটেস্টান্টেরা কৃষ্ণনগর ছাড়াও চাপড়া, বল্লভপুর, কাপাসডাঙা, রতনপুর প্রভৃতি স্থানে মিশন স্থাপন এবং দীক্ষিত করার কাজ করতে থাকেন। তথ্য বলছে, তৎকালে বঙ্গদেশের মধ্যে নদিয়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। ১৮৩২-১৮৫০ সালের মধ্যে মোট ৪৫২০ জন দীক্ষিত হয়েছিলেন। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিশপ উইলসন কৃষ্ণনগরে পূর্ণাঙ্গ মিশন ভবন গড়েন। যা এখন সেন্ট জনস চার্চনামে সুপরিচিত।

এর কয়েক বছর বাদে ক্যাথলিকেরা নদিয়ায় পা রাখেন। ১৮ শতকের প্রথম অর্ধ যদি প্রোটেস্টান্টদের হয় তবে দ্বিতীয় অর্ধ অবশ্যই ক্যাথলিক মিশনারিদের। সেটা ছিল ১৮৪৫ সালের মে মাস। পর্তুগিজ় কার্মেলাইট ধর্মসঙ্ঘের ফাদার থমাস জুবিবুরু কৃষ্ণনগরে আসেন প্রথম ক্যাথলিক যাজক হিসাবে। এখন যেখানে কৃষ্ণনগর সদর হাসপাতাল সেখানে জমি কিনে নদিয়ার প্রথম ক্যাথলিক গির্জা স্থাপন করেন ১৮৪৬ সালে। নামকরণ হয় কার্মেলের মাতা মারিয়ার নামে। তিনি প্রথম পর্যায়ে প্রোটেস্টান্টদের ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত করার মধ্যে দিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৮৫২ সালে কৃষ্ণনগর-সহ নদিয়ায় কলেরা মহামারির আকার নেয়। আর কোনও জায়গা না পেয়ে শহরের তৎকালীন পরিচালকেরা গির্জাটি হাসপাতাল হিসাবে ব্যবহারের করতে চাইলে কলকাতার আর্চ বিশপ অনুমতি দেন। এ ভাবে নদিয়ার প্রথম ক্যাথলিক চার্চটি অবলুপ্ত হল।

১৮৫৫-৫৬ সালে ফাদার লুইজি লিমানা নতুন করে ক্যাথলিক চার্চ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। পরবর্তী তিন দশক ধরে নানা ভাঙাগড়ার মধ্যে দিয়ে নতুন করে গড়ে উঠতে থাকে কৃষ্ণনগরের ক্যাথলিক গির্জা। ইতিমধ্যে ইতালির মিলন থেকে আসা যাজকেরা চার্চের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ১৮৮৬ সালে কৃষ্ণনগরকে ধর্মপ্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং প্রথম বিশপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মুনসিনিয়র পৎসি। ১৮৯৭ সালে প্রথমে অগ্নিকাণ্ড ও পরে প্রবল ভূমিকম্পে ফের গির্জাটি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৮৯৯ থেকে বর্তমান কৃষ্ণনগরের বর্তমান গির্জাটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

কৃষ্ণনগর ধর্মপ্রদেশের লেইটি কমিশনের সম্পাদক এবং ভারতের ক্যাথলিক বিশপ সম্মিলনীর লেইটি কাউন্সিলের সদস্য সমীর স্টিফেন লাহিড়ী জানিয়েছেন, কৃষ্ণনগর ধর্মপ্রদেশের তত্ত্বাবধানে নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ মিলিয়ে মোট ২১টি গির্জা আছে, যেগুলি মর্যাদায় পারিস বা ধর্মপল্লি। সেগুলির নীচে রয়েছে দুশোরও বেশি ছোট গ্রামীণ গির্জা।

নদিয়ার সব প্রোটেস্টান্ট চার্চই ব্যারাকপুর ধর্মপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেগুলি চার্চ মিশনারি সোসাইটি (সিএমএস) তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত হত। ১৯৭০ সালে সারা ভারতবর্ষের গির্জাগুলিকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়। চার্চ অব সাউথ ইন্ডিয়া বা সিএসআই এবং চার্চ অব নর্থ ইন্ডিয়া বা সিএনআই। নদিয়ার প্রটেস্টান্ট চার্চগুলি সিএনআই-এর নিয়ন্ত্রনাধীন। রেভারেন্ড অশোককুমার মণ্ডল বলেন, “সিএনআই-এর তত্ত্বাবধানে দেশে ২৯টি ধর্মপ্রদেশ রয়েছে। যার মধ্যে একটি ব্যারাকপুর, কৃষ্ণনগর চার্চ তার অন্তর্গত পদমর্যদায় সেটি একটি ‘পালকীয়’ অঞ্চল। ব্যারাকপুর ধর্মপ্রদেশের তত্ত্বাবধানে এমন ২৪টি পালকীয় অঞ্চলে মোট ১০৯টি গির্জা রয়েছে।”

গোটা নদিয়ায় পালকীয় অঞ্চলের সংখ্যা পাঁচটি। তার মধ্যে আছে কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, শিকারপুর, সোলুয়া এবং চাপড়া। কৃষ্ণনগরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দু’টি গির্জা। সেন্ট জনস এবং তাহেরপুরের সেন্ট মার্ক চার্চ। রানাঘাট বেগোপাড়া পালকীয় অঞ্চল তথা চার্চ সেন্ট লুকের তত্ত্বাবধানে রয়েছে দু’টি ছোট চার্চ। সোলুয়া পালকীয় অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে মোট ছ’টি গির্জা। সোলুয়া, হাউলিয়া, বালিউড়া, পুটিমারি, বেদবেরিয়া এবং মালিয়াপোতা। শিকারপুর পালকীয় অঞ্চলের তত্ত্বাবধানে রয়েছে একটি মাত্র গির্জা। অন্য দিকে, আর এক প্রাচীন প্রটেস্টান্ট চার্চের তত্ত্বাবধানে রয়েছে চারাতলা, বহিরগাছি, রানাবন্দ, তালুকহুদার গির্জা।

বুধবার সন্ধ্যায় কৃষ্ণনগর সেন্ট জনস গির্জায় বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনায় উপস্থিত ছিলেন ব্যারাকপুর ধর্মপ্রদেশের বিশপ রাইট রেভারেন্ড সুব্রত চক্রবর্তী। কৃষ্ণনগর ক্যাথলিক চার্চে প্রার্থনা পরিচালনা করেন বিশপ নির্মলভিনসেন্ট গোমেজ়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Christianity

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy