—প্রতীকী ছবি।
শ্রম মানুষের সহজাত সম্পদ। শ্রমের অবমূল্যায়ন কেবল আর্থিক দুর্দশার কারণ নহে, অমর্যাদারও কারণ। ন্যূনতম পারিশ্রমিক আইন সেই অন্যায়কে প্রতিরোধ করিবে, ইহাই প্রত্যাশা। কিন্তু ন্যূনতম মজুরির অঙ্ক কী হইবে, কী রূপেই বা তাহা ধার্য হইবে সে বিষয়ে বিতর্কের শেষ নাই। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমমন্ত্রক নিযুক্ত একটি কমিটি সুপারিশ করিয়াছে, দৈনিক তিনশো পঁচাত্তর টাকা সারা দেশে ন্যূনতম মজুরি ধার্য করিতে হইবে। অথবা দেশের পাঁচটি অঞ্চল-ভেদে তাহার অঙ্ক হইবে তিনশো বিয়াল্লিশ টাকা হইতে চারশো সাতচল্লিশ টাকা। কর্মক্ষেত্র, দক্ষতা, গ্রাম-শহর নির্বিশেষে এই মজুরির হার নির্দিষ্ট করিয়াছে ওই কমিটি। ইহাতে কতটা আশান্বিত হইতে পারেন ভারতের শ্রমিকেরা? কেন্দ্রীয় সরকার এই সুপারিশ গ্রহণ করিলে একশো দিনের কাজের দৈনিক মজুরি বাড়িতে পারে, ইহা আশার কারণ। গত কয়েক বৎসরে ওই প্রকল্পে মজুরি বাড়িয়াছে যৎসামান্য। নরেন্দ্র মোদী সরকারের কার্যকালে গ্রামীণ রোজগার বৃদ্ধির হার ক্রমাগত কমিয়াছে। তাহার একটি কারণ যেমন কৃষির সঙ্কট, তেমনই একশো দিনের কাজের মজুরির স্বল্পতাও একটি কারণ। অতএব কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত উপদেষ্টা কমিটি যদি সুপারিশ গ্রহণ করে, তবে তাহা কৃষি শ্রমিকের নিকট স্বস্তির কারণ হইতে পারে। তবে চাষির রোজগার বৃদ্ধি যখন অনিশ্চিত, তখন কৃষি শ্রমিকের পারিশ্রমিক দ্রুত বাড়িলে কৃষির পরিস্থিতি কেমন হইবে, তাহাও বিচার্য।
তবু একটি সুফল ফলিতে পারে, মজুরি ধার্য করিবার যে পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াছে এই কমিটি, তাহাকে স্বাগত জানাইতে হয়। এ যাবৎ যে সূচক ধরিয়া মজুরি নির্ধারিত হইত (বিবিধ ভোগ্যপণ্যের জন্য কৃষিশ্রমিকের ব্যয়ের সূচক) তাহাতে খাদ্য অধিক গুরুত্ব পাইত, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিবহণের মতো ব্যয়ের গুরুত্ব থাকিত কম। কিন্তু যে সূচক ব্যবহার করিবার সুপারিশ করিয়াছে কমিটি (ভোগ্যপণ্যের জন্য যে কোনও উপভোক্তা, অথবা শিল্পশ্রমিকের ব্যয়ের সূচক) তাহাতে খাদ্যের প্রাধান্য কমাইয়া অপর বিষয়গুলির ব্যয় গুরুত্ব পাইয়াছে। এই পরিবর্তনের পিছনে একটি স্বাভাবিক এবং বাস্তবসম্মত যুক্তি আছে। দরিদ্র পরিবারগুলিতে কায়িক শ্রমের কাজ কমিতেছে, তাই অধিক খাদ্যশস্য গ্রহণের প্রয়োজনও কমিয়াছে।
কমিটির এই সুপারিশ কেন্দ্র যদি গ্রহণ করে, তাহা হইলেও আরও কর্তব্য থাকিয়া যায়। ন্যূনতম পারিশ্রমিকের এই সুপারিশ কমিটি করিয়াছে সকল রাজ্যের জন্য, সরকারি এবং অসরকারি উভয় কর্মক্ষেত্রের জন্য। এক কথায়, সকল কাজে, সকল কর্মক্ষেত্র নির্দিষ্ট হারে ন্যূনতম মজুরি দিতে হইবে। এই সুপারিশকে বাস্তবে পরিণত করিতে চাহিলে প্রয়োজন কেন্দ্রীয় আইন। কারণ বর্তমানে রাজ্যগুলি নিজ নিজ রীতি অনুসারে ন্যূনতম মজুরি ধার্য করে। সকল রাজ্যের জন্য মজুরির এক হার বাঁধিয়া দিতে নূতন বেতন বিধির প্রস্তাব সংসদে পেশ করিয়াছিল শ্রমমন্ত্রক। কিন্তু তাহা পাশ করাইতে পারে নাই সরকার। এই উদ্যোগের সহিত যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের একটি বিরোধ আছে, তাহা সত্য— এক অর্থে ইহা রাজ্যের উপর কেন্দ্রের মত চাপাইয়া দিবার একটি নূতন ক্ষেত্র প্রস্তুত করিবে। কিন্তু ইহাও সত্য যে, এমন কোনও আইন না করিলে কেন্দ্রের নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের হার বাকি দেশের নিকট কেবল একটি দৃষ্টান্ত বা ‘মডেল’ হইয়া থাকিবে। একই কারণে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশও কার্যকর করা যায় নাই। স্থায়ী এবং অস্থায়ী, সকল কর্মীকে সমান কাজের জন্য সমান মজুরি দিবার নির্দেশ দিয়াছিল শীর্ষ আদালত। তাহার পর দুই বৎসর কাটিয়াছে। কত ঠিকা মজুর স্থায়ী কর্মীর হারে বেতন পাইয়াছেন? আপাতত প্রাপ্তি ইহাই যে, দরিদ্রতম শ্রমিকের মজুরি দ্বিগুণ করিবার প্রয়োজনটি দেশকে মনে করাইলেন বিশেষজ্ঞরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy