Advertisement
E-Paper

অন্য অত্যাচার

বিবাহ মানুষের সঙ্গী-প্রাপ্তির নিমিত্তই রচিত এক সামাজিক পদ্ধতি। মানুষ বিবাহ করে সংসার পাতিবার জন্য, যৌনতার জন্য, প্রেমের জন্য। এই সকল আকাঙ্ক্ষার মূল কথা হইল, অন্য এক ব্যক্তির সহিত জীবন যোগ করা।

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০০:০৪
প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

সুপ্রিম কোর্ট বলিল, শ্বশুরবাড়ির কেহ যদি নববধূর সহিত কথা না বলে, তাহা নিষ্ঠুরতা নহে। এক মহিলা অভিযোগ করিয়াছিলেন, ৪৯৮এ ধারায় স্বামীকে দোষী ধরা হউক, কারণ বিবাহের পর তিনি ২০ দিন স্বামীর সহিত ছিলেন, এই সময় স্বামী তাঁহার সহিত একটিও কথা বলেন নাই, বধূ কথা বলিবার চেষ্টা করিলেও তাঁহাকে এড়াইয়া গিয়াছেন, শ্বশুরালয়ের অন্য কেহও তাঁহার সহিত কথা বলেন নাই। স্বামী কার্যব্যপদেশে অস্ট্রেলিয়া চলিয়া যাইবার পরেও তাঁহার দশা একই। তাঁহাকে একা রাখা হইত এবং শ্বশুরালয়ের কেহ তাঁহার সহিত একটিও কথা বলিতেন না। বধূ তাহার পর পিত্রালয়ে চলিয়া যান। অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টে আসিয়া পৌঁছাইবার পর, বিচারকেরা বলিয়াছেন, ওই ধারা অনুযায়ী স্বামীকে বা শ্বশুরালয়ের কাহাকেও দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আইন অনুযায়ী নিশ্চয় ঠিকই রায় দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু আইনের বাহিরে দাঁড়াইয়া, স্বাভাবিক জীবনের নিরিখে দেখিলে, ইহাকে অ-নিষ্ঠুর আচরণের আখ্যা দেওয়া কষ্টকর হইয়া পড়ে। মানুষকে অত্যাচার কেবল যে মারিয়া-ধরিয়াই করা যায় তাহা নহে। চরম ঔদাসীন্য উপেক্ষা অবহেলা মানুষের গাত্রে শরের ন্যায়ই বিঁধিয়া যায়। বহু মানুষের শৈশবের ভয়াবহ ও বেদনার্ত স্মৃতি হইল, তাহাকে খেলায় না লইয়া বন্ধুরা নিজেরা খেলিয়াছিল। বা, টিফিনের সময় সহপাঠীরা নিজেরা গল্পগুজব করিত, কিন্তু তাহাকে কেহ দলে লইত না। মানুষ এমন এক প্রাণী, যে নিঃসঙ্গ থাকিতে পারে না। বস্তুত, সঙ্গাভিলাষই তাহার প্রায় সমস্ত দুঃখ, ও সমস্ত সুখের জন্য দায়ী। সমষ্টির সহিত তাহার যোগ না থাকিলে তাহার প্রবল মনঃকষ্ট ঘটে, তাহার জীবন ব্যর্থ মনে হয়। একটি ঘরে এক জনকে রাখিয়া তাহার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিলে, তাহা একা-মানুষের পক্ষে এক চরম শাস্তি।

বিবাহ মানুষের সঙ্গী-প্রাপ্তির নিমিত্তই রচিত এক সামাজিক পদ্ধতি। মানুষ বিবাহ করে সংসার পাতিবার জন্য, যৌনতার জন্য, প্রেমের জন্য। এই সকল আকাঙ্ক্ষার মূল কথা হইল, অন্য এক ব্যক্তির সহিত জীবন যোগ করা। তাহার সহিত এক যুগ্ম সংসার পত্তন করা, দুই জনে মিলিয়া সেই সংসারের সকল দিক আলোচনা করিয়া, হাসিয়া কাঁদিয়া অভিমান করিয়া কলহ করিয়া, পরদা বেডকভার আলমারি ফ্রিজ কিনিয়া, ঘনিষ্ঠ নিশিযাপন করিয়া, সন্তান লাভ করিয়া, তাহাকে বড় করিয়া, এক পরিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্যই বিবাহ। এই বিবাহে স্বামী কথাও বলেন নাই, যৌন সম্পর্কের প্রশ্নই উঠে নাই, সংসার করা বলিতে যাহা বুঝায় তাহারও চিহ্নমাত্র দেখা যায় নাই। তাহা হইলে বিবাহ করিয়া যাঁহাকে আনা হইল, ইহা কি তাঁহার প্রতি তীব্র নৃশংসতা নহে? ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী, বিবাহে সাধারণত বধূ শ্বশুরালয়ে আসেন। সম্পূর্ণ অজানা গৃহে, অচেনা লোকের মধ্যে আসিয়া বধূর একা, অসহায় লাগে। সেই সংসারের প্রাথমিক কর্তব্যই হইল, বধূর সহিত এমন আচরণ করা, যাহাতে তিনি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন, এই সংসারকে ধীরে ধীরে নিজস্ব বলিয়া মনে করিতে থাকেন। তাহার পরিবর্তে প্রথম হইতেই তাঁহাকে যদি ব্রাত্য করিয়া, স্পষ্ট করিয়া দেওয়া হয়, তিনি সর্বৈব অনাকাঙ্ক্ষিত আগন্তুক, এমনকী স্বামীও তাঁহার সহিত একটি বাক্যও বিনিময় করিতে চাহেন না, তবে তো বিবাহ প্রথাটির মূল অভীপ্সাটিকেই অবমাননা করা হইল। বিবাহের উদ্দেশ্য সম্পর্ক স্থাপন, স্বামীর সহিত প্রণয়ের, শ্বশুরালয়ের অন্যদের সহিতও সখ্য প্রীতি শ্রদ্ধার। এই ভিত্তি-ধারণাটিকেই যদি কেহ অগ্রাহ্য করেন, তাহার অর্থ দাঁড়ায়, তিনি আদৌ বিবাহ উদযাপন করিতে চাহেন না, অন্য উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠানে শামিল হইয়াছেন। বধূটি যদি মনে করেন, তাঁহাকে এই পরিবারে আনা হইয়াছে কেবলমাত্র তাঁহার পিতা যে পণ দিয়াছেন তাহার লোভে, তাহা কি উদ্ভট অনুমান হইবে? এ কথা ঠিক যে পণের জন্য তাঁহাকে চাপ দেওয়া হয় নাই, প্রহার করা হয় নাই। কিন্তু পণটুকু (বধূর পিতা তাঁহাকে কুড়ি লক্ষ টাকার স্বর্ণালঙ্কার দিয়াছিলেন) আদায় করিয়া তাঁহাকে সংসারের প্রান্তে অনাদৃত অনাহূতের মতো ফেলিয়া রাখা হইয়াছে, ইহাতেও তাঁহাকে কি কেবল পণ আদায়ের একটি উপায় হিসাবেই ব্যবহার করা হইল না? নারী-নিগ্রহের বিরুদ্ধে এখন প্রবল প্রচার চলিতেছে। তাই কেহ যদি ভাবিয়া-চিন্তিয়া নিগ্রহের নূতন উপায় বাহির করেন, একঘরে করিয়া, পরিকল্পিত পরিত্যাগের মাধ্যমে বধূটির জীবন বিষাক্ত করিয়া তুলেন, যাহা কিনা আদালতেও নিগ্রহ হিসাবে স্বীকৃতই হইবে না, তবে পুংশাসিত সমাজের উচিত তাঁহাকে অন্তত ৪৯৮ টাকা দিয়া পুরস্কৃত করা!

যৎকিঞ্চিৎ

বড়োদরা পুরসভার কমিশনার একটা মামলা বিষয়ে হাইকোর্টের বিচারককে হোয়াট্সঅ্যাপে মেসেজ করলেন। বিচারক প্রচণ্ড রেগে তাঁকে ভর্ৎসনা করেছেন, বলেছেন আদালত কোনও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম নয়। কিন্তু এখন তো পৃথিবী চলছে হোয়াট্সঅ্যাপেই, প্রেম গড়া ও ভাঙা হচ্ছে সেখানে, চুটকি সাহিত্য ম্যানিফেস্টো প্রচার হচ্ছে, হয়তো খুনের সুপারিও দেওয়া হচ্ছে। হু-হু পরিবর্তনশীল জগতে, ছিল ডিম হয়ে গেল প্যাঁকপেঁকে হাঁস, ছিল প্রান্তিক হল মেনস্ট্রিম, হামেশাই!

Domestic Violence Supreme Court Law
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy