Advertisement
E-Paper

‘নয়া পাকিস্তান’ দূর অস্ত্

পাকিস্তান নতুন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, কিন্তু আমরা কি নতুন পাকিস্তান আশা করতে পারি?

ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
অবশেষে: পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেন। ইসলামাবাদ, ১৮ অগস্ট। পিটিআই

অবশেষে: পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট মামনুন হুসেন। ইসলামাবাদ, ১৮ অগস্ট। পিটিআই

পাকিস্তান নতুন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে, কিন্তু আমরা কি নতুন পাকিস্তান আশা করতে পারি? প্রাক্তন ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক হওয়া ইমরান খান সে দেশের ২২তম প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হলেন, এই উপলক্ষে প্রশ্নটা মনে এল। ১৮ অগস্ট তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি ছিল প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লক্ষ্যে তাঁর দু’দশকের বেশি দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের নানা সংগ্রামের শেষে পাওয়া একটি চরম মুহূর্ত। ইমরানের রাজনীতিতে চলার পথটি বরাবরই ছিল কঠিন, এবং এই পুরো সময়টায় তাঁর প্রতিশ্রুতি ছিল এক ‘নয়া পাকিস্তান’ নির্মাণের।

কিন্তু তাঁর রাজ্যপাট শুরুর সূচনাটি শুভ হল না। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা, যাঁদের ভোটের ময়দানে সক্রিয় থাকার কথা ছিল, তাঁদের কেউ ‘নিরাপদ’-এ জেল-বন্দি, কেউ বিদেশে পলাতক, ফিরলেই গ্রেফতারের সম্ভাবনা। এর উপরে রয়েছে সর্ব ক্ষণ পাকিস্তান সেনার ছায়া, গত ছয় দশক যারা নির্লজ্জ ভাবে পাকিস্তানকে চালনা করেছে। আর তাই একটুও আশ্চর্য লাগে না যখন প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ ‘আইওয়ান-এ-সদর’-এ শপথ অনুষ্ঠানের দর্শকাসনে পাকিস্তান সেনার অধিকর্তা অমায়িক অহঙ্কার নিয়ে অধিষ্ঠিত থাকেন।

ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হলেন, এতে পাকিস্তান সেনার খুশি হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। অনেকেরই ধারণা, তাঁর প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা আগে থেকে ঠিক করা ছিল। দেশের গণমাধ্যমেও সেই পূর্বাভাস ছিল। জুলাইয়ের নির্বাচনে তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-এ-ইনসাফ (পিটিআই) একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছতে পারেনি— সরকার গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে তাদের কুড়িটি আসন কম ছিল। তবে অচিরেই ৯ জন নির্দল প্রার্থী ইমরানের সঙ্গে যোগ দেন, দলের আসন ১১৬ থেকে বেড়ে ১২৫-এ পৌঁছয় (২৭২টি সাধারণ আসনের মধ্যে)। পাকিস্তান মুসলিম লিগ (কিউ) ও বালুচিস্তান আওয়ামি পার্টি-সহ কিছু স্বল্পপরিচিত দলও তাঁকে সমর্থন জানায়। এমনটা যে হতে পারে, সংবাদমাধ্যমে আগেই সে রকম আভাস দিয়েছিল। দেশের আসল ক্ষমতা যাদের হাতে, তারা ঠিক করেছিল, দুই প্রধান রাজনৈতিক দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) এবং পিপলস পার্টি অব পাকিস্তানকে কোণঠাসা করে ইমরান খানের দলকে এগিয়ে দেবে, অবশ্যই একটি দুর্বলতর রাষ্ট্রের পরিসরে। ঠিক সেটাই ঘটল। রাওয়ালপিন্ডির সেনা-সদর তাদের লক্ষ্য পূর্ণ করেছে। অসামরিক প্রশাসনের শীর্ষে এক জন দুর্বল, নমনীয় প্রধানমন্ত্রীকে বসানোই তাদের উদ্দেশ্য ছিল।

পাকিস্তান সেনার সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের। ২০১৪ সালে ইমরান এবং কানাডার ইসলামপন্থী তাহিরুল কাদরি ইসলামাবাদ অবরোধ করেছিলেন এই দাবিতে যে, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ় শরিফকে পদত্যাগ করতে হবে, কারণ তিনি ২০১৩ নির্বাচনে কারচুপি করেছিলেন। কিন্তু এই গণ-আন্দোলনের ফানুস চুপসে দিয়েছিলেন ইমরানের দলেরই সভাপতি মাকদুম জাভেদ হাসমি— তিনি এই বলে বোমাটি ফাটান যে, তাঁদের দলের নেতৃত্বে এই বিক্ষোভের পুরোটাই আসলে ছিল সেনাবাহিনীর ছক!

গড়ে-পিটে নেওয়া যায় এমন এক জন দেশের শীর্ষ পদে আসীন থাকলে সেনা অধিকর্তারা এই ভেবে নিশ্চিত হতে পারেন যে, সব ভাল যার শেষ ভাল। তবে বাস্তবে তেমনটা না-ও হতে পারে। এই মুহূর্তে ইমরান খান হয়তো সেনার বিরোধিতা করবেন না। কিন্তু সময় গড়ালে নিজের ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদে দেশের সঙ্কট সামলানোর জন্য তিনি সেনা অধিকর্তাদের সঙ্গে বিবাদে যেতেও পারেন। পাকিস্তান সেনা দেশে কতকগুলি অলিখিত নিয়ম জারি রেখেছে— জাতীয় নিরাপত্তা, বিদেশ নীতি ও সামরিক বাজেট, এই তিনটি ব্যাপারে অসামরিক প্রশাসনের কোনও বক্তব্যই থাকবে না। এর ফলে প্রধানমন্ত্রীর হাত-পা অনেকটাই বাঁধা, কারও কারও মতে তিনি আসলে ‘ইসলামাবাদের মেয়র’ হিসেবে কাজ করবেন। সুতরাং, পাকিস্তানের মতো একটি মুমূর্ষু দেশকে উদ্ধারের জন্য ইমরান খান যা কিছু করতে চাইবেন, তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। তাঁর বিদেশমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি দাবি করেছেন যে, তাঁর দল সেনার প্রভাবমুক্ত বিদেশ নীতি মেনে চলবে, আবার এক নিঃশ্বাসে ঘোষণা করেছেন: দুই প্রতিবেশী দেশের ‘আলোচনা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই’। মনে রাখতে হবে, বহু বছর ধরে এটাই পাকিস্তান সেনার দাবি। ভারত বলে এসেছে, সন্ত্রাস বন্ধ না হলে কথা শুরু করা যাবে না। অন্য দিকে পাকিস্তানের দাবি, কোনও শর্ত ছাড়াই আলোচনায় বসতে হবে। এবং নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রথমে ইমরান খান যত ভাল কথাই বলুন, ইতিমধ্যেই তাঁর কথাবার্তায় এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, তাঁর নীতি পাকিস্তানি সেনার নীতি থেকে আলাদা কিছু নয়।

তবে মনে হয় না, প্রধানমন্ত্রী ইমরানের অগ্রাধিকার তালিকায় ভারতের স্থান প্রথম সারিতে থাকবে। তাঁর প্রাথমিক কাজ দু’টি: এক, বিদেশি ঋণ শোধের সঙ্কট সামাল দেওয়া এবং দুই, চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূর করা। এই প্রকল্প নিয়ে পাকিস্তানে বিতর্ক বেড়েই চলেছে, বিশেষ করে এই কারণে যে, এই প্রকল্পে স্থানীয় অর্থনীতির বিশেষ উপকার হচ্ছে না। বেশির ভাগ বড় মাপের বরাতই দেওয়া হয়েছে চিনকে, অনেক ক্ষেত্রেই ম্যানেজার এবং কর্মীদেরও আনা হচ্ছে চিন থেকে। যেটুকু যা থাকছে, তাও পাচ্ছেন পূর্ববর্তী জমানার অনুগতরা। নির্বাচনের আগে ইমরান খান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, নওয়াজ় শরিফের সরকার সিপিইসি নিয়ে যে সব চুক্তি করেছে, তিনি ক্ষমতায় এলে সেগুলি নতুন করে খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি রাখতে গেলে তাঁকে সরাসরি সামরিক কর্তাদের মোকাবিলা করতে হবে, কারণ তাঁরা সিপিইসি প্রকল্পকে ‘জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন’ বলে ঘোষণা করে নিজেদের কুক্ষিগত করেছেন।

সিপিইসি’র বৃহত্তর সমস্যাটা পাকিস্তানের ঋণের বোঝা নিয়ে। এখন এটা স্পষ্ট যে নওয়াজ় শরিফের সরকার যথেচ্ছ বিদেশি ঋণ নিয়ে চলেছিল— ২০১৩-র জুন মাসে স্টেট ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তান-এর হিসেবে মোট বিদেশি ঋণ ছিল ৯১৮০ কোটি ডলার, ২০১৮ মার্চে সেই অঙ্ক বেড়ে দাঁড়ায় ১২,২৭০ কোটি। এখন পাকিস্তানের মোট বিদেশি ঋণের পরিমাণ দেশের জিডিপি-র ৩০ শতাংশ। আইএমএফ-এর হিসেব অনুযায়ী, চলতি অর্থবর্ষে (২০১৮-১৯) পাকিস্তানকে বিদেশি ঋণ শোধের জন্য ২৭০০ কোটি ডলার বার করতে হবে। আগামী দু’বছরে এই অঙ্ক পৌঁছবে ৪৫০০ কোটি ডলারে, যা অ-সম্ভব রকমের বেশি।

সমস্যা হল, পাকিস্তান এখনও সাধ্যের বাইরে খরচ করে চলেছে, চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি বাড়ছে মাসে ২০০ কোটি ডলার করে। পাশাপাশি, সিপিইসি বাবদ চিনকে বিপুল অঙ্কের টাকা শোধ দিতে হচ্ছে। এ দিকে, তেলের দাম বাড়ছে, পাকিস্তানি টাকার দাম কমছে ডলারের তুলনায়, ফলে আমদানি খরচ বেড়েই চলেছে। স্বভাবতই, বিদেশি মুদ্রার ভয়াবহ সঙ্কট থেকে আপাতত বাঁচার জন্য পাকিস্তানকে, আগের অনেক বারের মতোই, আইএমএফের কাছে হাত পাততে হয়েছে— ইসলামাবাদ ১২০০ কোটি ডলার সাহায্য চেয়েছে তাদের কাছে। কিন্তু সেই আবেদন মঞ্জুর হবে, এমন ভরসা এখনও মেলেনি, কারণ আমেরিকা আপত্তি করছে, তাদের বক্তব্য: ওই টাকা দিয়ে পাকিস্তান চিনের কাছে সিপিইসি-র বকেয়া মেটাবে।

সহজ শর্তে বিদেশি ঋণের স্রোত বন্ধ হলে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি-হারও ২০১৮-র ৫.৬ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে কমে ৪.৭৬ শতাংশ দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ যাত্রায় ওয়াশিংটন পাকিস্তানের পরিত্রাতা হবে বলে মনে হয় না। চিনও সম্ভবত সে ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করবে, কারণ দুই দশকের ইতিহাসে এই প্রথম তার নিজের চলতি খাতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, এবং প্রধানমন্ত্রী শি চিনফিং দেশের ঋণের মাত্রা কমাতে চান। এই অবস্থায় ইমরান খান সম্ভবত আবিষ্কার করবেন যে, প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা সহজ কাজ ছিল, ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার প্রতিশ্রুতি পূরণ অনেক বেশি কঠিন।

Pakistan Imran Khan Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy