Advertisement
১৮ মে ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

রুহানের বার্তা

রুহানের ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গেও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে ভাবিতে বাধ্য করিবে। রাজ্য সরকার শিশুমৃত্যু কমাইতে উচ্চ প্রযুক্তির চিকিৎসার উপরেই সর্বাপেক্ষা জোর দিয়াছেন।

শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

সাগর পার হইয়া গোষ্পদে ডুবিলে শোকের অপেক্ষা ক্ষোভ অধিক হয়। পাকিস্তানের শিশু রুহানের মৃত্যু সংবাদে তেমনই অনুভূতি হইতে বাধ্য। হৃৎপিণ্ডের কষ্টসাধ্য, ব্যয়সাধ্য একটি অস্ত্রোপচার করাইয়া শিশু রুহান ভারত হইতে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়া গেল। দেশে ফিরিবার পরেই চার মাসের শিশুটি উদরাময়ে জলশূন্য হইয়া মারা গেল। ইহা বস্তুত গোটা উপমহাদেশের জন্য একটি বার্তা। তাহা এই যে, প্রাথমিক চিকিৎসার উন্নতি না করিয়া অতি-উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা কার্যত অর্থহীন। চিকিৎসার উন্নতি বলিতে সচরাচর জটিলতম, অতি ব্যয়সাধ্য চিকিৎসার জোগানকেই বোঝানো হইয়া থাকে। সকল জেলা, সকল মহকুমা, সকল ব্লকের হাসপাতালে সর্বোচ্চ প্রযুক্তি রাখিবার জন্য ক্রমাগত তাগাদা দিবার কাজটিই স্বাস্থ্যের উন্নয়নে তাঁহার কর্তব্য বলিয়া মনে করেন জনপ্রতিনিধিরা। অথচ উদরাময়, ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মার মতো অসুখে অগণিত প্রাণ ঝরিয়া যায় প্রতি বৎসর। যাহার নিয়ন্ত্রণ আয়ত্তের মধ্যে, সহজসাধ্য। তাহার জন্য বিস্তর খরচের প্রয়োজন নাই, অনেক ডাক্তারেরও প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন শুধু যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও নিয়মিত নজরদারির। দায়বদ্ধতার। অবহেলায়, অবজ্ঞায় গোড়া কাটিয়া আগায় জল দেওয়া হইতেছে, তাই রাজ্যের অগণিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডাক্তার নাই, ঔষধ নাই, রক্ত-মূত্র পরীক্ষার ব্যবস্থা সামান্যই, অথচ রাজ্য জুড়িয়া সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল।

রুহানের ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গেও শিশুস্বাস্থ্য বিষয়ে ভাবিতে বাধ্য করিবে। রাজ্য সরকার শিশুমৃত্যু কমাইতে উচ্চ প্রযুক্তির চিকিৎসার উপরেই সর্বাপেক্ষা জোর দিয়াছেন। বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা হাসপাতালে গড়িয়া উঠিয়াছে নবজাতকদের জন্য ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট। তাহার ব্যবস্থাপনা যথেষ্ট উন্নত। অতি সংকটাপন্ন শিশুরাও চিকিৎসিত হইয়া সুস্থ শরীরে বাড়ি যায়। কিন্তু তাহার পর কী হয়? অতি অল্প শিশুকেই কয়েক মাস বা বৎসর অন্তে ফের দেখাইবার নির্দেশ দেন চিকিৎসকরা। বাকি যে সকল শিশুদের বাড়ি পাঠানো হইল, তাহাদের মধ্যে মৃত্যুহার কী, অপরাপর শিশুদের তুলনায় অধিক কি না, তাহারা পরবর্তী কালে যথাযথ চিকিৎসা পাইতেছে কি না, সেই বিষয়ে কোনও তথ্য কি সরকারের আছে? সেই তথ্য হইতে কি নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজনের কোনও ইঙ্গিত মিলিয়াছে?

মানবিকতার দৃষ্টিতে প্রতিটি শিশুরই সর্বাধিক উন্নত চিকিৎসা পাইবার অধিকার আছে। কিন্তু সরকারি নীতি সর্বাপেক্ষা ফলপ্রসূ পরিকল্পনাটি নির্বাচন করিবে, ইহাই প্রত্যাশিত। যাহাতে সর্বোচ্চ সংখ্যায় শিশুর উপকার হয়, তাহার উপর অধিক গুরুত্ব দিতে হইবে। সেই দৃষ্টিতে উদরাময় নিবারণ ক্রিটিক্যাল কেয়ার অপেক্ষা অধিক প্রয়োজনীয় বিবেচিত হইতে পারে। পাকিস্তানে কেন শিশুদের হৃৎপিণ্ডের অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা নাই, কেন রুহানকে ভারতে আসিতে হইল, সে প্রশ্ন সে দেশে উঠিতে পারে। কিন্তু আমাদেরও ভাবিতে হইবে, ভারতে উচ্চ-প্রযুক্তির চিকিৎসা থাকিলেও সাধারণ চিকিৎসা নাই কেন? কেন অস্বাস্থ্যের, অপুষ্টির সামাজিক কারণগুলিকে অবহেলার ফলে স্বল্প-ওজনের সন্তানের জন্ম হইবার পর, তাহাকে বাঁচাইতে অতি-ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা করা হইবে? ইহার যুক্তি নাই, সান্ত্বনাও নাই। রুহানের মৃত্যুর মতোই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE