Advertisement
E-Paper

নোট থেকে পেটিএম, এটাই তো উন্নয়ন, না পারলে চলবে?

আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে: অনেকেই পবিত্র আবেগে আক্ষেপ করছেন, সব্বাই কেন ডিজিটাল লেনদেনের অমৃতপাথারে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, কেন অনেকেই নোটের অভাব নিয়ে নালিশ করছেন! নগদের অভাবে কত ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে, কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, সে সব প্রশ্ন তুলে এই ডিজিটাল আবেগ দমন করা যাবে না। লিখছেন অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:০০

অনেকেই পবিত্র আবেগে আক্ষেপ করছেন, সব্বাই কেন ডিজিটাল লেনদেনের অমৃতপাথারে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, কেন অনেকেই নোটের অভাব নিয়ে নালিশ করছেন! নগদের অভাবে কত ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে, কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, সে সব প্রশ্ন তুলে এই ডিজিটাল আবেগ দমন করা যাবে না।

আমেরিকায় ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে একটি গবেষণার কাজে সাহায্য করতে এসেছেন দুই স্বেচ্ছাসেবী। দুজনকে দুটি ভূমিকা দেওয়া হয়েছে। এক জন ‘শিক্ষক’, অন্য জন ‘শিক্ষার্থী’। ওঁরা পরস্পর অপরিচিত। পাশাপাশি দুটি ঘরে বসানো হয়েছে দুজনকে। কেউ কাউকে দেখতে পাবেন না, কিন্তু কথা শুনতে পাবেন। শিক্ষার্থীকে একটা চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে তাঁর চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকের সঙ্গে আছেন এক জন ইনস্ট্রাক্টর বা নির্দেশক। শিক্ষকের সামনে একটি যন্ত্র, তার গায়ে সারি সারি তিরিশটা সুইচ। এক একটি সুইচে এক একটি অঙ্ক। ১৫ থেকে ৪৫০। শিক্ষক এ ঘরে যত নম্বর সুইচ টিপবেন, ও ঘরে শিক্ষার্থীর গায়ে তত ভোল্টের শক লাগবে।

তো, শুরুতে শিক্ষার্থীকে কিছুক্ষণ বেশ কয়েক জোড়া শব্দ পড়তে দেওয়া হল। বলা হল, সেগুলি জোড়ায় জোড়ায় মনে রাখতে হবে। তার পরে শুরু হল পরীক্ষা। শিক্ষক একটি শব্দ বলেন, শিক্ষার্থীকে তার জুড়ি শব্দটি বলতে হয়। ঠিক হলে পরের শব্দ, ভুল হলে শক। ভুল যত বাড়ে, শকের মাত্রা তত চড়ে। ১৫, ৩০, ৪৫... এক সময় শিক্ষার্থী জানালেন, তাঁর লাগছে! উদ্বিগ্ন শিক্ষক নির্দেশকের দিকে তাকালেন, তিনি বললেন, ‘চালিয়ে যান’। অঙ্ক যত বাড়ে, শিক্ষার্থীর যন্ত্রণা বাড়ে সেই অনুপাতে, শিক্ষকের উদ্বেগও, কিন্তু নির্দেশক নির্বিকার: ‘চালিয়ে যান।’ এক সময় শিক্ষার্থী চিৎকার করে ওঠেন, ‘ছেড়ে দিন, আর পারছি না! আমার বুকে কষ্ট হচ্ছে। আমায় এ ভাবে বেঁধে রাখার কোনও অধিকার নেই আপনাদের!’ শিক্ষক আতঙ্কিত হয়ে নির্দেশককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি পুরো দায়িত্ব নিচ্ছেন তো?’ সাদা কোট পরা নির্দেশক শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, ‘দায়িত্ব আমার। চালিয়ে যান।’ কাঁপা হাত পরের সুইচে...

না, কোনও বিপদ ঘটেনি। ঘটবেই বা কেন? সত্যি তো আর শিক্ষার্থীর শক লাগছিল না! তিনি তো আর সত্যিই শিক্ষার্থী নন। তিনি এক জন অভিনেতা, শিক্ষার্থীর ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন। এই গবেষণায় সেটাই ছিল তাঁর জন্য নির্ধারিত ভূমিকা। গবেষণাটা হচ্ছিল আসলে শিক্ষককে নিয়ে। তিনি জানতেন, সুইচ টিপলেই শক লাগছে। তাই তিনি ক্রমশ ঘাবড়ে যাচ্ছিলেন।

কিন্তু তা সত্ত্বেও শক দেওয়া বন্ধ করেননি। কেন? নির্বোধ নাকি? কিংবা দায়িত্বজ্ঞানহীন? তেমনটা বলা চলে না, কারণ এই পরীক্ষাটি কেবল তাঁকে নিয়ে করা হয়নি। এটা ছিল খুব বড় মাপের এক গবেষণা প্রকল্প। উনিশশো ষাটের দশকে গবেষণাটি করেছিলেন ইয়েল-এর মনস্তত্ত্ববিদ স্ট্যানলি মিলগ্রাম। বহু স্বেচ্ছাসেবীর ওপর এই পরীক্ষা চালান তিনি। এবং দেখা যায়, তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ, নির্দেশক যত ক্ষণ বলেছেন তত ক্ষণ সুইচ টিপে গেছেন। অনেকেই খুব উদ্বিগ্ন হয়েছেন, ভয় পেয়েছেন, বার বার জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কিছু হবে না তো?’ কিন্তু তার পর নির্দেশক যখন সুইচ টিপতে বলেছেন, সেই আদেশ পালন করেছেন। মিলগ্রামের এই কাজটি মনস্তত্ত্বের দুনিয়ায় নাম কেনে। অনেক দেশে এই মডেলে গবেষণা হয়। মোটের ওপর একই ফল মেলে— দেখা যায়, গড়পড়তা ষাট শতাংশের বেশি মানুষ সমস্ত বিপদের কথা জেনেবুঝেও নির্দেশকের কথা মতো ক্রমশ চড়া থেকে আরও চড়া শক দিয়ে চলেছেন।

এই বাধ্যতার প্রধান কারণ এক ধরনের বিশ্বাস। গবেষণা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি— সবচেয়ে বড় কথা, ‘সিস্টেম’-এর প্রতি বিশ্বাস। একটা বড় প্রকল্পে আমাকে যে ভূমিকা দেওয়া হয়েছে, সেটা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে হবে, তা যত কঠিন এবং নির্মম হোক না কেন, কারণ আমি আমার কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলে ওই প্রকল্প সার্থক হবে— এই বিশ্বাসই অধিকাংশ ‘শিক্ষক’কে অনেক দূর চালিত করেছিল, এমনকী ৪৫০ ভোল্ট পর্যন্ত। শব্দ-স্মৃতি যাচাইয়ের ব্যাপারটাও এই বিশ্বাস নির্মাণের কৌশল— শিক্ষক যাতে ভাবেন যে, গবেষণায় একটা সুচিন্তিত বৈজ্ঞানিক মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের প্রতি মানুষের সমীহ বরাবরই প্রবল।

লন্ডননিবাসী লেখক, শিল্পী এবং চলচ্চিত্র পরিচালক রাউল মার্টিনেস-এর লেখা ক্রিয়েটিং ফ্রিডম (ক্যাননগেট, ২০১৬) বইটিতে স্ট্যানলি মিলগ্রামের গবেষণার কথা পড়লাম। এবং গত দেড় মাসের ঘটনাবলির কথা নতুন করে মনে এল। নরেন্দ্র মোদী হঠাৎ এক দিন ধাঁ করে পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল করে দেওয়ার পরে দেশ জুড়ে যা চলছে, তাতে অনেকেই অবাক হয়ে একটা কথা বলেছেন, এখনও বলছেন। কোটি কোটি লোকের এমন লাগাতার যন্ত্রণা চলছে, তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তে মানুষের বিরাট কোনও আপত্তি নেই! ব্যাপারটা কী? ভারতবর্ষের মানুষ খাতা-পেনসিল নিয়ে কস্ট-বেনিফিট কষে স্থির করেছেন যে নোট বাতিলে লোকসানের চেয়ে লাভ বেশি, তাই তাঁরা সব কষ্ট মেনে নিয়ে মোদীজিকে সমর্থন করছেন— এমনটা তো মনে হয় না। তা হলে?

মিলগ্রামের গবেষণায় এ প্রশ্নের একটা সম্ভাব্য উত্তর মেলে। নোট বাতিলের ফলে লাভটা ঠিক কী, কেউ জানে না, কিন্তু এই ধারণা দেখতে দেখতে বহুলপ্রচারিত হয়েছে যে, এর ফলে ভারত একটা আধুনিক এবং উন্নত ‘ডিজিটাল’ অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ভাষায় বললে— নোট থেকে ডেবিট কার্ড, মানিব্যাগ থেকে পেটিএম, এটাই তো উন্নয়ন! উন্নয়নের এই হাতে-গরম ফর্মুলা নিয়ে কাহন কাহন তর্ক করা যায়, কিন্তু এ কথা মানতেই হবে যে, ধারণাটা বাজারে দারুণ খেয়েছে। অনেক সহনাগরিককেই পবিত্র আবেগে আক্ষেপ করতে শুনছি— সব্বাই কেন ডিজিটাল লেনদেনের অমৃতপাথারে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন না, কেন অনেকেই এখনও নোটের অভাব নিয়ে নালিশ করছেন! কাকে কতক্ষণ এটিএমের লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে, নগদের অভাবে কার জীবন যাপনে কত সমস্যা হচ্ছে, কত লোকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে আছে, কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, সে সব প্রশ্ন তুলে এই ডিজিটাল আবেগ দমন করা যাবে না। সেই আবেগ বলবে: শক লাগুক, চেয়ারে স্ট্র্যাপ-বাঁধা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মানুষ ‘আর পারছি না’ বলে আর্তনাদ করুন, সুইচটা টিপে যেতে হবে, কারণ এ এক মহান বৈজ্ঞানিক উদ্যোগ, যার শরিক হতে পেরে আমরা ধন্য।

কিন্তু এই উদ্যোগ যে সত্যিই মহান, সেটা আমরা কী করে জানলাম? রাউল মার্টিনেসের বইয়ে আর এক গবেষণার বিবরণ আছে। সেটি ড্যানিয়েল কানম্যান-এর। কানম্যান এক আশ্চর্য মানুষ। মনোবিজ্ঞানী, কিন্তু ২০০২ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পেয়েছিলেন। তাঁর অন্য বহু গবেষণার মতোই এটিও চমকপ্রদ। আমেরিকার মিশিগান প্রদেশে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব সংবাদপত্রে কয়েক সপ্তাহ ধরে দুটি ছোট ‘বিজ্ঞাপন’ বেরিয়েছিল। বিজ্ঞাপন মানে আর কিছু না, সম্পূর্ণ অচেনা পাঁচটি শব্দের একটি। কিছু শব্দ এক বার বেরোয়, অন্য কিছু শব্দ বার বার। একটি পত্রিকায় যে শব্দ বার বার বেরোয়, অন্য কাগজে সেটি এক বার। এই পর্ব শেষ হওয়ার পরে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওই শব্দগুলি একে একে দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয়, কোনটাতে ভাল কিছু বোঝায়, কোনটাতে খারাপ কিছু? ছাত্রছাত্রীরা কেউ পাঁচটা শব্দের কোনওটারই মানে জানেন না, কিন্তু দেখা গেল তাঁদের অধিকাংশের হিসেব পরিষ্কার: যাঁরা যে শব্দ বেশি দেখেছেন, তাঁরা সেগুলিকে ভাল জিনিসের নাম হিসেবে গণ্য করেন, কম দেখা শব্দ মানে খারাপ।

নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর ডিজিটাল অর্থনীতির সচিত্র বিজ্ঞাপনে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর মুখ ঢেকে গেল। এত চেনা জিনিস যখন, ভালই হবে নিশ্চয়ই। ‘আর পারছি না’ বললে চলবে কেন?

Demonetisation Paytm
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy