দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে যান। এ প্রবচন অনেকেরই শোনা। কিন্তু অপপ্রচার-চক্রে যে রবীন্দ্রনাথ ‘ব্রিটিশ-স্তাবক’ হয়ে যান, সে সত্য অনেকেরই জানা নেই। পুরনো কংগ্রেসিদের যদিও জানা উচিত ছিল। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের সেই অসত্যভাষণে নীরব মদতদাতা ছিল কংগ্রেসই। ১১৪ বছর আগের সেই অপপ্রচার এখনও ‘মিথ’ হয়ে ভেসে বেড়ায়। এখনও অনেকে তার শিকার হন। সম্প্রতি এক সাংসদও হয়েছেন। কিন্তু দল হিসাবে বিজেপি কোনও দিনই এ তত্ত্বে অনুমোদন দেয়নি যে, ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে ’ লিখেছিলেন।
১৯১১ সাল। ২৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর কলকাতায় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন। সেখানেই প্রথম বার গীত হল ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’। ২৭ ডিসেম্বর সকালে দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের যন্ত্রানুষঙ্গ আয়োজনে এবং কিশোর-কিশোরীদের কোরাসে গানটি গাওয়া হয়েছিল কংগ্রেসের অধিবেশনস্থলে। সে সময়ে ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারত সফরে ছিলেন, সে কথা ঠিক। কিন্তু গানটি তাঁর উদ্দেশে রচিত হয়নি, তাঁর স্তুতিতে গাওয়াও হয়নি।
তা হলে এমন তত্ত্বের উদ্ভব কেন হয়েছিল? হয়েছিল কংগ্রেস নেতৃত্বের সম্রাটপ্রেম এবং ব্রিটিশ প্রচারযন্ত্রের যুগলবন্দির জেরে। কংগ্রেসের অনেকে সে সময়ে চেয়েছিলেন যে, রবীন্দ্রনাথ একটি গান ব্রিটিশ সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্য লিখুন, যা কংগ্রেসের অধিবেশনে গাওয়া হবে। আশুতোষ চৌধুরী নামে এক কংগ্রেস নেতা তথা ব্যারিস্টারের মাধ্যমে সেই প্রস্তাব রবি ঠাকুরের কাছে পৌঁছোয়। প্রস্তাবে রবীন্দ্রনাথ বিরক্ত হন, কিয়ৎ হতাশও হন। কংগ্রেস অধিবেশনের জন্য গান রচনায় তাঁর আপত্তি ছিল না। কিন্তু সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্য লিখতে তিনি রাজি ছিলেন না। তাই ২৭ ডিসেম্বর দু’টি গান কংগ্রেস অধিবেশনে গাওয়া হয়। একটি সকালে, রবি ঠাকুরের লেখা ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’। একটি সন্ধ্যায়, রামভজ দত্ত চৌধ্রির ‘বাদশাহ হমারা’। গানদু’টির ভাষা খেয়াল করলেই স্পষ্ট হয়ে যায়, কোনটি সম্রাটের উদ্দেশে লেখা ছিল, এবং কোনটি তা নয়। পঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা রামভজ দত্ত চৌধ্রি ছিলেন রবি ঠাকুরের ভাগ্নি-জামাই। অর্থাৎ, সরলাদেবী চৌধুরানির স্বামী। কংগ্রেস নেতা আশুতোষ চৌধুরীর প্রস্তাবে যেহেতু রবি ঠাকুর সম্মত হননি, তাই আর এক কংগ্রেস নেতা তথা রবি ঠাকুরের বাড়ির জামাই সে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। ব্রিটিশ ‘বাদশাহ’-এর জন্য গান লিখে ফেলেন।
ঘটনাপ্রবাহ যদি এই হয়ে থাকে, তা হলে অন্য ‘মিথ’ তৈরি হল কী ভাবে? তৈরি হল ব্রিটিশের চক্রান্তে। যে দিন কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে ‘জনগণমন’ গাওয়া হল, তার পর দিন ‘দ্য স্টেটসম্যান’, ‘দ্য ইংলিশম্যান’-সহ তিনটি ইংরেজি সংবাদপত্রে লেখা হল যে, গানটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে। তিনটিই ছিল ব্রিটিশ সরকারের তাঁবেদার সংবাদপত্র। কিন্তু তিনটি খবরের কাগজ একযোগে ওই কথা লেখায় সে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায়। ভিত্তিহীন তত্ত্ব কালক্রমে ‘মিথ’ হয়ে উঠেছে এবং এখনও অস্তিত্বশীল রয়েছে ভারতীয় চর্চায়। স্বাধীন ভারতে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এই ভুল তত্ত্ব একাধিক বার আউড়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে ব্রিটিশের তৈরি করা অসত্যের শিকার।
রবীন্দ্রনাথ নিজেও একাধিক বার এই ভুল শুধরে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৩৭ সালের ২০ নভেম্বর ‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় এবং ১৯৩৯ সালের ২৯ মার্চ ‘পূর্বাশা’ পত্রিকায় রবি ঠাকুর এই বিষয়ে কলম ধরেছিলেন। বলা ভাল, তিনি এ নিয়ে লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সে সব নিবন্ধে এই ভ্রান্ত প্রচারের বিষয়ে নিজের বিরক্তি, ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। বিভ্রান্তিমূলক চর্চায় তিনি অপমানিত বোধ করছেন বলে লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘কোনও পঞ্চম বা ষষ্ঠ জর্জের জন্য আমি এই গান লিখিনি’। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে যে সব মহামানব ভারতকে পথ দেখিয়েছেন, তাঁদের উদ্দেশেই যে ওই গান, তা রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্পষ্ট করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তার পরেও এই প্রচারটা রয়ে গিয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে আমি নিজেই আমার এক রাজনৈতিক সতীর্থকে এই অসত্যের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম। তখন আমি দলের যুবশাখায়। এক সর্বভারতীয় কর্মসূচিতে ‘জনগণমন’ এবং পঞ্চম জর্জের ভারত সফরের সংযোগ সংক্রান্ত ‘মিথ’ উচ্চারিত হতে শুনলাম। সেই মঞ্চেই আমি বক্তার ভুল শুধরে দিয়েছিলাম। সেখানে তখন লালকৃষ্ণ আডবাণীও উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু কেউ কেউ এখনও সে ভুল করেই চলেছেন।
সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়ের লেখা একটি প্রণিধানযোগ্য প্রবন্ধেও এই সংক্রান্ত আসল তথ্য মিলবে। অনেক প্রামাণ্য নথির উপরে দাঁড়িয়ে সে প্রবন্ধ রচিত। ‘জাতীয় সঙ্গীতের উৎস সন্ধানে’ নামে আরও একটি বইয়ে এ সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়। সংশয় থাকলে সে সব রচনা পড়ে দেখা যেতে পারে।
আসল ঘটনা আরও একবার সহজ কথায় বলি। ১৯১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কংগ্রেস অধিবেশনে গাওয়া ‘বাদশাহ হমারা’ ছিল পঞ্চম জর্জের উদ্দেশে গাওয়া। কিন্তু একই দিনে ও একই স্থানে সকালে গাওয়া ‘জনগণমন’-র সঙ্গে দূরদূরান্ত পর্যন্ত পঞ্চম জর্জের কোনও সম্পর্ক ছিল না। আর্যদের ভারত আক্রমণ তত্ত্ব যেমন এক অপ্রামাণ্য ‘মিথ’, পঞ্চম জর্জের জন্য রবীন্দ্রনাথের গান লেখাও তেমনই। এই ‘মিথে’র সংক্রমণে অনেকে আক্রান্ত। তবে আমরা দল হিসাবে এই তত্ত্বকে অনুমোদন করি না। এটা আমাদের দলের এজেন্ডাও নয়।
যাঁরা এক বিজেপি সাংসদের ব্যক্তিগত মতামত নিয়ে এখন বেশি সরব, তাঁরা দলগত ভাবে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কী ঘটিয়েছিলেন, সে কথা কি মনে পড়ে?
জালিয়ানওয়ালাবাগে ভয়াবহ হত্যালীলার খবর পাওয়ার পরে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন মোহনদাস গান্ধীকে সঙ্গে নিয়ে পঞ্জাব যেতে। দূত মারফত খবরও পাঠিয়েছিলেন। গান্ধীজি কোনও ইতিবাচক সাড়া দেননি। তখন চিত্তরঞ্জন দাশকে রবীন্দ্রনাথ অনুরোধ করেছিলেন, কলকাতায় একটি প্রতিবাদ সভার আয়োজন করতে। রবীন্দ্রনাথের কাছে চিত্তরঞ্জন জানতে চেয়েছিলেন, তিনি ওই সভায় সভাপতিত্ব করতে রাজি কি না। রবীন্দ্রনাথ সম্মতি দেন। পরে আবার প্রশ্ন যায়, তিনি ওই সভায় মূল বক্তা হতে রাজি কি না। রবীন্দ্রনাথ তাতেও সম্মতি দেন। তখন চিত্তরঞ্জন পরামর্শ দেন, সভাটির আয়োজন রবীন্দ্রনাথ নিজে করলেই ভাল হবে। বিরক্ত রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে আর কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। ‘নাইটহুড’ ত্যাগ করে নিজের প্রতিবাদকে ভাষা দিয়েছিলেন।
(লেখক রাজ্যসভার সাংসদ এবং বিজেপির রাজ্য সভাপতি। মতামত নিজস্ব)