আমরা যখন কিছু দেখি, চোখ দিয়ে দেখি। কিন্তু সেটা ভাল লাগছে কি না তা বিচার করে মন। যে কোনও দৃশ্যমান বা চাক্ষুষ বস্তু আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক না কি অস্বস্তিদায়ক তা নিয়ে মস্তিষ্কের ভিতর কোটি কোটি নিউরনের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, হয়তো উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময়ও চলে। তার পর তারা একটা সিদ্ধান্ত নেয় যে ওই নির্দিষ্ট দৃশ্যটি ওই নির্দিষ্ট মানুষটির কাছে শান্তির, না কি অস্বস্তির। প্রতিটি মানুষের নিরিখে এই স্বস্তি-সূচকের মাত্রা ভিন্নতর। দেখার পর বিচার করা এবং তা থেকে সিদ্ধান্তে আসার পুরো ঘটনাটি ঘটতে সময় লাগে হয়তো এক মিলিসেকেন্ড। আর এখানেই লুকিয়ে আছে জীবিত বা জড়, পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর দৃশ্যগ্রাহ্য প্রভাবের জটিল বিজ্ঞান, যার অবিচ্ছেদ্য অংশ দৃশ্যকলা বা ভিস্যুয়াল আর্ট। আমাদের চোখের সামনে কোনও একটি আদল নিয়ে যা ধরা দেয় তা-ই দৃশ্যকলা। আর্ট কলেজের বাঁধাধরা সিলেবাসের বাইরে গিয়ে ভাবলে দেখা যাবে, মানুষের জীবনে এর এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে।
শিল্প ও বিজ্ঞান দুই ভিন্ন সংস্কৃতির বিষয় নয়, বরং তারা যে জন্মলগ্ন থেকে একই সূত্রে গাঁথা এবং পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যে প্রতিনিয়ত এর দ্বারা কোনও না কোনও ভাবে উপকৃত হচ্ছে, এই বিষয়টি নিয়ে নোবেলজয়ী স্নায়ুবিজ্ঞানী এরিক কান্ডেল লেখেন তাঁর রিডাকশনিজ়ম ইন আর্ট অ্যান্ড ব্রেন সায়েন্স: ব্রিজিং দ্য টু কালচারস বইটি, ২০১৬-তে যা প্রকাশিত হয়। সেখানে তিনি শিল্প ও বিজ্ঞানকে বিচ্ছিন্ন করার বিরোধিতা করেছেন। মানবমস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ চেনা বা অচেনা— শিল্পের ভাষায় বলা যেতে পারে মূর্ত বা বিমূর্ত— নানা দৃশ্যপটের সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন ভাবে আন্দোলিত হয়। চেনা বা মূর্ত দৃশ্যাবলি আমাদের স্বস্তি দেয় কারণ আমরা বেশির ভাগ সময় শুধুই দেখি, যাকে বলে দেখার অভ্যাস। সেই অভ্যাসকে ওই দৃশ্যাবলি কোনও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয় না। ফলে চোখের সঙ্গে সঙ্গে মনের আরাম, আমরাও নিশ্চিন্ত। কিন্তু যখনই সেই চেনা দেখার অভ্যাস ধাক্কা খায় কোনও এক অচেনা বা বিমূর্ত আকার বা রঙের ব্যবহারে, আমাদের মস্তিষ্ক তার অস্বস্তি জানান দেয়। মানবমস্তিষ্ক যা দেখে, তার মধ্যে সহজাত ভাবেই স্বীকৃত নিদর্শন ও অর্থ খোঁজে। বিমূর্ত দৃশ্যাবলি এই প্রবণতাকে চ্যালেঞ্জ করে, দর্শকদের অস্পষ্টতার মধ্যে অর্থ খুঁজে বার করতে বাধ্য করে।
এখানেই বাধে গোল। নতুনতর কিছু গ্রহণে আমাদের স্নায়ু যে কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় বেশ বোঝা যায়। স্নায়ুবিজ্ঞান গবেষণায় দেখা গেছে, বিমূর্ত শিল্প সক্রিয় করে মস্তিষ্কের একাধিক অঞ্চলকে, যা সাধারণ ভাবে অন্য সময় নিষ্ক্রিয় থাকে। এই সক্রিয়তা ওই শিল্পকর্ম এবং মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের নীরব সংলাপের জন্ম দেয় এবং অজানতেই সেই নীরব সংলাপ আমাদের চেতনার উৎসমূলে প্রবেশ করে। কান্ডেল বলছেন, “যে কোনও ধরনের বিমূর্ত দৃশ্যপট শিল্পী এবং শিল্পানুরাগীদের কাছে অনুপ্রেরণা, সৃষ্টিশীলতা এবং আবেগের উৎস হওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।”
স্নায়ুবিজ্ঞানীদের গবেষণায় উঠে এসেছে আর এক চমকপ্রদ তথ্য। আমাদের দেখা শিল্পকর্মে যে বিভিন্ন রকমারি তুলির টান বা ব্রাশ-স্ট্রোক দেখা যায়, ব্রেনের মধ্যে থাকা মিরর নিউরন নামে এক প্রকার কোষ তা অবচেতনে অনুকরণ করতে থাকে। ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট’ বা বিমূর্ত ছবিতে অচেনা ছন্দের তুলির টান বেশি থাকার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই অবচেতনে অনুকরণের মাত্রা বেশি হয়ে থাকে। এখানেই ঘটে যায় ম্যাজিক। প্রতি দিনের দেখার অভ্যাসমাফিক সেই চেনা আদলের মানুষ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, আসবাবপত্র, গাছপালা, মেঘ-বৃষ্টি, পশুপাখি সমেত জটিল দৃশ্যজগৎ বদলে যায় সহজতর রূপ, রেখা, রং এবং আলোর সারাংশে। বিমূর্ত আকার, দৃশ্যপট বা রঙের প্রভাব মানুষের মনে অবচেতন বা অচেতনে বার বার ফিরে আসে ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নের আদলে। যা আমাদের মস্তিষ্কের পুষ্টি জোগায়, মানসিক ভারসাম্যের অভাব দূর করে। এখনকার জটিল সামাজিক প্রেক্ষিতে ‘আর্ট থেরাপি’র ক্ষেত্রে এই বিমূর্ত শিল্পের ব্যবহারিক প্রয়োগ খুব জরুরি।
ঠিক বিপরীত দিক থেকে ভাবনা শুরু হয় শিল্পীদের। রিয়ালিস্টিক বা মূর্ত ছবির পথ পেরিয়ে কোনও শিল্পী যখন ক্যানভাসে অচেনা ছন্দের তুলির টান দিতে শুরু করেন, তখনই শুরু হয় সেই ম্যাজিক। সাধারণ মনস্তত্ত্বে যা ঘটে অবচেতনে, শিল্পীমনে তা ঘটে চেতনে। বিমূর্ত ছবির কালজয়ী শিল্পী হিলমা আফ ক্লিন্ট (জন্ম ১৮৬২), ওয়াসিলি ক্যান্ডিনস্কি (১৮৬৬), পিট মন্ড্রিয়ান (১৮৭২), মার্ক রথকো (১৯০৩), উইলেম ডি কুনিং (১৯০৪), অ্যাগনেস মার্টিন (১৯১২), জ্যাকসন পোলক (১৯১২) প্রমুখের ছবি নিয়ে গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এমন বহু তথ্য পেয়েছেন যা বিমূর্ত শিল্পের সঙ্গে মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বের গভীর সম্পর্কের পথ নির্দেশ করে। জ্যাকসন পোলক নিজের অতিরিক্ত পানাসক্তি থেকে মুক্তি পেতে তখনকার প্রখ্যাত সুইস মনস্তত্ত্ববিদ কার্ল ইয়ুং প্রবর্তিত ইয়ুঙ্গিয়ান সাইকোথেরাপি-র শরণাপন্ন হন। প্রায় দু’বছর চলে তাঁর এই চিকিৎসা। এই সময় পোলক প্রায় তিরাশিটি ছবি আঁকেন যা কিনা ওই সাইকোথেরাপির ফসল বলেই মনে করা হয়। তার পর বেশ অনেক বছর তিনি পানাসক্তি থেকে দূরে থাকেন। আমেরিকার বোস্টন কলেজের শিল্প-ইতিহাসের অধ্যাপক ক্লদ সারনুশি এই সব ছবি সম্বলিত জ্যাকসন পোলক: দ্য সাইকোঅ্যানালিটিক ড্রয়িংস নামে একটি বই লেখেন যেটি প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। ওয়াসিলি ক্যান্ডিনস্কি বলেছিলেন যে তিনি শব্দ ‘দেখতে’ পান এবং রং ‘শুনতে’ পান। ছোটবেলায় ছবি আঁকতে গিয়ে প্যালেটে রং তৈরি করার সময় তিনি সাপের মতো হিসহিস শব্দ শুনতে পেতেন। তিনি বৈজ্ঞানিক ভাবে তাঁর ছবির মাধ্যমে গবেষণা করেছিলেন যে রং, আকৃতি এবং বস্তুর অবস্থান কী ভাবে মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন-এর নিউরোবায়োলজিস্ট সেমির জ়েকি বলেছেন, “ছবি আঁকার মাধ্যমে সমস্ত মহান শিল্পী প্রমাণ করেছেন যে তাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের অজানতেই এক-এক জন নিউরোলজিস্ট। মূর্ত-বিমূর্ত দৃশ্যাবলির সঙ্গে মানুষের মনস্তত্ত্বের সম্পর্কের যে বিজ্ঞান বহু গবেষণায় আবিষ্কৃত হয়েছে, শিল্পীরা তাঁদের ছবির মাধ্যমে আগেই তা বলে গেছেন। বিজ্ঞান শুধু তাতে সিলমোহর দিয়েছে।”
তবে মূর্ত বা বিমূর্ত আকার বা আদলের দৃশ্যগ্রাহ্য প্রভাব মাঝেমধ্যেই চেতন আর অবচেতনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি করে— যা ঘটেছিল শিল্পী হিলমা আফ ক্লিন্টের মনে। নিজের ছবি নিয়ে এতটাই দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন যে তাঁর মনে হয়েছিল, অবচেতনের ডাকে সাড়া দিয়ে যে শিল্পসৃষ্টি তিনি করে চলেছেন সেই সময়ে তা দর্শক প্রত্যাখ্যান করবে। সারা জীবনে প্রায় কোনও প্রদর্শনী করেননি। মৃত্যুর আগে উইল করে তাঁর সমস্ত বিমূর্ত চিত্রাবলি ভাইপো, রয়াল সুইডিশ নৌবাহিনীর ভাইস-অ্যাডমিরাল এরিক আফ ক্লিন্টকে দিয়ে যান। উইলে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রয়াণের পর কমপক্ষে কুড়ি বছর এই সমস্ত চিত্রকর্ম যেন জনসমক্ষে আনা না হয়। এর ফলে ইউরোপে শিল্পে বিমূর্ততার পথিকৃৎদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হত না। ১৯৪৪ সালে হিলমা আফ ক্লিন্ট প্রয়াত হওয়ার কুড়ি বছর পর, ষাটের দশকের শেষে সেই সব ছবি সাধারণ্যে হাজির করা হয়। আজ ক্লিন্টের ছবি স্নায়ুবিজ্ঞানীদের কাছে গবেষণার বিষয়।
এখানে এক অদ্ভুত সমাপতন। হিলমা আফ ক্লিন্টের ঠিক এক বছর আগে, ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম, প্রয়াণও তাঁর তিন বছর আগে ১৯৪১ সালে। তেষট্টি বছর বয়সে ছবি আঁকা শুরু করে তিনিও গহন মনের অন্তরালে ডুবে পাড়ি দেন অবচেতনে। শব্দ কেটে কারিকুরি করতে করতে এক অদ্ভুত অন্তর্মুখী বিমূর্তযাত্রা শুরু করেন, যা একান্তই আমাদের ভারতীয় ভাবনা, ঔপনিষদিক ভাবধারায় সম্পৃক্ত। একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নির্মলকুমারী মহলানবিশকে লিখছেন, “এর আগে আমার মন আকাশে কান পেতে ছিল। বাতাস থেকে সুর আসত, কথা শুনতে পেত। আজকাল সে আছে চোখ মেলে রূপের রাজ্যে রেখার ভিড়ের মধ্যে। গাছপালার দিকে তাকাই তাদের দেখতে পাই। স্পষ্ট বুঝতে পারি জগৎটা আকারের মহাযাত্রা। আমার কলমেও আসতে চায় সেই আকারের লীলা।” সেই আকারের লীলাখেলা ভারতীয় চিত্রকলায় প্রথম বিমূর্ত প্রাণের পরশ। যা সেই সময় বহু নিন্দুকের কাছে কবির ‘বুড়ো বয়সের ভীমরতি’স্বরূপ ছিল। রবীন্দ্রনাথও বুঝেছিলেন, তাঁর অবচেতন থেকে উঠে আসা ওই সব ছবি এখানেও মানুষের বোধের বাইরে থাকবে। তাঁর প্রথম প্রদর্শনী দেশে নয়, ১৯৩০ সালে প্যারিসের পিগেল আর্ট গ্যালারিতে করতে মনস্থ করেন। রবীন্দ্র-চিত্রকলার অন্তর্মুখী আবেগ আজ মনোবিজ্ঞানীদের কাছেও চর্চার বিষয়।
বিমূর্ত শিল্প একটি দৃশ্যমান অভিজ্ঞতার চেয়েও আরও অনেক বেশি কিছু ধারণ করে আছে— যাকে শুধু শিল্পকলার পরিধিতে রুদ্ধ করে না রেখে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে আখেরে লাভই হবে। তাই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের সঙ্গে মনোবিদ এবং সাধারণ মানুষের যুক্ত হওয়া খুব প্রয়োজন। তবে যে সামাজিক পরিকাঠামো আর শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা বাস করি, তাতে সমষ্টিগত ভাবে শিল্পের প্রতি ভালবাসা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)