E-Paper

রাজনৈতিক মিথোজীবিতা

মোহন ভাগবতের ৭৫তম জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদী এ বার দাবার ছকটাই ঘুরিয়ে দিলেন।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৮:২৪

মহারাষ্ট্রের সাঙ্গলীতে পটবর্ধন রাজাদের রাজত্ব ছিল। এখনও সেখানে তাঁদের রাজপ্রাসাদ দেখা যায়। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার এক বার সেখানে গিয়েছিলেন। তাঁকে রাজপরিবারের মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হল। হেডগেওয়ার দেখলেন, মন্দিরের দেওয়ালে বিরাট তৈলচিত্র। তাতে ভগবান শিব ছত্রপতি শিবাজি হিসেবে জন্ম নিচ্ছেন। হেডগেওয়ার রাজপরিবারের সদস্যদের বললেন, মানুষকে এই ঈশ্বরের অবতার রূপে দেখানোর ফলে সমাজের ক্ষতি হচ্ছে। মানুষকে ভগবান বানানোর কী প্রয়োজন?

আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা মনে করতেন, হিন্দু সমাজ সর্বদা বড় রাষ্ট্রনেতাকে ভগবান বানাতে চায়। এই ব্যক্তিপুজোতে তাঁর ঘোর আপত্তি ছিল। হেডগেওয়ারের এই নীতি মেনে গত একশো বছরে আরএসএস-এর সব সরসঙ্ঘচালকই বার্তা দিয়ে এসেছেন, তাঁরা সঙ্ঘ পরিবারের প্রধান হতে পারেন, কিন্তু কোনও ব্যক্তিই সংগঠনের থেকে বড় নন।

আরএসএস-এর এই ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই বিজেপি গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে দল ও সরকারের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী নিজেকে কখনও ‘নন-বায়োলজিক্যাল’, কখনও আবার ‘ঈশ্বরপ্রেরিত’ বলে দাবি করেছেন। অনুগামীরা তাঁকে বসিয়েছে ‘বিশ্বগুরু’র আসনে। আরএসএস-এর মতাদর্শের সঙ্গে তা কোনও দিনই খাপ খায়নি। অথচ, নরেন্দ্র মোদীর প্রবল জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতার দাপটের সামনে ও-সব প্রশ্ন তোলার সাহস পায়নি।

মোহন ভাগবতের ৭৫তম জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদী এ বার দাবার ছকটাই ঘুরিয়ে দিলেন। আরএসএস-এর বর্তমান সরসঙ্ঘচালকের বন্দনা করে তাঁকে কার্যত সংগঠনের ঊর্ধ্বে বসিয়ে দিলেন। আরএসএস-এর ব্যক্তিপুজোর বিরোধিতাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী মোহন ভাগবতকে নিয়ে কলম ধরলেন। লিখলেন, সঙ্ঘের গত একশো বছরের যাত্রায় মোহন ভাগবতের জমানায় সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে। স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার দিনেই যে মোহন ভাগবতের জন্মদিন, তা মনে করালেন। মোহন ভাগবতকে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’-এর মন্ত্রে সামাজিক ঐক্যকে মজবুত করার কাজে নিয়োজিত পরশমণি হিসেবে আখ্যা দিলেন। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার আজকের সরসঙ্ঘচালকের এমন ব্যক্তিপুজো দেখলে কী বলতেন?

বলা বাহুল্য, নরেন্দ্র মোদী ও মোহন ভাগবত নিজেদের সম্পর্কের এক নতুন অধ্যায় শুরু করার চেষ্টা করছেন। গত লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে বিজেপি ও আরএসএস-এর মধ্যে ক্ষমতার সংঘাত শুরু হয়েছে। এ হল তাতে ইতি টানার চেষ্টা। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ নিজেদের পছন্দের কাউকে গত এক বছর ধরে বিজেপির সভাপতির আসনে বসাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০২৪-এর জানুয়ারিতে বিজেপি সভাপতি পদে জে পি নড্ডার মেয়াদ ফুরোলেও তাঁর উত্তরসূরি নিয়ে বিজেপি-আরএসএস’এর ঐকমত্য হয়নি। মোদী-শাহকে এমন অসহায় অবস্থায় আর কখনও দেখা যায়নি। গত এক দশক মোদীর দাপটে কোণঠাসা হয়ে থাকা আরএসএস ফের বিজেপিতে ছড়ি ঘোরাতে চাইছে। কারণ, গত লোকসভা নির্বাচনে ‘চারশো পার’-এর লক্ষ্য নিয়ে দু’শো চল্লিশে থেমে যাওয়ার পরে নরেন্দ্র মোদীর ধার, ভার ও দাপট, তিনটিই কমেছে। সঙ্ঘও নতুন করে নিজের গুরুত্ব বোঝানোর সুযোগ পেয়েছে। নিজেকে ‘প্রধান সেবক’ বলে দাবি করা নরেন্দ্র মোদীকে বার্তা দিয়ে ভাগবত বলেছেন, সেবকের অহঙ্কার শোভা পায় না।

সম্পর্কের এই নতুন সমীকরণ মেনে, নরেন্দ্র মোদীর মুখে ব্যক্তি মোহন ভাগবতের প্রশংসা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ১১ সেপ্টেম্বর ভাগবত পঁচাত্তরে পা দেওয়ার ঠিক ছ’দিন পরে নরেন্দ্র মোদী নিজে ১৭ সেপ্টেম্বর পঁচাত্তরে পা দিয়েছেন। মোদীকে স্বস্তি দিয়ে ভাগবত দিল্লিতে বসে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি কোনও দিনই কাউকে পঁচাত্তর বছর হলেই অবসর নিতে বলেননি। যদিও নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেই পঁচাত্তরকে অলিখিত অবসরের বয়স স্থির করে এর আগে লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশীদের ‘মার্গদর্শকমণ্ডলী’তে (পড়ুন বানপ্রস্থে) পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গত ১১ জুলাই ভাগবত নিজেই বলেছিলেন, পঁচাত্তরে পা দেওয়ার অর্থই হল, অবসরের সময় এসে গিয়েছে। সেই মোহন-বাণী নরেন্দ্র মোদীর কপালে ভাঁজ ফেলার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। নতুন প্রজন্মের হাতে দায়িত্বের হাতবদলের মোড়কে মোহন ভাগবত কী ভাবে আডবাণীকে বানপ্রস্থে পাঠিয়ে তাঁর হাতে বিজেপির নেতৃত্ব তুলে দিয়েছিলেন, তা মোদীর থেকে ভাল কেউ জানেন না। দেরি না করে ১৫ অগস্ট লাল কেল্লার প্রাচীর থেকে নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর গত একশো বছর ধরে ব্যক্তিনির্মাণ ও রাষ্ট্রনির্মাণে ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। অথচ, গত এক দশকে নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-এর গুণাগুণ সম্পর্কে একটি বাক্যও ব্যয় করেননি। নাগপুরে আরএসএস-এর সদর দফতরে যাননি। সেই মোদীই এখন আরএসএস-এর শরণাপন্ন। গত মার্চে তিনি নাগপুরে গিয়ে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার, মাধবরাও গোলওয়ালকরদের স্মৃতিমন্দিরে মাথা নত করে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন।

‘রাজনৈতিক মিথোজীবিতা’ হয়তো একেই বলে। একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে বসবাস। একে অপরের থেকে উপকৃত হওয়া। প্রথম জন দ্বিতীয় জনের মহিমা বর্ণনা করবেন। দ্বিতীয় জন প্রথম জনকে গ্যারান্টির মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও সিংহাসনে বসিয়ে রাখবেন। নরেন্দ্র মোদী গত ১১ সেপ্টেম্বর মোহন ভাগবতের ৭৫তম জন্মদিনে তাঁকে কার্যত শ্রেষ্ঠ সরসঙ্ঘচালকের আসনে বসানোর ছ’দিন পরে বুধবার দিনভর নরেন্দ্র মোদীর ৭৫তম জন্মদিন ঘিরে তাঁর গুণকীর্তন করা হল। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিমহিমার প্রচার করে পুরনো জেল্লা ফেরানোর আয়োজনে ত্রুটি থাকল না। আরএসএস-ও আপত্তি তুলল না। হয়তো আগামী বিজয়াদশমীতে নাগপুরে আরএসএস-এর শতবর্ষের অনুষ্ঠানেও নরেন্দ্র মোদীকে দেখা যাবে।

বিজেপি ও আরএসএস-এর সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি হবে অথচ তাতে হিন্দুত্বের উপাদান থাকবে না, তা কি হয়! হিন্দুত্বের স্বঘোষিত ধারক ও বাহক আরএসএস এ বার কাশী-মথুরা নিয়ে আন্দোলনের সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। অযোধ্যায় রাম মন্দিরের শিলান্যাসে নরেন্দ্র মোদীর পাশেই ছিলেন মোহন ভাগবত। রামমন্দির আন্দোলনের পুরোধা আরএসএস-এর এত দিনের অবস্থান ছিল, কাশী-মথুরায় মসজিদের স্থানে মন্দিরের দাবির আন্দোলনে সঙ্ঘ যোগ দেবে না। মোহন ভাগবত এ বার বলছেন, হিন্দু মননে কাশী, মথুরা ও অযোধ্যা তিনটিরই মাহাত্ম্য রয়েছে। সঙ্ঘ সেই আন্দোলনে যোগ না দিলেও স্বয়ংসেবকরা তাতে যোগ দিতেই পারেন। দেশের উপাসনাস্থল আইন অনুযায়ী কোনও মন্দির, মসজিদ, গির্জার চরিত্র বদল করা যায় না। কিন্তু ভাগবত তার পরোয়া করছেন না। তিনি মুসলিম সমাজকে ‘ভাইচারা’-র দোহাই দিয়ে কাশী-মথুরার দাবি ছেড়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। স্বাভাবিক নিয়মেই বিরোধীরা এই ‘সঙ্ঘ থাকবে না, অথচ সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা থাকবেন’ নীতিকে সুবিধাবাদী দ্বিচারিতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

সঙ্ঘের ইতিহাস বলে, সরসঙ্ঘচালকদের মধ্যে বালাসাহেব দেওরস মনে করতেন, নিজেকে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বলে দাবি করলেও প্রয়োজনে আরএসএস-এর রাজনৈতিক আঙিনায় কাজ করতে দ্বিধা করা উচিত নয়। মোহন ভাগবতের ভাবনাও তার কাছাকাছি বলেই সঙ্ঘ পরিবারের প্রবীণদের মত। মোহন ভাগবতের ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিষ্ক জানে, সঙ্ঘের মাহাত্ম্য বজায় রাখতে হলে উগ্র হিন্দুত্বের যজ্ঞের আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়ে চলতে হবে। অযোধ্যায় রামমন্দির হয়ে গিয়েছে বলে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। সেই হিন্দুত্বের ধুনুচি-নৃত্যে মোদী সরকারেরও লাভ। কারণ, তার ধোঁয়ায় সরকারের যাবতীয় ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে যায়। বিজেপি এখনও কাশী-মথুরা আন্দোলন নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। অতীতে রামমন্দির আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সঙ্ঘ প্রথমে সক্রিয় হয়েছিল। পরে বিজেপি মাঠে নামে। কাশী-মথুরার ক্ষেত্রেও হয়তো তা-ই হবে।

তাৎপর্যপূর্ণ হল, কাশী ও মথুরা দুই-ই উত্তরপ্রদেশে। নতুন করে কাশী-মথুরার মন্দিরের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে তাতে উত্তরপ্রদেশের গেরুয়াধারী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ রাজনৈতিক ভাবে লাভবান হবেন সবচেয়ে বেশি। মোহন ভাগবত এখন পঁচাত্তরে বাধ্যতামূলক অবসরের কথা বলছেন না। কিন্তু আরএসএস কি সুকৌশলে নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক উত্তরসূরির উত্থানের মঞ্চ তৈরি করে দিচ্ছে? মোহন ভাগবত কি আরও এক বার বিজেপিতে প্রবীণ থেকে নবীন প্রজন্মে দায়িত্ব হাতবদলের ঘুঁটি সাজিয়ে রাখছেন?

আশা করা যায়, সময়ের সঙ্গে পঁচাত্তরে পা দেওয়া মোদী ও ভাগবতের সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের পাতা উল্টোতে থাকলে এর উত্তর মিলবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Narendra Modi Mohan Bhagwat

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy