Advertisement
০৩ মে ২০২৪
কখনও সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত ভারত গড়ার চেষ্টা করেননি প্রধানমন্ত্রী
BJP

এক ভুলে যাওয়া শপথ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে সঙ্কল্প করেছিলেন। গোটা দেশকে শপথ নিতে বলেছিলেন। ‘নতুন ভারত’-এর শপথ।

বেফাঁস: বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ। মুম্বই, ৬ জুন। রয়টার্স

বেফাঁস: বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ। মুম্বই, ৬ জুন। রয়টার্স

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২২ ০৫:১১
Share: Save:

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজে সঙ্কল্প করেছিলেন। গোটা দেশকে শপথ নিতে বলেছিলেন। ‘নতুন ভারত’-এর শপথ। যে ‘নতুন ভারত’ ২০২২-এর মধ্যে দারিদ্র, ধুলো, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, জাতপাত থেকে মুক্ত হবে। আরও একটা বিষয় থেকে ভারতকে মুক্ত করার শপথ নেওয়া হয়েছিল— সাম্প্রদায়িকতা।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়— মাত্র পাঁচ বছর। ২০১৭ সালের ৯ অগস্ট মোদী সরকার বড় বড় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল— স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছর ২০২২ সালে আধ ডজন সমস্যা থেকে ভারতকে মুক্ত করার সঙ্কল্প। নরেন্দ্র মোদী নিজে সকালবেলা টুইট করে বলেছিলেন, “চলুন আমরা ২০২২-এর মধ্যে ভারতকে দারিদ্র, ধুলো, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, জাতপাত, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত করে আমাদের স্বপ্নের নতুন ভারত তৈরি করি।”

ভেবেচিন্তেই এই সঙ্কল্প করার জন্য ২০১৭-র ৯ অগস্ট বেছে নেওয়া হয়েছিল। কারণ দিনটা ছিল ‘অগস্ট ক্রান্তি’ আন্দোলনের ৭৫তম বর্ষপূর্তি। সে দিন প্রধানমন্ত্রী লোকসভায় দীর্ঘ বক্তৃতা করেছিলেন। বলেছিলেন, বিয়াল্লিশে ‘করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে’-র ডাক দেওয়া হয়েছিল। আজ ‘করেঙ্গে অউর কর কে রহেঙ্গে’ বলার দিন। ২০১৭ থেকে ২০২২— এই পাঁচ বছর ‘সঙ্কল্প থেকে সিদ্ধি’-র সময়।

শুধু মুখেই সঙ্কল্প নয়। সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য রীতিমতো নীল নকশা তৈরি করেছিল নীতি আয়োগ। প্রয়াত অরুণ জেটলি— তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী— সেই নথি প্রকাশ করেছিলেন। নীতি আয়োগের কর্তাব্যক্তিরা ও-নিয়ে আর বিশেষ কথাবার্তা বলেন না। ভুলে গিয়েছেন কি না, জানা নেই। তবে নীতি আয়োগের পোর্টালে খুঁজলে এখনও ‘নিউ ইন্ডিয়া@৭৫’ নামের নথিটি পাওয়া যায়।

পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। স্বাধীনতার ৭৫তম বছর, ‘আজ়াদি কা অমৃত মহোৎসব’ উদ্‌যাপন শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে মোদী সরকারের অষ্টম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সরকারের কাজের ডঙ্কা বাজিয়ে প্রচার চলছে। তারই মধ্যে বিজেপির মুখপাত্রদের সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্যের জন্য গোটা বিশ্বে ভারত সরকারকে সাফাই দিতে হচ্ছে— বলতে হচ্ছে যে, পয়গম্বর সম্পর্কে বিজেপির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নেতানেত্রীদের মন্তব্য ভারত সরকারের মন্তব্য নয়। প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশকে শপথ নিতে বললেও, বিজেপির নেতানেত্রীরাই বোধ হয় সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত ভারতের শপথ নিতে ভুলে গিয়েছিলেন। উল্টে বিজেপি সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক মন্তব্যকেই প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছে! বিজেপির যে নেতা শাহিন বাগে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের ‘গোলি মারো’ বলে উস্কানি দিয়েছিলেন, তাঁরই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পদোন্নতি হয়েছে। এখন পয়গম্বর সম্পর্কে কটু কথা বললেও বিজেপির জাতীয় মুখপাত্রকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। শুধুমাত্র সাসপেন্ড করা হয়েছে।

স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এখন নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। ২০৪৭-এ, স্বাধীনতার ১০০তম বছরে এক নতুন ভারতের স্বপ্ন। এ বার আর পাঁচ বছরের রূপরেখা নয়— একেবারে পঁচিশ বছর, ‘অমৃতকাল’ জুড়ে কাজকর্মের পরিকল্পনা। পাঁচ বছর আগে কী সঙ্কল্প নেওয়া হয়েছিল, তা এখন কারও মনে নেই। পঁচিশ বছর পরে আর আজকের কথা কে মনে রাখবে! প্রধানমন্ত্রী নিজেই হয়তো তাঁর পাঁচ বছর আগের ‘সঙ্কল্প’-এর কথা ভুলে গিয়েছেন। বা তিনি ধরে নিয়েছেন, দেশের মানুষ তাঁর সঙ্কল্পের কথা ভুলে গিয়েছে। তা ছাড়া পাঁচ বছরে ভারত দারিদ্র ও ধুলোমুক্ত হয়ে যাবে, এমন দিবাস্বপ্ন কে-ই বা দেখেছিল!

কেউ বলতে পারেন, যে কোনও সরকারের মতোই মোদী সরকারও যে দেশকে দারিদ্র, দূষণ বা দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু পেরেছে কি? তাঁর সরকারের আট বছরের কাজের রিপোর্ট কার্ড তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী গত সপ্তাহেই বলেছেন, গোটা বিশ্ব স্বীকার করে যে, ভারতে দারিদ্র কমেছে। গোটা বিশ্বে কে স্বীকার করল, কে করল না— সে সমীক্ষা করা মুশকিল, তিনি জানেন। তবে প্রধানমন্ত্রী নিজে যে নীতি আয়োগের অধ্যক্ষ, সেই প্রতিষ্ঠান ছয় মাস আগেই বলে ফেলেছিল, বহুমাত্রিক সূচকে দেশের ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ এখনও দরিদ্র। এই বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচকে ভারত ১০৯টি দেশের মধ্যে ৬৬তম স্থানে। তা ছাড়া মোদী সরকার নিজেই তো ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে ৮০ কোটি গরিব মানুষকে বিনামূল্যে রেশন বিলি করেছে বলে ঢাক পেটাচ্ছে। কিন্তু কোপ গিয়ে পড়েছে নীতি আয়োগের উপাধ্যক্ষের উপরে। ২৫ শতাংশের বেশি গরিব বলে ফেলার পরে নানা সাফাই দিয়েও তিনি নিজের গদিটি বাঁচাতে পারেননি।

দূষণমুক্ত ভারতের স্বপ্ন? প্রধানমন্ত্রী যে শহরে বাস করেন, এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় সেই দিল্লি ১০৭টি দেশের রাজধানীর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত শহর বলে চিহ্নিত। দুর্নীতি? ভারত দুর্নীতিমুক্ত হয়ে গেলে কি আর রোজ সিবিআই-ইডি বিরোধী দলের নেতানেত্রীদের বাড়িতে হানা দিত, না কি তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সমন পাঠাত! সন্ত্রাসবাদ? প্রধানমন্ত্রী কিছু দিন আগে তাঁর দলের নেতাদের কাশ্মীর ফাইলস দেখতে বলেছিলেন। নব্বইয়ের দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের কাশ্মীর উপত্যকা ছাড়ার কাহিনি। এখন একের পর এক সন্ত্রাসবাদী হামলায় বাস্তবে ‘কাশ্মীর ফাইলস’ দেখা যাচ্ছে। হিন্দু পণ্ডিতরা ফের কাশ্মীর ছাড়ছেন। জাতপাত? উত্তরপ্রদেশের ভোটকে পাখির চোখ করে গত বছর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার রদবদলের সময় প্রধানমন্ত্রী ওই রাজ্য থেকে তাঁর মন্ত্রিসভাতেই ছয় ওবিসি, দলিত নেতাকে নিয়ে এসেছিলেন। তার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিল্লি জুড়ে হোর্ডিংও লেগেছিল।

সব কিছুর পরেও ফের বলতে হয়, মোদী সরকার দারিদ্র, দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ, দূষণ কমানোর কিছু না কিছু চেষ্টা করেছে। এখনও করছে। বিজেপি নিজে জাতপাতের অঙ্ক মেনে রাজনীতি করলেও, শুধুমাত্র জাতপাতের রাজনীতি-নির্ভর রাজনৈতিক দলগুলিকে কোণঠাসা করার চেষ্টায় কসুর করেনি। কিন্তু, সাম্প্রদায়িকতা? মোদী সরকার তথা বিজেপি-আরএসএস কি সত্যিই সাম্প্রদায়িকতা-মুক্ত ভারত দেখতে চেয়েছিল?

পশ্চিম এশিয়ার ধনী ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির চাপের ঠেলায় বিজেপি এখন সব ধর্মকে সম্মান করার কথা বলছে। বাস্তব হল, উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার পরে বিজেপির অন্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও যোগীকে নকল করে সাফল্য পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন। আইনে অভিযুক্ত মুসলমানদের সম্পত্তি ভাঙতে বুলডোজ়ার পাঠিয়ে যোগী হাততালি কুড়োচ্ছেন বলে বিজেপি-শাসিত দিল্লি পুরসভার মেয়ররাও পাড়ায় পাড়ায় বুলডোজ়ার পাঠাচ্ছেন। যোগী তাঁর রাজ্যে কী ভাবে মুসলিমদের দমিয়ে ফেলেছেন, সেই কাহিনি শুনে মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিংহ চৌহানের মতো নরমপন্থী নেতা থেকে কর্নাটকের বাসবরাজ বোম্মাইও এখন যোগীর অনুকরণে ব্যস্ত। এত দিন মেয়েদের জন্য ‘লাডলি লক্ষ্মী’ প্রকল্পের জন্য ‘মামা’ বলে সুনাম কুড়োনো শিবরাজকে এখন বিরোধীরা ‘বুলডোজ়ার মামা’ ডাকছেন। যোগী তাঁর রাজ্যের নির্বাচনকে ৮০ শতাংশ হিন্দুর সঙ্গে ২০ শতাংশ মুসলমানের লড়াই বলে অভিহিত করেছিলেন। বোরখা, লাউডস্পিকারের মতো বিতর্ক উস্কে দিয়ে আগামী দিনে ভোটমুখী রাজ্যেও একই মেরুকরণের চেষ্টা হচ্ছে। আর কাশী-মথুরা তো হাতে থাকছেই।

এ দেশের মুসলিমরা কোনও দিনই আরব দেশগুলির মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন না। এত দিন মেরুকরণের রাজনীতি করতে গিয়ে মুসলিমদের নিশানা করে চলা বিজেপি সেই আরব দেশগুলির চাপেই এখন বিজেপির দলীয় মুখপাত্রদের ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকতে বলেছে। এতে কি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ কমবে, না আরও বাড়বে? সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলেছেন, সব মসজিদে গিয়ে শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই। কিন্তু যাঁরা মসজিদে শিবলিঙ্গ খুঁজে পাওয়ার দাবি করে আদালতে গিয়ে মসজিদ ভেঙে মন্দিরের দাবি তুলছেন, তাঁদের ভাগবত নিরস্ত করছেন না। বলছেন, আদালতেই যা ফয়সালা হওয়ার, হবে। আদালতে যদি মামলা চলতেই থাকে, তা হলে তো সাম্প্রদায়িকতার আগুনও ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকবে। ঠিক যেমন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে মসজিদে পুজোআচ্চার দাবি উঠলেও টুঁ শব্দ করেননি। নতুন করে মন্দির-মসজিদ বিতর্ক খুঁচিয়ে তুলতে কাউকে বারণও করেননি। মনে করিয়ে দেননি তাঁর সঙ্কল্পের কথা।

দিলে হয়তো তিনি তাঁর ছয় সঙ্কল্পের অন্তত একটিতে সিদ্ধিলাভ করতে পারতেন।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তেফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ

অন্য বিষয়গুলি:

BJP PM Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE