এই মুহূর্তে প্রশ্নটা শুধু অনুব্রত মণ্ডল কবে থানায় হাজিরা দিচ্ছেন/দিলেন, কিংবা দল তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা করছে/করল, সেটাই নয়, এই মুহূর্তে মূল প্রশ্নটা হল, যে ঘটনা সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে কঠোর পদক্ষেপ করাটা প্রশাসনের কর্তব্য ছিল, তারা সেটা করল না কেন? কেন দিন গড়াতেই লাগল? কেন দল অবিলম্বে ওই ব্যক্তিকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিল না?
এমন কোনও কোনও পরিস্থিতি আসে যখন ঘৃণাও ভাষা হারায়, ক্রোধও সমস্ত ধার হারিয়ে ফেলে। ভাইরাল হওয়া যে অডিয়ো ক্লিপটিকে ঘিরে এত চর্চা, এবং যে ক্লিপটি সত্য নয় বলে কোনও প্রমাণ এখনও পর্যন্ত সামনে আসেনি, তার প্রত্যেকটা শব্দ যে কোনও সুস্থ মানুষের চেতনা, অনুভূতিকে সাময়িক ভাবে ভোঁতা করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। অপর প্রান্তে যিনি আছেন তিনি কথোপকথন রেকর্ড করছেন তা আঁচ করেও অনর্গল ওই কুকথার বর্ষণ ফের প্রমাণ করেছে শাসক দলের ছাতার তলায় থাকলে আক্ষরিক অর্থেই যা খুশি তাই করার বা বলার ছাড়পত্র সম্পর্কে সেই ব্যক্তি কতটা নিশ্চিত।
অনেকেই বলছেন, তিহাড় জেলের গরাদ যাঁকে সোজা করতে পারেনি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনও তাঁকে বাগে আনতে পারবে না (যদিও সেই চেষ্টাটাই হয়নি)। কিন্তু পুলিশ? যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, পুলিশ তখন সেই দলের পুলিশ, এ কথা মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে জানে। কিন্তু দলদাস হতে হতে নিজের সত্তাকে এ ভাবেও বিকিয়ে দেওয়া সম্ভব? যেখানে রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় এখনও পুলিশ বহু সময়েই থানায় গেলে অভিযুক্তকে ধরার চেষ্টা করার আগে অভিযোগকারীর উপরেই তড়পায়, গাঁজা কেসে ভিতরে ভরে দেওয়ার ভয় দেখায়, কোনও অল্পবয়সি মেয়ে নিখোঁজ হলে অবলীলায় বলে দেয়, ‘নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে পালিয়েছে’, সেই পুলিশেরই প্রতিনিধি অপরিসীম ধৈর্য নিয়ে যখন মা আর স্ত্রীর বিরুদ্ধে বলা যাবতীয় নোংরা শব্দ নিঃশব্দে হজম করেন, তখন প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, ঠিক কিসের বিনিময়ে এই আত্মসমর্পণ? গোটা বাহিনীর বড় অংশই ত্বকের যত্ন নিতে নিতে সেই ত্বককে এতটাই পুরু করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, যেখানে কোনও শব্দ, কোনও আচরণ বা অঙ্গভঙ্গিই আর তাঁদের স্পর্শ করে না?
সাধারণ মানুষ এখন প্রশ্ন তুলছেন, যে বাহিনী নিজের পরিবারের সম্মান রক্ষা করতে পারে না, তারা অন্যের সুরক্ষার দায়িত্ব নেবে? ইদানীং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ মার খাচ্ছে। পুলিশ প্রতিরোধের মুখে পড়ছে। পুলিশ বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। এর মধ্যে খুব অবাক হওয়ার মতো কিছু আছে কি? এখন তো এই প্রশ্ন উঠবেই, যে পুলিশ নিজের অপমানের জবাব দিতে পারে না, যে পুলিশ এক নেতার অপমান হজম করে অন্য নেতার কাছে আশ্রয় নেয়, সেই পুলিশকে কে বিশ্বাস করবে? কে-ই বা ভরসা করবে?
যে ডাক্তার তাঁর এক্তিয়ার ছাড়াই মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দেন এ কথা জানিয়ে যে, শারীরিক কারণে অনুব্রতর ‘বেড রেস্ট’ প্রয়োজন, যে পুলিশকর্তা বলেন, ‘তদন্ত সব নিয়ম মেনেই চলছে’, সেই পেশাদারদের বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণার উদ্রেক স্বাভাবিক। শুধু এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজে এক জন মহিলা বলে নয়, ওই কুকথা সামনে আসার পর প্রশাসনের তরফে যাঁরাই চুপ করে থাকছেন, তাঁদের কি সত্যিই আর কোনও নৈতিক অধিকার থাকে জন শাসনের?
এ কথা ঠিক, রাজনীতিতে এমন কটু কথা, অশ্লীল কথার চাষ নতুন নয়। বিশেষত ভোটের সময়ে তা বহু গুণ বেড়ে যায়। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও এই কুকথার সংস্কৃতি ডালপালা মেলছে। এবং সর্বত্রই রয়েছে অল্প শাস্তি বা বিনা শাস্তিতে পার পেয়ে যাওয়ার ট্র্যাডিশন। এ রাজ্যেবাম আমলে এমন একাধিক নজির রয়েছে। তৃণমূলের আমলেও আকছার তা হয়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে কুকথার বর্ষণ করে চলেছেন বিরোধীরাও। উদাহরণ অজস্র।
নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সময় মেধা পাটকরকে নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেছিলেন বাম নেতা বিনয় কোঙার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে জনসভায় অত্যন্ত কদর্য মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসু। বিরোধী দলের মহিলাদের আক্রমণ করতে গিয়ে এমন হুমকি দিয়েছিলেন প্রয়াত তৃণমূল সাংসদ তথা অভিনেতা তাপস পাল, যার জন্য শেষ দিন পর্যন্ত নানা মহলে তিরস্কৃত হয়েছেন তিনি। শাসক দলের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুরুচিকর মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক এখন জলভাত হয়ে গিয়েছে। দিনের পর দিন শালীনতার সমস্ত মাত্রা অতিক্রম করে নানা মন্তব্য করেও অবলীলায় পার পেয়ে যান তিনি। দাপিয়ে বেড়ান ক্ষমতার অলিন্দে।বাদ যান না বিরোধীরাও। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী একাধিক বার নানা আপত্তিকর মন্তব্য করে পার পেয়ে গেছেন। বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আক্রমণ করতে গিয়ে এমন কিছু আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করেছিলেন যা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে, সীমা অতিক্রম করলেন অনুব্রত। রাজনৈতিক রঙের কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল। সমাজমাধ্যমে অনেকে এই প্রশ্নও তুলছেন, শুধু ওই শব্দগুলো উচ্চারণের জন্য যাকে প্রকাশ্য রাস্তায় চপেটাঘাত করাটাও দণ্ডনীয় নয়, তাকে এখনও দলে রেখে দেওয়া, গরাদের বাইরে রেখে দেওয়া কেন? মুখ্যমন্ত্রী এক সময় সস্নেহে বলতেন, তাঁর আদরের কেষ্টর মাথায় অক্সিজেন কম পৌঁছয়। এই কুৎসিত আচরণের পরেও তাঁকে রেখে দেওয়া কি সেই স্নেহেরই প্রতিফলন? স্নেহ যে অতি বিষম বস্তু, মাননীয়া সে কথা ভুলে যাননি আশা করি। মেয়েদের ভোট মুখ্যমন্ত্রীর একটা বড় আস্থার জায়গা। লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে শুরু করে কন্যাশ্রী, একাধিক প্রকল্প তাঁকে মেয়েদের কাছে ঘরের মানুষ কাছের মানুষ করে তুলেছে। সেই তিনিই এর পর কী ব্যাখ্যা দেবেন তাঁর নীরবতার?
গত কয়েক বছর পশ্চিমবঙ্গে নৈরাজ্যের শাসন চলছে বলে অভিযোগ করে আসছেন বিরোধীরা। তাঁদের নিজেদের যা অবস্থা, তাতে এই অভিযোগ করার নৈতিক অধিকার আদৌ তাঁদের আছে কি না সে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক, যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু অভিযোগটা ভিত্তিহীন সে কথাও খুব জোর দিয়ে বলা যায় কি? প্রশাসনের সমস্ত স্তরে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে দুর্নীতি, মূল্যবোধের যে অবক্ষয় বাসা বেঁধেছে, তা কোন অতলের দিকে টানছে এ রাজ্যকে?
অধুনা বিভিন্ন ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে অনেককেই এ রাজ্যের বাসিন্দা হিসাবে বৃহত্তর জগতে লজ্জার মুখে পড়তে হয়। অনুব্রত মণ্ডলের মতো কয়েকজনের উপস্থিতি তাঁদের আরও অধোবদন করছে। সামগ্রিক ভাবে রাজনৈতিক নেতাদের বড় অংশের সম্পর্কেই তৈরি করছে প্রবল বিবমিষা। কিন্তু তাতে কারও কিচ্ছু যায় আসে কি? স্তম্ভিত হলেও, হতাশ হলেও তা কাটিয়ে উঠে জোরালো প্রতিবাদ কোথায়? মানুষ এখনও চুপ করে আছেন দেখলেও তো লজ্জা হয়।
কেন সমস্বরে প্রশ্ন উঠছে না, সমাজমাধ্যমে সামান্য ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য বা ছবি পোস্ট করলেও যেখানে পুলিশ রাতবিরেতে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়, সামান্য বিরোধিতার মুখে পড়লেই লাগিয়ে দেওয়া হয় রাষ্ট্রবিরোধিতার তকমা, সেখানে এমন একটা ঘটনার পরেও কেউ পার পেয়ে যান কী ভাবে? এ রাজ্যের মানুষের কোনও সম্মান নেই, প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই, মাথা তুলে দাঁড়ানোর জোরটুকু পর্যন্ত নেই, শাসক দল তা বার বার প্রমাণ করার চেষ্টা চালানোর পরেও কোনও ফিরতি আঘাত তাদের দিকে যায় না, কেউ শাসকের চোখে চোখ রেখে বলেন না আমরা তোমাকে প্রত্যাখ্যান করছি, এ কি সামগ্রিক ভাবে সমস্ত রাজ্যবাসীর পক্ষেও চূড়ান্ত আত্ম-অবমাননাকর নয়?
কদর্য ভাষা-উচ্চারণকারীর যে কণ্ঠ শাসক রোধ করে না, বরং তাকে পরোক্ষে আশ্রয় দেয়, তা কি এক অর্থে শাসকেরও ভাষা হয়ে ওঠে না?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)