বাঙ্গালীরা ইংরাজী পড়িয়া হিন্দুশাস্ত্র মানে না; তাহারা মুরগি খায়;... বাঙ্গালীরা নাস্তিক-ম্লেচ্ছ।” রাজনিমন্ত্রণে মৃগয়ায় গিয়ে প্রেতযোনিতে অবিশ্বাস প্রকাশ করে সমবেত হিন্দিভাষী রাজানুগ্রহীদের থেকে এমন কটাক্ষ শুনেছিল শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত। তলিয়ে দেখলে, এই কটাক্ষের এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত আছে, যা বাঙালির বিশেষত্বের নির্দেশক। তা হল শিক্ষিত বাঙালি তরুণের প্রগতিশীলতা। এই স্বভাবগত বিদ্রোহী প্রগতিসত্তার শিকড় উনিশ শতকীয় সামাজিক আবর্তে। প্রাচীনের লয় ও নতুনের আগমনের টানাপড়েন ও মন্থনের পাশাপাশি তার পরিচয় হয় ইংরেজি ভাষা ও পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী দর্শনের সঙ্গে, দুইয়ে মিলে গড়ে ওঠে তার মনন।
বিশ শতকে এসে তার পরিচয় বামপন্থার সঙ্গে। তার তত্ত্ব ও যুক্তি বাঙালি তরুণের প্রগতিশীলতাকে খরতর করেছিল। সে কেবল শ্রেণিই বোঝেনি, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের যুক্তি তাকে দেয় বিশ্লেষণের নতুন কম্পাস। জাতপাতে তার বিরাগ, ধর্ম ও ধর্মীয় কুসংস্কারে বিতৃষ্ণা, নারী-পুরুষ সাম্যের পক্ষে তার অবস্থান কাকতালীয় নয়। ছন্দ গুরুতর কেটেছে একুশ শতকে। বাঙালি তরুণের এই মননে তাৎপর্যপূর্ণ ছেদ ঘটেছে গত দেড় দশকে। একদা পৈতে ধোপাবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া বাঙালি তরুণদের অনেকে এখন পায়ে কালো সুতো পরে ‘নজর লাগা’ এড়াতে, গ্রহনক্ষত্র নিয়ে সদাই মরে ত্রাসে। ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনা মনে করে দেশদ্রোহ, কাল্পনিক চরিত্রের কৌতুকে রেগে আগুন হয়। উত্তর-আধুনিকতা থেকে সে যেন পিছন দিকে লম্ফমান।
উত্তর-আধুনিকতার পথ বেয়েই বিশ্ব জুড়ে ডিকলোনাইজ়েশন ও পোস্ট-কলোনিয়াল চর্চা শুরু। গত শতকের যুক্তি ও বস্তুবাদের সঙ্গে যুক্ত হল ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও চিন্তায় পশ্চিমি উপনিবেশবাদের দখল-সহ একাধিক বিষয়ে প্রান্তজনের প্রেক্ষিত থেকে সমাজ অর্থনীতি রাষ্ট্রকে দেখা। মার্ক্সবাদের থেকে স্বতন্ত্র হয়েও ন্যায় ও সমতার যৌক্তিকতার প্রশ্নে এখানে অভিন্নতা ছিল। ফ্রানৎজ় ফ্যানন থেকে গায়ত্রী স্পিভাক যখন পিছিয়ে পড়া মানুষের কথা বলছেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তি সেই একই বৌদ্ধিক কাঠামোকে রাজনৈতিক অভিসন্ধি নিয়ে ব্যবহার করা শুরু করে। অড্রে ট্রাশকির মতে ডিকলোনাইজ়েশনের মুখোশে ভারতে হিন্দুত্ববাদীরা আসলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের দ্বিজাতি তত্ত্বের নীলনকশার পুনর্নির্মাণ করেছে; মুসলিম শাসন-বিদ্বেষ ও মুসলিম-বিদ্বেষ উপনিবেশবাদেরই নির্মাণ। একই সঙ্গে তারা খণ্ডন করেছে পাশ্চাত্য যুক্তিবাদও। প্রাক্-মোগল ভারতের এমন ছবি এঁকেছে যাতে জাতপাত, নারীবিদ্বেষকে ‘ঐতিহ্য’, ‘সংস্কার’ বলে চালিয়ে দেওয়া গেল, বলা হল এই ভারতীয় সভ্যতা।
বাংলায় এই ‘আদর্শ ভারতীয়’ হওয়ার টোপ শুরুতে কাজে লাগেনি। সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা, স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবমাখা বাঙালি নতুন করে ভারতীয় হওয়ার মধ্যে কোনও পুরস্কার দেখেনি। দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িকতার আশঙ্কা পেরিয়ে রুটিরুজি বাসস্থানের দাবি এল সামনের সারিতে। উদ্বাস্তু আন্দোলনের হাত ধরে পঞ্চাশের দশকে শহরের শ্রমজীবীরা সাম্প্রদায়িক বাইনারির পরিবর্তে শ্রেণি আন্দোলনের দিকে এগোতে সফল হন। শ্রেণি-পরিচিতির রাজনৈতিক আধিপত্য ধর্মীয় বা জাতি-পরিচয়কে রাজনীতির মূলধারায় ঢুকতে দেয়নি।
২০০০-এর শুরু থেকে বনিয়াদি বদল শুরু। পর্যাপ্ত শিল্পের অভাব, পরিযায়ী শ্রমিক বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা হ্রাস, একই সঙ্গে বাজার অর্থনীতি নতুন মাত্রায় বিকশিত হওয়ায় আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে গোড়ার দিকের বোঝাপড়া পড়ল প্রশ্নের মুখে। চাকরি নেই, পেট চালাতে রাজ্য ছাড়তে হবে— বাঙালি অস্মিতায় প্রথম আঁচড়। বাঙালির যৌবনের উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা এবং তা পূরণে বাম-সরকারের ব্যর্থতা পথ করে দেয় তৃতীয় রাজনৈতিক পরিসরের। রাজনীতির পালাবদল, নানা পরিচিতির রাজনীতিকরণ আরও বহু রাজনৈতিক পরিচয়ের দরজা খুলে দেয়। পরিচিতি তৈরিতে রাষ্ট্রের খোলাখুলি পৃষ্ঠপোষকতা, প্রথমে ‘আদৰ্শ ভারতীয়’ ও পরে ‘আদর্শ হিন্দু’ পরিচিতি তৈরির পথ করে দিয়েছে। ২০১১-পরবর্তী গজিয়ে ওঠা আরএসএস-এর শাখা শুধু বিজেপির জন্যই কাজ করেনি, বাংলার সামাজিক বুনন একটু একটু করে বদলে দিয়েছে। রাজনীতির সঙ্গে সম্প্রদায়ের পরিচিতি এমন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়েছে যে শাসক হোক বা বিরোধী, ছকের বাইরে যেতে পারবে না কেউ।
ফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। যুক্তিবিমুখতা ও ধর্মের প্রশ্নে বাঙালি প্রশ্নহীন ভাবে অনুগত হচ্ছে। রিল-এ দেখেছে গোঁফে তা দেওয়া, কপালে-তিলক হিন্দু বীরকে, দেখেছে তার রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর নিয়ন্ত্রণ; তাকে আইকন বানিয়েছে। আর মগজের কসরত? বামফ্রন্টের প্রথম দিকে বয়স্ক শিক্ষা, নারীশিক্ষায় জোর ছিল, সরকারের পাশাপাশি পার্টিরও দায়িত্ব ছিল চেতনার বিকাশ। অবৈতনিক স্কুল, সরকারি শিক্ষক নিয়োগের নিয়মিত পরীক্ষা, স্কুলে বিজ্ঞান মঞ্চের কুসংস্কার-বিরোধী পাঠ তৈরি করেছিল জানা-বোঝার মুক্ত পরিসর। ২০১১-উত্তর বাংলায় তত্ত্বগত বা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোনও ‘কাউন্টার-কালচার’এর জন্ম হয়নি, বরং নানা ক্ষেত্রে নির্লজ্জ সমর্পণ হয়েছে, বা প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা। মিছিলে আস্থা হারানো মানুষ নিজ সুবিধামতো মসিহা খুঁজে নিয়েছেন। সমাজ-রাজনীতিতে যত শ্রেণি-রাজনীতির আধিপত্য কমেছে, পরিচিতির রাজনীতি তত আগ্রাসী হয়েছে। এই পাকেচক্রে দ্রুতি পাচ্ছে বাঙালির পশ্চাৎগতি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)