E-Paper

আমাদের শরীরও জানে সময়

আমাদের শরীরেও আছে এক বিস্ময়কর সময়-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: অভ্যন্তরীণ জৈবিক ছন্দ তথা সার্কাডিয়ান রিদম। শরীরঘড়ির এই ছন্দ মেনে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নানা গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ চলতে থাকে।

সিদ্ধার্থ মজুমদার

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:৪১

অষ্টাদশ শতকে এক ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী লক্ষ করেছিলেন, লজ্জাবতী গাছের পাতা দিনে খোলে, সন্ধেয় বন্ধ হয়। তিনি গাছটিকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে পরীক্ষা করে দেখেন, আলো না থাকলেও তার পাতা আগের মতোই নিয়মিত একই ছন্দে খোলে ও বন্ধ হয়। এই পরীক্ষায় স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেল, লজ্জাবতী পাতার খোলা বা বন্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ আলো বা অন্ধকার নয়, গাছটির ভিতরেও এক ধরনের জৈবিক ছন্দ কাজ করে যা বাইরের দিন-রাতের পরিবর্তনের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। এই অভ্যন্তরীণ জৈবিক সময়ছন্দই ‘সার্কাডিয়ান রিদম’, বা ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’। এই ছন্দ অনুসরণেই দিনে‌-রাতে নানা জরুরি জৈবিক কাজ সম্পন্ন হয়।

এ থেকেই জন্ম নেয় ‘ক্রোনোবায়োলজি’ বিষয়ক ধারণা। ‘ক্রোনোস’ অর্থ সময়, ‘বায়োস’ মানে ‘জীবন’। ক্রোনোবায়োলজি মানে সময় ও জীবন সম্পর্কিত বিজ্ঞান। ‘সার্কাডিয়ান’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন থেকে, অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘প্রায় এক দিন’। আমাদের শরীরেও আছে এক বিস্ময়কর সময়-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: অভ্যন্তরীণ জৈবিক ছন্দ তথা সার্কাডিয়ান রিদম। শরীরঘড়ির এই ছন্দ মেনে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে নানা গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ চলতে থাকে। রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম আসে, সকালে ঘুম ভাঙে, নির্দিষ্ট সময়ে খিদে পায়। বাইরের আলো-অন্ধকারের সময়চক্র, আমাদের শারীরবৃত্তীয় জৈবিক ছন্দকে সর্বক্ষণ প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু মানুষ নয়, পৃথিবীর ঘূর্ণন ও দিন-রাতের ছন্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উদ্ভিদ, প্রাণী, পাখি, কীটপতঙ্গ, এমনকি ছত্রাক ও সায়ানো-ব্যাক্টিরিয়াও তাদের নিজস্ব সার্কাডিয়ান রিদম অনুযায়ী কাজ করে।

কিছু ফুল সকালে নির্দিষ্ট সময়ে ফোটে, আবার কিছু ফোটে কেবল রাতে। প্রতিটি প্রজাতির গাছেরই রয়েছে নিজস্ব সময়চক্র, যে সময়ে তারা পাপড়ি খোলে বা তা বন্ধ হয়, বা তারা সুগন্ধ ছড়ায়। ফুল ফোটা বা বন্ধ হওয়ার ছন্দ মূলত আলো-অন্ধকারের চক্র ও ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে জড়িত। নির্দিষ্ট সময়ে গাছে ফুল ফোটে, যাতে তখন সক্রিয় পরাগ-সংযোগকারীরা সহজে আকৃষ্ট হয়। এই নিখুঁত সময়-সামঞ্জস্য ফুলের সফল পরাগ-সংযোগের সম্ভাবনা বাড়ায়, গাছের বংশবৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র রক্ষায় সহায়ক হয়। ফুল ফোটা তাই সুস্থ পরিবেশ ব্যবস্থা বজায় থাকার ক্ষেত্রে জরুরি।

অভ্যন্তরীণ জৈবিক ছন্দ কী ভাবে কাজ করে, বিজ্ঞানীদের কাছে তা এক রহস্য ছিল। গবেষণায় জানা গেছে, আমাদের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অঞ্চলের ভিতরে, প্রায় কুড়ি হাজার নিউরন নিয়ে গঠিত সুপ্রাকিয়াসম্যাটিক নিউক্লিয়াস (এসসিএন) নামের একটি অংশ শরীরের কেন্দ্রীয় ঘড়ি হিসেবে কাজ করে। এই অংশই শারীরবৃত্তীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে, বাইরের সময়চক্রের সঙ্গে শরীরের সামঞ্জস্য বজায় রাখে। পরে জানা যায়, শরীরের প্রতিটি কোষের ভিতরেও ছোট ছোট জৈবিক ঘড়ি আছে। বাইরের আলো থেকে সঙ্কেত পাওয়ার পর এসসিএন সেই ঘড়িগুলির সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে, ফলে শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম অটুট থাকে।

জেফ্রি সি হল, মাইকেল রোসব্যাশ এবং মাইকেল ডব্লিউ ইয়ং— তিন বিজ্ঞানী ‘ফ্রুট-ফ্লাই’-এর মধ্যে বিশেষ এক ধরনের জিন আবিষ্কার করেন, যা সার্কাডিয়ান রিদম নিয়ন্ত্রণ করে। এর সূত্রেই ২০১৭-য় চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পান তাঁরা। এই আবিষ্কার সূত্রে তাঁরা বুঝতে পারেন আমাদের শরীর কী ভাবে সময় অনুভব করে ও সেই ছন্দ মেনে শারীরবৃত্তীয় কাজ সম্পন্ন করে। ফ্রুট-ফ্লাইয়ের বিশেষ সেই ‘পিরিয়ড জিন’ থেকে যে প্রোটিন তৈরি হয়, সেটিই তাদের প্রতি দিনের জৈবিক ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করে। এদের কোষে রাতে পিরিয়ড জিন থেকে ‘পিইআর’ প্রোটিন তৈরি হয়, দিনে সেই প্রোটিন ধীরে ধীরে ভেঙে যায়। প্রোটিনের মাত্রা ২৪ ঘণ্টা জুড়ে এক নিয়মিত ছন্দে ওঠানামা করে। চক্রাকারে তৈরি হওয়া এই প্রোটিনই আসলে বায়োলজিক্যাল ক্লক-এর মূল উপাদান। এই আবিষ্কার থেকেই বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষ কী ভাবে পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে নিজেদের জৈবিক ছন্দের সামঞ্জস্য বজায় রাখে।

মানবশরীরের কোষে থাকা জৈবিক ঘড়িই শরীরে হরমোন নিঃসরণের মাত্রা, তাপমাত্রা, রক্তচাপ, বিপাক প্রক্রিয়া— সব কিছুর ছন্দ নির্ধারণ করে। দিন-রাতের সময়চক্রের সঙ্গে নিখুঁত তাল মিলিয়ে সে দেহের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই সময়ের ছন্দে ব্যাঘাত ঘটলে তার প্রভাব পড়ে শরীরে: শরীরঘড়ি দীর্ঘ সময় ধরে বিঘ্নিত হলে টাইপ-২ ডায়বিটিস, স্থূলতা, হৃদ্‌রোগ, ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে। পরিবেশের সময়চক্রের সঙ্গে সাময়িক ভাবে না মিললেও সমস্যা দেখা দেয়, যাঁরা ‘শিফট ডিউটি’ করেন বা এক সময়-অঞ্চল থেকে অন্য সময়-অঞ্চলে ভ্রমণ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে শরীরের স্বাভাবিক জৈবিক ছন্দ বিঘ্নিত হয়। ‘জেট ল্যাগ’-এর অস্তিত্বই এর প্রমাণ। শরীরঘড়ির এই আবিষ্কার শুধু দেহের সময়চক্র বোঝার ক্ষেত্রেই নয়, জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসা-গবেষণাতেও নতুন দিক খুলে দিয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Research Biology Chronology of cases

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy