কিছু দিন আগে বুসান-এ এশিয়া প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপারেশন (এপিইসি) সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে, এবং তার সঙ্গে বহুল প্রত্যাশিত ডোনাল্ড ট্রাম্প ও শি জিনপিং-এর বৈঠকও হয়েছে। অনুমান, যা ঘটল, তাকে কোনও ঐতিহাসিক অগ্রগতি বলা উচিত নয়, বরং এ যেন এক স্বল্প-স্থায়ী বিরতি। দুই নেতা হাসিমুখে ‘গঠনমূলক সহযোগিতা’-র কথা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু পরিকল্পিত আনুষ্ঠানিকতার মাঝে আড়াল করতে পারেনি সেই গভীর অবিশ্বাস, যা আজও প্রতিনিয়ত আমেরিকা-চিন সম্পর্ককে নির্ধারণ করে।
ওয়াশিংটন ও বেজিং— উভয়ের ক্ষেত্রেই বৈঠকের সময়টি ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। নিজের দেশে ট্রাম্পকে সামলাতে হচ্ছে একাধিক চ্যালেঞ্জ, বাড়তে থাকা মূল্যবৃদ্ধি, অচলাবস্থায় আক্রান্ত বহুমুখী কংগ্রেস, এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধির মন্থর গতি। অপর দিকে, শি-র সামনে রয়েছে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, যুব বেকারত্ব, এবং বিশ্বব্যাপী উৎপাদন শৃঙ্খলার একাধিপত্য থেকে ক্রমশ সরে যাওয়ার প্রবণতা। উভয় নেতাই প্রয়োজন বোধ করেছেন নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীলতা প্রদর্শনের। ট্রাম্পের দক্ষিণ কোরিয়া সফর তাঁকে সুযোগ দিয়েছে এক সফল কারবারি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার, এমন নেতা হওয়ার, যিনি ব্যবসায়িক নিয়মে সংঘাত এড়াতে সক্ষম। অন্য দিকে, শি এই সম্মেলনে আগ্রহ দেখিয়েছেন মূলত তাঁর নেতৃত্ব প্রদর্শনের পাশে এক রকমের স্থিতিশীলতার আশ্বাস দিতে, যাতে এখনকার সঙ্কটদীর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা ভারসাম্য হারাতে না পারে।
সম্মেলনের সবচেয়ে বড় দিক, এই আলোচনা দেখাল যে আন্তঃসরকারি সংলাপ এখনও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যথেষ্ট কার্যকর হাতিয়ার। মৌলিক বিষয়গুলো পাল্টায়নি, ঠিকই। বাণিজ্য হোক, প্রযুক্তি কিংবা বৈশ্বিক শৃঙ্খলার বিন্যাস, কোনওটিই নয়। আবার কোনও নেতাই যুদ্ধের উগ্রতা প্রদর্শন না করলেও দুই জনের কেউই তাঁদের স্বাভাবিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার চরিত্র ও ধারা বদলাননি।
বস্তুত, এই সম্মেলন একটি সীমিত কিন্তু সংবাদমাধ্যম-বান্ধব প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করতে পেরেছে। আমেরিকা সাময়িক ভাবে শুল্কবৃদ্ধি স্থগিত রাখতে সম্মত হয়েছে। আর তার বিনিময়ে, চিন পুনরায় বিপুল পরিমাণে সয়াবিন কেনার এবং এক বছরের জন্য বিরল মৃত্তিকা রফতানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়াও, কৃত্রিম ওপিঅয়েড উৎপাদনের প্রাথমিক রাসায়নিক পদার্থের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা, যা আমেরিকান পরিবারগুলির পক্ষে এক বড় ‘প্রাপ্তি’ হিসেবে প্রচার করবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ সব পদক্ষেপকে চিন-প্রদত্ত ছাড় হিসেবে দেখতে উদ্গ্রীব ট্রাম্প স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় নিজের সাফল্য ও আলোচনাকৌশলের বিজ্ঞাপন চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বেজিংয়ের কাছে এগুলি সবই কৌশল। কিংবা কৌশলগত সামঞ্জস্যের পদক্ষেপ। শি জিনপিং তাঁর মৌলিক লক্ষ্য, যেমন প্রযুক্তিগত সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা ও মতাদর্শগত নিয়ন্ত্রণ থেকে একটুও সরে এসেছেন ভাবলে ভুল হবে। সয়াবিন কেনা ও বিরল মৃত্তিকা রফতানিতে শিথিলতা কেবল এই মুহূর্তের অতি প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক সুরক্ষাবেষ্টনী মাত্র, যা তাঁকে দেশের অভ্যন্তরীণ জটিল সমস্যাগুলো সামাল দিতে কিছুটা সময় দেবে। সেমিকন্ডাক্টর, মেধাস্বত্ব, বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে কোনও অগ্রগতি হয়নি— কেননা এ সব ক্ষেত্রে পার্থক্য এতটাই গভীর যে সমন্বয় প্রায় অসম্ভব। আমেরিকার উচ্চমানের চিপ রফতানির উপর নিয়ন্ত্রণ এখনও চিনের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছে, এবং চিনের ‘স্বনির্ভর উদ্ভাবন’ পরিকল্পনা প্রত্যাশিত ভাবে অব্যাহত রয়েছে।
দুই পক্ষের মধ্যে সংবেদনশীল ভূরাজনৈতিক বিষয়গুলি, যেমন তাইওয়ান, দক্ষিণ চিন সাগর এবং উত্তর কোরিয়া নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ট্রাম্প এক-চিন নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন, যদিও সতর্ক করেছেন ‘বর্তমান অবস্থার একতরফা পরিবর্তন’-এর বিরুদ্ধে। শি জিনপিং যথারীতি তাঁর ‘বহিরাগত হস্তক্ষেপ’-এর বিরোধিতা এবং ‘উপযুক্ত পরিস্থিতি’-তে শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলনের অঙ্গীকার পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। প্রকাশ্যে তাঁরা স্থিতিশীলতার আহ্বান জানালেও আদতে, উভয়েই নিজেদের অনতিক্রম্য রেখা কিছুটা পিছিয়ে নিয়েছেন।
আর্থিক বাজার ও উৎকণ্ঠিত মিত্রদের জন্য অবশ্যই দুই মহাশক্তির এই সীমিত শিথিলতাও কিছুটা স্বস্তি এনেছে। বিশ্ব বাজারে ক্ষণিকের জন্য জ্বালানির দাম স্থিতিশীল হয়েছে। এশিয়ার শেয়ার সূচকে সামান্য উত্থান লক্ষ করা গেছে। তবু, এই শান্তিপূর্ণ আবরণের অভ্যন্তরে কাঠামোগত বৈষম্য এখনও অটুট। দু’দেশের অর্থনীতি এতটাই পরস্পর-নির্ভরশীল যে বিচ্ছিন্নতা অসম্ভব, আর পারস্পরিক অবিশ্বাস এত গভীর যে সত্যিকারের অর্থনৈতিক একীকরণও অধরা।
আসলে, এই সম্মেলনের একমাত্র প্রাপ্তি হল, প্রয়োজনের যুক্তিপূর্ণ অনিবার্য দাবি। রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী প্রয়োজনীয়তাই দুই নেতার কর্মকৌশলকে নির্ধারিত করেছে। কেউই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হওয়ার ন্যূনতম প্রমাণ রাখতে অসমর্থ। আজকের কূটনীতি সম্পূর্ণ লেনদেনভিত্তিক এবং স্বল্পমেয়াদি। শুল্কবিরতির সমঝোতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুনরারম্ভ কোনও নতুন ভারসাম্যের দ্যোতক নয়; উত্তেজনার সাময়িক বিরতি। প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব, সমুদ্রপথে প্রভাব বৃদ্ধি, এবং বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল প্রতিযোগিতা সমান ভাবে অব্যাহত।
ভারতের জন্য এর প্রভাব প্রত্যক্ষ এবং বহুস্তরীয়। বুসানের এই সাময়িক যুদ্ধবিরতি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কিছুটা উত্তেজনা প্রশমিত করেছে, যা দিল্লিকে অর্থনৈতিক সংস্কার ত্বরান্বিত করার ও তার কৌশলগত প্রসার পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ দিতে পারে। আমেরিকা-চিন সম্পর্কের আপাত শান্তি আঞ্চলিক সরবরাহ শৃঙ্খলে আকস্মিক সঙ্কটের সম্ভাবনাকে কিছুটা প্রশমিত করবে এবং বিনিয়োগের জন্য হয়তো এক সাময়িক স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যা ভারতের উৎপাদন লক্ষ্যগুলিকে সহায়তা করতে পারে। তবুও, ভারতকে সতর্কতা বজায় রাখতে হবে। ওয়াশিংটনের মনোযোগ যদি প্রধান শক্তিগুলির জোট থেকে সরে যায়, তবে নয়াদিল্লির জন্য পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। ভারতের জন্য এখন সর্বোত্তম কৌশল হল কোয়াড, আইপিইএফ ও বিমস্টেক-এর মতো বহুপাক্ষিক গোষ্ঠীগুলিকে শক্তিশালী করা। এবং অবশ্যই, আমেরিকা ও চিনের মধ্যে কোনও এক পক্ষকে বেছে না নেওয়া। আমেরিকা-চিনের আপাত-স্থিতিশীলতা ভারতের জন্য মোটের উপরে ইতিবাচক, কিন্তু দীর্ঘকালীন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এখনও অলীক।
এ বারের সম্মেলনের বৃহত্তর তাৎপর্য সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে। চিন তার অঙ্গীকার কতটা রক্ষা করে, তার অনুমান কঠিন। তবে এটুকু বোঝাই যায়, চিন যদি তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসে, তা হলে আমেরিকার অতিমাত্রায় শুল্ক প্রবর্তনের প্রবণতা নিশ্চিত ভাবে ফিরে আসবে। তবু গিয়ংজু সম্মেলনে উপস্থিত দুই নেতা যে তাঁদের নিজ নিজ ‘অর্জিত অবস্থান’কে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তা স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু সৌজন্যমূলক আনুষ্ঠানিকতার আবরণের গোপনীয়তায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাস্তবতা অটুট রয়ে গিয়েছে।
মাঝারি শক্তি ও আঞ্চলিক অংশীদারদের জন্যও কথাটি একই ভাবে প্রযোজ্য। বৃহৎ শক্তিগুলির প্রতিযোগিতা এখন এমন পর্যায়ে প্রবেশ করছে, যেখানে কৌশলগত সংযমই মুখ্য, কিন্তু কোনও আশু সমাধান দৃশ্যমান নয়। যারা দক্ষতার সঙ্গে বিপরীত প্রভাবগুলির ভারসাম্য রক্ষা, আর্থিক সংযোগ প্রসারিত করবে, এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ কৌশলগত পরিকল্পনা তৈরি করতে পারবে— তারাই শেষে সফল হবে। ভারত, জাপান, ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলির এটা বোঝা দরকার। তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে পরবর্তী ধাক্কার জন্য, যা এই সাময়িক স্থিতিশীলতার পর খুবই সম্ভাব্য।
আসলে ট্রাম্প-শি সাক্ষাৎ প্রমাণ করেছে যে বিশ্বব্যবস্থা এখনও নির্ভর করছে বহু-শক্তিধর রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজন ও অবিশ্বাসের এক সূক্ষ্ম ভারসাম্যের উপর। দুই নেতা ক্যামেরার সামনে করমর্দন করেছেন, অস্থিরতার আবহে শান্তির বার্তা ঘোষণা করেছেন— দারুণ ব্যাপার। কিন্তু ক্ষমতার ফাটলরেখা সহজে মিলিয়ে যায় না। এই বৈঠক উদ্বেগ প্রশমিত করেছে, কিন্তু মৌলিক সমস্যাগুলিকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। যা ঘটেছে তা হল গভীর অনাস্থা ও বিশৃঙ্খলা থেকে সাময়িক বিরাম— অর্থাৎ এক উত্তাল বিশ্বে দাঁড়িয়ে শত্রুতা থেকে ক্ষণিকের বিরতি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)