গঙ্গোত্রী থেকে ১৮ কিলোমিটার ভাটিতে ভাগীরথী আর ক্ষীরগঙ্গার সঙ্গমে অবস্থিত ধারালী। গত ৫ অগস্ট ক্ষীরগঙ্গার খাত ধরে ধেয়ে আসা ৩৬ কোটি ঘনমিটার বালি-পাথরের স্তূপের নীচে হারিয়ে গিয়েছে গ্রামটি। উপগ্রহ চিত্রে দেখছি এক ত্রিকোণাকার ফ্যান-এর নীচে চাপা পড়ে গিয়েছে গ্রামটি। এখনও সঠিক ভাবে জানা যায়নি ধ্বংসস্তূপের নীচে কত জনের দেহ চাপা পড়ে গিয়েছিল। বহু মানুষ এখনও নিখোঁজ। এই ধ্বংসযজ্ঞের পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আরও এক হড়পা বানে বিচ্ছিন্ন হয়েছে কিন্নর-কৈলাস যাওয়ার পথ; ১৭ অগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের কাঠুয়াতে ভূমিধসে প্রাণ হারিয়েছেন সাত জন। এই মুহূর্তে বিপাশা নদীর তাণ্ডবে কুলু ও মানালি বিপর্যস্ত; ধস নেমে ত্রিশের অধিক প্রাণহানি হয়েছে বৈষ্ণোদেবীর পথেও। মনে হচ্ছে, স্রষ্টা যেন তার বহু যত্নে লালিত সৃষ্টিকে ধ্বংস করতে চাইছে— উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগের মতো।
জল, পলি আর শক্তি— এই তিন উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত হয় হিমালয়ের নদী। ছোট-বড় সব নদীরই পাড় থেকে কিছু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে প্লাবনভূমি। বন্যার সময় প্রসারিত জলস্রোত ওই এলাকার উপর দিয়ে বয়ে যায়। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে আসা বহমান জলস্রোত সমভূমিতে নেমে আরও প্রসারিত হয়। চলার পথ বন্ধ হলে গতিশীলতার ভারসাম্য নষ্ট হয়। তবে নদীর ধৈর্যের বাঁধ এক দিনে ভাঙে না। ধীরে ধীরে সহ্যের সীমা অতিক্রম করলে শুরু হয় ধ্বংসের তাণ্ডব।
হিমালয়ের গঠন এখনও চলেছে এবং এর ঢাল অত্যন্ত ভঙ্গুর ও ভূমিকম্পপ্রবণ। বর্ষাকালে সারা হিমালয় জুড়েই ভূমি-স্খলন স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু গত কয়েক বছরে হিমালয় যেন আরও অস্থির হয়ে উঠেছে, যার নেপথ্যে একাধিক কারণ আছে। কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রী— চারধাম নামে পরিচিত। মন্দাকিনী, অলকানন্দা, গঙ্গা ও যমুনার উৎসের কাছে গড়ে ওঠা এই চারটি পুণ্যভূমির প্রতি ভারতীয়দের আকর্ষণ দুর্নিবার। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে হৃষীকেশ থেকে চারধামের দিকে ৫.৫০ মিটার প্রশস্ত এবং ৮৮৯ কিলোমিটার দীর্ঘ রাজপথ নির্মাণের এক অতিউচ্চাশী প্রকল্প ঘোষিত হয়েছিল হিমালয়ের অতিসংবেদনশীল পরিবেশে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবেই। ১১৭০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ওই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা আগামী ডিসেম্বর। এই দীর্ঘ পথের ১৪৮টি স্থান ধসপ্রবণ। ওই বিপজ্জনক এলাকা এড়াতে পাহাড় ফুটো করে টানেল নির্মাণের কাজ চলছে। পাঠকরা স্মরণ করুন, ২০২৩ সালে চারধাম রাজপথ প্রকল্পের অধীন সিল্কইয়ারা-বারকোট টানেলের প্রান্তদেশে ধস নেমে ৪১ জন শ্রমিকের আটকে যাওয়ার কথা। ১৬ দিন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছিল।
২০১৭ সালে ঘোষণা করা হয়েছে হৃষীকেশ থেকে চারধাম যুক্ত হবে ৪৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রডগেজ রেলপথেও। ওই যোগাযোগ স্থাপিত হবে মোট ২৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ৫২টি টানেল এবং ৫৯টি সেতুর মাধ্যমে। ৪৩,২৯২ কোটি টাকা বাজেটের এই প্রকল্পের অন্য উদ্দেশ্যটি হল সেনাবাহিনীকে দ্রুত চিন-সীমান্তে পৌঁছে দেওয়া। আমাদের ঘরের কাছেই তিস্তার ধার ঘেঁষে সেবক থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে; এই প্রকল্পেও ৩৯ কিলোমিটার রেলপথ যাবে সুড়ঙ্গের ভিতর দিয়ে। এই রেল প্রকল্প ও স্টেজ-৪ জলাধার নির্মাণের পর তিস্তার চলার ছন্দ এমন ভাবে ব্যাহত হয়েছে যে, গভীর খাতের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী বর্ষায় প্রায়ই ফুলেফেঁপে কালিম্পং ও সিকিম যাওয়ার ১০ নম্বর জাতীয় সড়কে উঠে আসছে; সম্প্রতি ভেঙে পড়েছে একটি টানেলের গার্ডওয়ালও।
হিমালয় থেকে নেমে আসা জলস্রোতের মধ্যে ১,১৫,৫৫০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। আজ পর্যন্ত যতগুলি প্রকল্প রূপায়িত হয়েছে, তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৪৬,৬৫০ মেগাওয়াট। সারা হিমালয় জুড়ে ৮১টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে, ২৬টি নির্মীয়মাণ এবং আরও ৩২০টির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও জরিপ চলছে। প্রতিটি নির্মাণের জন্য নদীর গতিপথ আটকে জলাধার তৈরি হয়েছে, পাহাড়ের ভিতর দিয়ে টানেল খনন করা হয়েছে, সবুজ ধ্বংস করে ঢালকে কংক্রিটের চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। অনিবার্য কারণেই বেড়েছে ভূমিস্খলন। অলকানন্দা নদীকে বন্দি করার পর জোশীমঠ শহরের ৮০০ বাড়িতে ফাটল ধরেছে; পাহাড়ের ঢাল ধীরে ধীরে বসে যাচ্ছে। বদ্রীনাথ যাওয়ার পথ বারে বারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ২০২১-এ অলকানন্দার উপনদীর উপর নির্মীয়মাণ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এক হিমানি সম্প্রপাতে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ২০০-র কাছাকাছি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ১৫০০ কোটি টাকা অপচয়ের পর প্রকল্পটি ফের নির্মাণের চেষ্টা চলছে। ২০২৩-এ তিস্তা নদীর উজানে প্রবল বর্ষণে লোনাক হ্রদ ভাঙা জল-পলি-পাথরের স্রোত উত্তর সিকিমের চুংথাং-এর কাছে নির্মীয়মাণ তিস্তা স্টেজ-৩ প্রকল্প এবং বারদাং সেনাছাউনি ধ্বংস করে দিয়েছিল। হিমালয়ের সম্ভাব্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৩৪% লুকিয়ে আছে অরুণাচলের নদীগুলির স্রোতের মধ্যে। ফলে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে বহু জলাধার। ইতিমধ্যেই প্রতিক্রিয়াও দেখা যাচ্ছে। ২০২২ সালের জুন মাসে সুবানসিড়ি নদীর জলাধার উপচে নেমে আসা এক বিপুল জলস্রোত অসমের ১০০টি গ্রামকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। ২০১৩ সালে কেদারনাথের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের নির্দেশে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠিত হয়েছিল, তাঁরা বলেছিলেন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি হিমালয়ের পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। প্রকল্পগুলি থেকে প্রত্যাশিত শক্তি পাওয়া যায়নি। ২০২১-২২ সালের সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, পূর্ববর্তী ছয় বছরে হিমালয়ের প্রকল্পগুলি তাদের প্রত্যাশিত ক্ষমতার মাত্র ১০% শক্তি উৎপাদন করেছিল। তবু কিছু থেমে থাকেনি।
হিমালয় গঠনগত কারণেই ভঙ্গুর। শিলাস্তরের পরতে-পরতে লুকিয়ে আছে বহু চ্যুতি বা ফাটল; সড়ক, রেল ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি নির্মাণের সময় নির্বিচারে অন্তত পঞ্চাশ হাজার গাছ কাটা হয়েছে; বিস্ফোরণ করে টানেল নির্মাণের সময় পাহাড়ের ঢালে আরও অনেক ফাটল ধরেছে। অন্য দিকে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অল্প সময়ের মধ্যে অতিবৃষ্টির প্রবণতা বাড়ছে। গত ২৬ অগস্ট জম্মুর উধমপুরে ১২ ঘণ্টায় ৫১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। শিলাস্তরের ফাটলের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত জল প্রবেশ করলে কিছুটা গভীরে একটি পিচ্ছিল তল তৈরি হয় এবং ঢালের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে পাথর-বালি নীচের দিকে নেমে আসে। অতিবৃষ্টির প্রভাবে হিমালয়ের হিমবাহ-গলা জলের হ্রদগুলি মাঝে মাঝে প্রান্তদেশের পাথর-বালির দেওয়াল ভেঙে বড় বিপর্যয় ঘটাচ্ছে; যেমন হয়েছিল ২০১৩ সালে কেদারনাথে, বা ২০২৩ সালে উত্তর সিকিমে।
জলবায়ুর পরিবর্তন এবং ভূমি ব্যবহারের সাম্প্রতিক পরিবর্তন হিমালয়কে বিপর্যস্ত করেছে। এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবেই এত ধ্বংস এবং মৃত্যুমিছিল। ‘উন্নয়ন’-এর কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে হিমালয় যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র! এক দিকে ‘বিকশিত ও আত্মনির্ভর’ ভারত গড়ার কারিগররা, অন্য দিকে ভূমিকম্পপ্রবণ ও ভূতাত্ত্বিক গঠনে দুর্বল হিমালয়। আবার মনে পড়ছে ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথের সেই সতর্কবার্তা— “প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তার পরে আসে বিনাশের পালা।”
সভাপতি, পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)