সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটেকে সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয় ১৯২৫ সালে কানপুরে। কেউ বলেন, ১৯২০-তে তাসখন্দে এ দেশের পার্টির জন্ম। কেউ আবার বলেন যে ১৯৩০ সালে এক কর্মসূচি গ্রহণ করে পার্টি এক বাস্তব আকার ধারণ করে। সে যা-ই হোক, কানপুর সম্মেলনকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির জন্মক্ষণ রূপে ধরা যেতে পারে।
পেরিয়ে গিয়েছে একশো বছর। পার্টি নানা ভাবে ভাগ হয়ে গেছে এই সময়ে। ১৯৬৪-র বিভাগের ফলে জন্ম নিয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী)। ১৯৬৭-৬৯’এ আবার কমিউনিস্ট আন্দোলনে ভাগ হয়েছে। অধিকতর বামপন্থী মতাদর্শে চালিত যোদ্ধারা কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) থেকে বেরিয়ে আসেন। এবং ১৯৭০-এ গঠন করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী)। ১৯৭৩-এ এই পার্টি আবার বিভক্ত হয়। জন্ম নেয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) লিবারেশন। এতেও বিভাজন শেষ হয়নি। ২০০৪-এ দু’টি স্বাধীন ভাবে পরিচালিত বিপ্লবী গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)।
জটিল পরম্পরা। সাদা-কালো দিয়ে বিভ্রান্তির অবসান হবে না। এই পার্টির জন্মই বা কবে? আর কে-ই বা প্রকৃত পার্টি? ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বহুধাবিভক্ত এই চেহারার সামনে ইতিহাসবিদরা বিহ্বল। নানা নামের কমিউনিস্ট সংগঠনও মোটের উপর চুপ। যেন এই শতাব্দীব্যাপী ঐতিহ্য তাঁদের কাছেই এক প্রহেলিকা।
এই সব বিভাজন শুধু দলীয় কলহ ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পরিণাম, এমন বলা যাবে না। কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনে এই একাধিক ধারার ছাপ রয়ে গেছে ভাল মন্দ দুই অর্থেই। কমিউনিস্ট পার্টিগুলি ‘বাম ও গণতান্ত্রিক’ হওয়ার চেষ্টা করেছে। চেষ্টা করেছে গণভিত্তিসম্পন্ন বামপন্থী পার্টিরূপে আবির্ভূত হওয়ার। প্রশ্ন জাগে, কমিউনিস্ট আদর্শকে পিছনে রেখে এই রূপান্তরের প্রয়াস ও অভিজ্ঞতার কোনও বিশ্লেষণ আজও হয়েছে কি?
শতবর্ষ নিশ্চয়ই উদ্যাপিত হবে। কিন্তু কী হবে ওই উদ্যাপনের মূল কথা? পার্টির অবস্থা আরও সঙ্কুল হয়েছে নয়া-উদারনীতিবাদের আগ্রসনে। অন্য দিকে, গণসংগ্রাম আজও চলছে, কোথাও কোথাও তীব্র ভাবে। শ্রেণিসংঘর্ষ, গণপ্রতিরোধ, ও ন্যায়ের দাবিতে অভিযান, ঠিক যে সব সামাজিক প্রবণতার সঙ্গে আমরা সাম্যবাদী আন্দোলনকে চিহ্নিত করি, আজও অব্যাহত। অর্থাৎ, কমিউনিস্ট পার্টির অধোগতি ও অবক্ষয় স্পষ্ট, কিন্তু কমিউনিজ়মের স্পৃহা আজও জীবন্ত। একশো বছরে এসে এই বৈপরীত্যই সত্যিকারের বাস্তব।
কমিউনিস্ট পার্টি জানত যে সংসদীয় ব্যবস্থাকে আলিঙ্গন করার পর তার জীবনপ্রণালী পাল্টে যাবে। এখন এই সংসদীয় ব্যবস্থাই আবার নয়া-উদারনীতিবাদী আঘাতে ধরাশায়ী। কমিউনিস্টরা এখন কী করবেন? বিশ্বায়ন, দ্রুত অর্থলাভ, ঋণ ও সুদের খেলা, মৌলবাদী আগ্রাসন এবং এক প্রযুক্তিবিদ শ্রেণির আবির্ভাব দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গ্রাস করেছে। অন্য দিকে, পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মপরিস্থিতি নিদারুণ সঙ্কটময় হয়ে উঠছে। এই পরিস্থিতিতে বয়সের ভারে ন্যুব্জ পার্টির সুযোগ কোথায়?
এক দিকে সমাজের শ্রেণি কাঠামোর স্থায়ী চেহারা ভেঙে যাচ্ছে। শ্রমিক, কৃষক, এমনকি ছোট পুঁজিপতি, সবারই চরিত্র অস্থিতিশীল। কৃষক এখন আধা সময়ের খনি শ্রমিক বা নির্মাণশিল্পের শ্রমিক। স্থিতিশীল শুধু কর্পোরেট জগৎ। এরই মধ্যে কল্যাণকামী ব্যবস্থাগুলি ক্রমাগত সঙ্কুচিত হচ্ছে। জনসাধারণের সহায়তা বলতে শুধু সমব্যথী কিছু প্রাদেশিক সরকার।
এই জনবাদী রাজ্য প্রশাসনের অস্তিত্ব দেখিয়ে দেয় যে বামপন্থী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ আন্দোলনগুলির প্রভাব নিঃশেষ হয়ে যায়নি। একমাত্র অতি-দক্ষিণপন্থী দল ও তাদের অনুগামীদের বাদ দিলে অন্য সব রাজনৈতিক দল, যারা সামাজিক ন্যায় বা মর্যাদা বা পরিবর্তনের কথা বলে, সবাই কোনও না কোনও ভাবে বামপন্থী আদর্শে প্রভাবিত, এই শতাব্দীব্যাপী পরম্পরার সৃষ্টি। এ এক বিচিত্র পরিস্থিতি। কমিউনিস্ট পার্টির শক্তি নগণ্য, কিন্তু তাদের দীর্ঘকালীন অস্তিত্বের প্রভাব ব্যাপক। সবাই মোটের উপর বামপন্থী। কিন্তু খুব কম লোকই কমিউনিস্ট। এ দিকে গণতান্ত্রিক হল প্রত্যেকে।
এই গণতন্ত্রীকরণের মূল্য চোকাতে হয়েছে সামাজিক ন্যায়ের আদর্শকে ও সংগ্রামকে বিসর্জন দিয়ে। কাজেই, নিম্নবর্ণ, জনজাতি ও মেয়েদের সংগ্রামের বদলে গুরুত্ব পেয়েছে পার্লামেন্টারি সংগ্রাম, ভোটের সাতকাহন, সরকারি ক্ষমতা দখল। আমূল সামাজিক রূপান্তরের লক্ষ্য ও ভাষার বদলে প্রাধান্য পেয়েছে মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক লক্ষ্য ও ভাষা।
ফলে, জাতি ও শ্রেণি, এই দুইয়ের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে শতাব্দী শেষে কোনও পর্যালোচনা হবে না, আত্মসমীক্ষা হবে না। শুধু নিরন্তর প্রয়াস চলবে সংসদীয় ক্ষমতা বিস্তারের। নয়া-উদারনীতিবাদী যুগের গোড়ায় এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন শক্তিশালী ছিল। সংসদ ও বিধানসভায় পার্টির সদস্যসংখ্যা বেড়েছিল। তার পর যত অর্থনৈতিক সংস্কার হল, রাজ্যের ক্ষমতা সঙ্কুচিত হতে শুরু করল, শ্রমিক কৃষক-সহ মৌলিক শ্রেণির গঠনকাঠামোয় শৈথিল্য এল, ব্যাপক হারে শ্রমিক কৃষক পরিযায়ী হতে শুরু করল, কমিউনিস্ট দলগুলির রণকৌশল ততই ব্যর্থ হতে থাকল। নিম্নবর্ণের ও আদিবাসী জনসাধারণের সংগ্রাম ও সংখ্যালঘুদের নিজস্ব অধিকার বজায় রাখার প্রয়াস থেকে সংসদীয় বামপন্থী পার্টিগুলি সরে এল। তারা অগ্রাধিকার দিল ‘বামপন্থী’ হয়ে টিকে থাকার জন্য। কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ গেল জলাঞ্জলিতে।
কোভিড অতিমারির পর এই নিম্নগামী প্রবণতা আরও স্পষ্ট। পুরনো ধাঁচের গণসংগঠনের উপযোগিতা গেছে কমে। শহরগুলির চেহারা পাল্টাচ্ছে। অসংগঠিত, পরিযায়ী শ্রমিকের ছড়াছড়ি। এখন শহরে সহমর্মিতা ও সহযোগিতাকে অবলম্বন করে অধোবর্গের মধ্যে এক নতুন ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। সেবা, যত্ন, সুরক্ষাকে কেন্দ্র করে নারী সমাবেশ তো হচ্ছেই, আরও নানা নতুন ধরনের সমাবেশ দেখা যাচ্ছে। নতুন জনবাদী রাজনীতিতে এই পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কমিউনিস্ট দলগুলি তা থেকে বহু যোজন দূরে।
আছে ধর্মীয় সত্তার প্রাধান্যও। নাগরিক ধর্মীয়তার উত্থান এক নতুন জাতীয় ধর্ম তৈরি করার চেষ্টায় আছে। লোকায়ত রাজনীতি কী ভাবে এর মুখোমুখি হচ্ছে— তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যত্র— কমিউনিস্ট পার্টিগুলির এ থেকে শেখার কিছু নেই। তাঁরা সব জানেন। সংগ্রামের ব্যাকরণের কোনও নতুন সংস্করণ তাঁদের লাগবে না।
কিন্তু, তা বলে এই একশো বছরে রাজনৈতিক ক্ষমতা করায়ত্ত করার কোনও সুযোগ কি আসেনি? এসেছে, একাধিক বার। দেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় কমিউনিস্ট উপস্থিতির স্বাক্ষর রাখা যেত। ১৯৬৭-৭৭’এ সেই সুযোগ আরও প্রত্যক্ষ ভাবে এসেছিল। ১৯৯০-এর দশকেও এসেছে।
কমিউনিস্টরা বলবেন, এমন কোনও সুযোগই ছিল না। ভারতীয় কমিউনিস্টরা নিজেদের দলকে লেনিনীয় দল রূপে ভাবতে চান। কিন্তু সঙ্কট, বিভিন্ন শর্ত ও পরিস্থিতি দিয়ে সংগ্রামকে তীব্র করার সুযোগ: এই ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বাদ দিলে লেনিনীয় রাজনীতির আর কী বাকি থাকে? আজ কমিউনিস্ট পার্টির এমন কোনও বৈশিষ্ট্য নেই যা বিভিন্ন জনবাদী দলে পাওয়া যাবে না। ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন, গণশাখা, প্রচারযন্ত্র, সমাজকল্যাণমুখী সরকারি সংস্কারমূলক কর্মসূচি, রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা: সবই আজ জনবাদী বা লোকায়তিক রাজনীতির অংশ।
অন্য দিকে, বর্ণপ্রথার অবসান, নারীমুক্তির প্রশ্ন, পরিবেশ, পরিযায়ী শ্রমিক সুরক্ষা, নানা গোষ্ঠীর স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষা, এই সবই নতুন কর্মসূচি দাবি করে। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও, যেখানে কমিউনিস্টরা সবই জাতি-রাষ্ট্রের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিস্তব্ধ আছেন, সেখানেও নতুন নীতি ও উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল। না কি কমিউনিস্ট পার্টি রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ ও নিরাপত্তাবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে? কেন তাঁদের কণ্ঠস্বর এত স্তিমিত?
অথচ কমিউনিস্ট পার্টিই এই সব নতুন কাজের জন্য সর্বোত্তম শক্তি হতে পারত। লেনিন বলেছিলেন, বলশেভিক দল সব জনগণের মঞ্চ তাঁদের মুখপত্র। চেয়ারম্যান মাও তার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সাবধানবাণী, পার্টিকে বিনয়ী হতে হবে। ভুল স্বীকার করতে হবে। শতবর্ষে এসে এ দেশের কমিউনিস্টরা সেই ভুল কি স্বীকার করবেন?
শিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদের যুগ শেষ। সংসদীয় রাজনীতির সার্বভৌমত্বের দিনও তার সঙ্গে শেষ। লোকায়তিক রাজনীতি, তা ডান দিকেই হোক বা বাম দিকেই— আজ এ দেশের রাজনীতিকে নির্ধারণ করছে। লোকায়তিক রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গ বা তামিলনাড়ু বা কেরল বা অন্য কোনও রাজ্যের উদাহরণ থেকে কমিউনিস্টদের শিখতেই হবে। লোকায়ত দলগুলির এত কমিটি, পার্টি কংগ্রেস, কমিশন, কর্মসূচি থাকে না, কিন্তু এক নির্দিষ্ট স্টাইল থাকে যা লোকায়ত রাজনীতিতে শক্তি জোগায়।
আর, না শিখলে, শেষ অবধি খালি এটাই বলার থাকবে, আমরা একশো বছর বেঁচেছিলাম।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)