Advertisement
১২ অক্টোবর ২০২৪
Deepthi Jeevanji

সহানুভূতি নয়, সমানুভূতি

২০২৪ প্যারালিম্পিক্সে ভারত পেয়েছে ২৯টা পদক। তার মধ্যে ৭টা সোনা, যা কিনা এ বারের ভারতীয় অলিম্পিক দলের পুরো পদকসংখ্যার থেকেও বেশি!

সারস্বত সেন
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৩
Share: Save:

জন্মের পর থেকেই মাথা, নাক-মুখের গড়ন দেখে প্রতিবেশীর বাঁকা হাসি, কানাকানি। মা-বাবা কষ্ট পেলেও কান দেননি। একটু বড় হতে যখন বোঝা গেল মেয়ের কথা বলতে, বুঝতে ও বোঝাতে সমস্যা হয়, লোকে বলল পাগল। বলল, “এই বাঁদরমুখো মেয়ের তো বিয়ে হবে না গো!” তবু হাল ছাড়েনি দিন-আনি-দিন-খাই পরিবারটি, ভাগ্যিস! সেই মেয়েই প্যারিস প্যারালিম্পিক্সে ৪০০ মিটার দৌড়ে ব্রোঞ্জ জয়ী। দেশে ফেরা, ঘরে ফেরা দীপ্তি জীবঞ্জীকে দেখতে এখন কতই না ভিড়!

ফোকোমেলিয়া-আক্রান্ত শীতল দেবীর (ছবি) তিরন্দাজির বুল’স-আই হিট এখন ভাইরাল। ছোট থেকেই দু’হাতের স্বাভাবিক গড়ন হয়নি, শুধু পায়ের জোরেই তরতরিয়ে গাছে উঠত মেয়ে। তাঁর ‘দস্যিপনা’ নজর কাড়ে ভারতীয় সেনার, শীতলের চিকিৎসা, পড়াশোনার ভার নেয় তারা। ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্যারা-পদকজয়ীর প্রেরণা তাঁর মা। হাই জাম্পে রুপো জয়ী নিষাদ কুমারেরও তা-ই। অল্পবয়সে দুর্ঘটনায় ডান হাত খোয়ানো নিষাদকে খেলায় জুড়ে দিয়েছিলেন তাঁর মা। গোড়ায় কুস্তিতে, পরে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড-এ, শেষে হাই জাম্পে। নাগাল্যান্ডের হোকাতো সেমা ছিলেন আর্মিতে, ‘অন-ডিউটি’ বোমা বিস্ফোরণ হল, বাঁ পা’টি গেল। প্যারিসে ছেলেদের শট পাটে ব্রোঞ্জ জিতেছেন সেমা!

২০২৪ প্যারালিম্পিক্সে ভারত পেয়েছে ২৯টা পদক। তার মধ্যে ৭টা সোনা, যা কিনা এ বারের ভারতীয় অলিম্পিক দলের পুরো পদকসংখ্যার থেকেও বেশি! আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে এই দুর্দান্ত ফল এল যাঁদের হাত ধরে, তাঁদের জীবনসংগ্রাম কল্পনাতেও আসে না আমাদের। জুডোয় প্রথম বার ভারতকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পদক এনে দেওয়া কপিল পারমার ছোটবেলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারাই যাচ্ছিলেন। প্রাণে বাঁচলেন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি চলে গেল অনেকটা। ওই অবস্থাতেই চায়ের দোকান চালিয়ে সংসার টেনেছেন কপিল ও তাঁর ভাই। প্যারালিম্পিক্সে পদকজয়ীদের তালিকায় আছেন আইআইটি-র স্নাতক, ভেটেরিনারি সায়েন্স পড়ুয়া থেকে আইনের ছাত্র, তেমনই সুহাস যতিরাজের মতো আইএএস-ও: গৌতম বুদ্ধ নগরের জেলাশাসক রোজ সন্ধেয় ব্যাডমিন্টন চর্চা চালিয়ে গিয়েছেন!

শুটিংয়ে অবনী লেখরা, জ্যাভলিনে সুমিত অন্তিল-নবদীপ সিংহ, ব্যাডমিন্টনে তুলসীমতী মুরুগেসান, তিরন্দাজিতে হরবিন্দর সিংহ— সবার জীবনে প্রতিকূলতার রূপ ভিন্নতর। ‘বিধির বাঁধন’ ছিঁড়েছেন ওঁরা ইচ্ছাশক্তি, অধ্যবসায় আর হাতে গোনা প্রিয়জনের উৎসাহে। ওঁদের সাফল্যকে মূলত সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে ওঁদের শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধকতার তুলাদণ্ডে। ব্যাখ্যাটা এ রকম: ওঁদের বিস্তর অপ্রাপ্তি, তাই ওঁদের সাফল্য চমকে দেওয়ার মতো। তলিয়ে ভাবলে এ কিন্তু আমাদের, ‘স্বাভাবিক’দের সক্ষমতার পক্ষেই সওয়াল করা। প্যারিস প্যারালিম্পিক্সে ওঁরা সবাই কিন্তু প্রমাণ করে দেখালেন, সমাজের সহানুভূতি ওঁদের প্রয়োজন নেই, চাই সমানুভূতি। দক্ষতা বাড়ানো বা অনুশীলন, ও-সব ওঁরা নিজেরাই পারেন। ধ্যানীর একাগ্রতা, শ্রমনিষ্ঠের পরিশ্রম যাঁদের সঙ্গী, তাঁদের এই সাফল্য আসতই। সেই ফর্মুলায় নীরজ চোপড়া-মনু ভাকরদের সঙ্গে ওঁরা সর্বদা একাসনে। আমাদের এত দিনে ঘুম ভেঙেছে বলে তো সত্যটা বদলে যাবে না! আমাদের বিশ্বাস, শারীরিক ও বৌদ্ধিক ভাবে ত্রুটিহীন হওয়াই অস্তিত্বের মাপকাঠি। যে ‘সক্ষম’ সমাজে এখনও জাতপাত, বর্ণ, গায়ের রং, অর্থনৈতিক অসাম্য, যৌনপরিচয় নিয়ে জলঘোলা হয় নিরন্তর, সেখানে বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের কোন চোখে দেখা হয়, তা সহজেই অনুমেয়।

গত জুলাইয়ে ফ্রান্সের রাস্তায় অলিম্পিকের মশাল রিলে অনুষ্ঠানে রথী-মহারথীদের সঙ্গে ছিলেন ফানেলি ক্রোয়াইজ়াৎ-ও। ফানেলি ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত, ফ্রান্সের স্পেশাল অলিম্পিক্স দলের সদস্য, সাঁতার ও বাস্কেটবলে পারদর্শী। ভারতেরও স্পেশাল অলিম্পিক্স দলে আছেন ডাউন সিনড্রোম, অটিজ়ম-সহ নানা কগনিটিভ ডিজ়অর্ডারে আক্রান্ত ক্রীড়াবিদরা। গত বছর বার্লিনে স্পেশাল অলিম্পিক্স ওয়ার্ল্ড সামার গেমস-এ ভারতের ক্রীড়াবিদরা নানা ইভেন্টে একশোর বেশি পদক জিতেছেন, ক’জন সে খবর রাখি? বছরভর ক্রিকেট-ফুটবলের বাঘা টুর্নামেন্টগুলো টিভির পর্দায় চলুক ক্ষতি নেই, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের প্যারা গেমস, স্পেশাল গেমস-এর আন্তরিক প্রচারে বাধা কিসে?

‘ইনক্লুসিভিটি’, ‘অ্যাকসেসিবিলিটি’-র মতো শব্দ আজ অ্যাকাডেমিক স্তরে বহুব্যবহৃত, কিন্তু সমাজবাস্তবে তাদের উপস্থিতি এই একুশ শতকেও যৎসামান্য। রাস্তাঘাট থেকে রেস্তরাঁ, বাস-ট্রেন থেকে শপিং মল-হোটেল, হুইলচেয়ারে বদ্ধ বা ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত কোনও নাগরিক কি নিজের ইচ্ছেমতো যেতে-আসতে পারবেন, সামাজিক আনন্দ-অনুষ্ঠানের অংশীদার হতে পারবেন— তাঁদের পরিবারের সাহায্য ছাড়াই? যোগ্যতা সত্ত্বেও চাকরিক্ষেত্রে এঁদের কতটা সুযোগ দেওয়া হয়? খাতায় কলমে সুযোগ দিলেও, মন থেকে ওঁদের মেনে নেওয়া হয় কতটা?

কলকাতার রাস্তায় অটিস্টিক যুবক নিগ্রহে আমাদের সমাজ-সচেতনতা নীরব থাকে। জানা যায় অভিযুক্তরা পূর্বপরিচিত, প্রায়ই মশকরা করত। এমন কত উপেক্ষা, ঠাট্টা, নিগ্রহ সহ্য করে যেতে হয় ওঁদের— যাঁদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে ভবিষ্যতের তারকারা। প্যারিস প্যারালিম্পিক্সে সোনাজয়ী নবদীপ সিংহ আসল কথাটা বলেছেন, “সমাজকে এই শিক্ষা দেওয়ারও প্রয়োজন ছিল, আমাদের মতো মানুষরাও এই পৃথিবীতে বেঁচে রয়েছেন, আমরাও দেশকে গর্বিত করার ক্ষমতা রাখি। আমাদের নিয়ে কারও ব্যঙ্গ বা রসিকতা করার অধিকার নেই।”

ওঁর ছোড়া জ্যাভলিনটা একেবারে ঠিক জায়গায় বিদ্ধ করেছে।

অন্য বিষয়গুলি:

Deepthi Jeevanji Paralympics 2024
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE