সম্প্রতি একটি ইংরেজি শব্দ বহুলব্যবহারে বাংলা হয়ে উঠল— ‘এক্সপাঞ্জ’। ঘটনার সূত্রপাত ১৯ জুন। বিধানসভায় মাননীয় অধ্যক্ষের নির্দেশে, পশ্চিমবঙ্গ বিক্রয় কর (বিবাদ নিষ্পত্তি) (সংশোধনী) বিল, ২০২৫-এর উপরে বিরোধীদের সব বক্তব্য রেকর্ড থেকে মুছে ফেলা হল। এই মুছে ফেলার প্রক্রিয়াটিকেই ইংরেজিতে বলে ‘এক্সপাঞ্জ’।
বিধানসভায় সাংবাদিকদের উপরে নানা রকম নিষেধাজ্ঞা আছে— ছবি বা ভিডিয়ো তোলা বেআইনি, সভার কার্যক্রম সরাসরি সম্প্রচার করা যায় না। একটা রহস্যজনক গোপনীয়তার পরিবেশ। এই প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছিলেন: “কেন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় এত গোপনীয়তা? সভায় কি সব সময় অপারেশন সিঁদুরে পাকিস্তানের কোন কোন সন্ত্রাসের ঘাঁটিতে মিসাইল আক্রমণ করা উচিত, এই ধরনের আলোচনা হয়?” আমার কাছে কোনও উত্তর না থাকায় তিনি নিজেই বললেন, “না কি, আপনারা মাঝেমধ্যেই এমন এমন বেফাঁস কথা বলে ফেলেন বা এমন আচরণ করে ফেলেন যে, তা প্রমাণসমেত প্রকাশ হলে বিধানসভার মর্যাদাহানি হবে, আর এ সম্বন্ধে কেউ কোনও বিরূপ মন্তব্য করলে সাক্ষ্য থাকার ফলে তাঁর বিরুদ্ধে বিধানসভার মানহানি বা ‘ব্রিচ অব প্রিভিলেজ’ বা স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ আনা যাবে না?” আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠল ২০০৬-এর ৩০ নভেম্বর— রাজ্যে তখনও বাম শাসন; আজকের শাসকপক্ষ তখন বিরোধী। সে দিন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কুরুক্ষেত্র— চেয়ার-টেবিল ধ্বংস হয়েছিল, এবং কিছু বিধায়কের উপরে আর্থিক জরিমানা ধার্য হয়েছিল। বন্ধুবরের সামনে মৌনব্রত পালন ছাড়া আমার আর উপায় রইল না।
এ বার সাম্প্রতিক বিতর্কের ব্যাপারে আসি। এ কথা অনস্বীকার্য, যে কোনও প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বা পরিচালকের মতো বিধানসভার অধ্যক্ষও সভায় নিয়ন্ত্রণ বা সেন্সরশিপের ক্ষমতার অধিকারী। যে কোনও বক্তৃতা, যা স্পিকারের বিবেচনায় সাধারণের মঙ্গলের বিঘ্ন ঘটাতে পারে, তা পরিবর্তন, দমন বা নিষিদ্ধ করতে পারেন তিনি। এই নিয়ন্ত্রণের সুনির্দিষ্ট রুলস বা নিয়মপদ্ধতি বিধানসভার কার্যপ্রণালী ও কার্য পরিচালনার বিধিতে লিপিবদ্ধ আছে। ৩৫৫ ধারার প্রথম শর্তে বলা হয়েছে, যদি স্পিকার মনে করেন যে, বিতর্কে ব্যবহৃত শব্দসমূহ নিন্দাসূচক, অশালীন, অসংসদীয়, মর্যাদাহানিকর বা অন্য কোনও ভাবে অনুপযুক্ত, তা হলে তিনি নির্দেশ দিতে পারেন যে, সেই শব্দসমূহ সংসদের কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেওয়া হোক।
এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং গভীর ভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, নিয়মপদ্ধতি অনুসারে ‘এক্সপাঞ্জ’-এর সিদ্ধান্তটি শুধু বক্তার বক্তব্যের উপরে নির্ভরশীল— তিনি অন্য কোনও দোষে দোষী কি না, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এক জন বক্তা চুরি, ডাকাতি কিংবা অশালীন বা অভদ্রোচিত ব্যবহারের জন্য অভিযুক্ত হলে অন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তাতে তাঁর বক্তব্য ‘এক্সপাঞ্জ’ করার কোনও ব্যবস্থা নিয়মপদ্ধতিতে নেই। স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ আনা যায়, বিধায়ককে নিলম্বিত করা যায়, এমনকি গুরুতর অপরাধে বহিষ্কারও করা যায়। কিন্তু, বক্তব্য ‘এক্সপাঞ্জ’ করা যায় না। কেননা, ভূতের মুখেও তো রাম নাম শোনা যায়!
এ কথাও শোনা যায় যে, ১৯ জুন বিরোধীরা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনেছিলেন যে, তিনি ১৭ জুন ভুল তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন। ‘এক্সপাঞ্জ’ করার ফলে সেই অভিযোগও নথিভুক্ত থাকল না। মন্ত্রী বলেছিলেন যে, ‘প্রেস্ক্রাইবড’ এবং ‘স্পেসিফায়েড’ সমার্থক। একই কথা বার বার বললে শুনতে একঘেয়ে লাগে, তাই আইনের বিভিন্ন জায়গায়, নাটক-নভেলের মতো, কখনও এটা কখনও ওটা ব্যবহার করা হয়েছে। বিরোধীরা বলেন যে, এটা সঠিক নয়। পশ্চিমবঙ্গ বিক্রয় কর (বিবাদ নিষ্পত্তি), ১৯৯৯ আইনের ২ নম্বর ধারার মধ্যে সংজ্ঞায় স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, ‘নির্ধারিত’ বা ‘প্রেস্ক্রাইবড’-এর অর্থ এই আইনের অধীনে প্রণীত বিধির দ্বারা নির্ধারিত। ওয়েস্টমিনস্টার মডেলের সংসদীয় গণতন্ত্রে, সভাকে বিভ্রান্ত করা অত্যন্ত ঘোরতর অপরাধ। অনেক দেশে এর জন্য মন্ত্রীদের পদত্যাগও করতে হয়।
বিরোধী এবং শাসক দলের বিতর্কের মূলে রয়েছে প্রশ্ন: পশ্চিমবঙ্গ বিক্রয় কর (বিবাদ নিষ্পত্তি) (সংশোধনী) বিল, ২০২৫-এর উপর বিরোধীদের বক্তব্য রেকর্ড থেকে মুছে ফেলার সিদ্ধান্তের ভিত্তিটি কী— বিরোধীরা কী বলেছেন, সেটা; না কি অন্য কোনও কারণ আছে? এটি আইনি প্রশ্ন এবং এর নিষ্পত্তি আইনজ্ঞরা করতে পারবেন। আজকের আলোচনা একটি বৃহত্তর প্রশ্নে— বিধানসভার আলোচনা এবং বিধানসভায় কী হচ্ছে, সে বিষয়ে গোপনীয়তার প্রয়োজন এবং যৌক্তিকতা।
এ কথা সত্য যে, ভারতীয় গণতন্ত্রের গরিমা কখনও কখনও— কেউ বলতে পারেন, প্রায়শই— বিধায়ক এমনকি সাংসদদের আচরণে এবং বক্তব্যে লাঘব হয়েছে। কিন্তু শাক দিয়ে মাছ ঢেকে লাভ কী? জনগণ দেখুন, জনগণ শুনুন তাঁদের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা কী করছেন, কী বলছেন। অধ্যক্ষ মহোদয়ের পরিশোধনের পরে নয়, একেবারে কাঁচা বা অপরিমার্জিত অবস্থায় তথ্য জানাটা জনগণের মৌলিক অধিকার। লোকতন্ত্রে জনতা জনার্দনই সর্বোচ্চ ধর্তা, কর্তা ও বিধাতা। ওঁরা দেখে শুনে বিচার করুন— কোন ব্যবহার এবং বক্তব্য গ্রহণযোগ্য, আর কোনটা নয়। কাদের কাদের ওঁরা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে ঠিক করেছেন বা ভুল করেছেন। বিধায়কদের বক্তব্য ‘এক্সপাঞ্জ’ না করে, ওঁরা যা বলেছেন, যেমন ভাবে বলেছেন, সেটা জনগণকে শুনতে দিন, দেখতে দিন।
‘এক্সপাঞ্জ’-এর ব্যবস্থাটা সেন্সরশিপ বা নিয়ন্ত্রণের একটি রূপান্তর। সেন্সরশিপ একটি বিতর্কিত বিষয়। অন্যান্য বিষয় তো ছেড়েই দিন, নৈতিকতা রক্ষার জন্য যৌন উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী পর্নোগ্রাফি বা অশ্লীল উপাদানের সেন্সরশিপ নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিতর্ক আছে। আর বিধানসভার কার্যক্রম তো সে রকম কিছু নয়। সেন্সরশিপ বলতে বোঝানো হয় তথ্য, মতামত, সংবাদ, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, শিল্পকর্ম বা অন্য যে কোনও যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়বস্তুকে রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ, বাদ দেওয়া বা পরিবর্তন করে দেওয়া। এর ঘোষিত উদ্দেশ্য হল সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং নৈতিকতা রক্ষা করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সেন্সরশিপ অনেক সময় শাসক দলের রাজনৈতিক বিরোধিতা দমনের অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মর্তব্য: “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?”
বলতে পারেন বিধানসভায় দর্শকবৃন্দের জন্য গ্যালারি তো আছেই— যে কেউ চাইলে গিয়ে স্বচক্ষে দেখতে পারেন কে কী বলছেন, কেমন আচরণ করছেন। গ্যালারি আছে বইকি, কিন্তু তাতে আসনসংখ্যা সীমিত এবং স্থানাভাবে এক-এক জন দর্শককে সীমিত সময় থাকতে দেওয়া হয়। তা ছাড়া দূরদূরান্ত থেকে নাগরিকদের বিধানসভায় আসাটাও খরচসাপেক্ষ এবং কষ্টকর। এই যুক্তিতেই সংসদে টেলিভিশন সম্প্রসারণ শুরু করা হয় ১৯৮৯ সালে। তার পর দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। এখন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার কার্যক্রম লাইভ টেলিকাস্ট করতে আপত্তি কী?
বিধানসভার জানালা-দরজা এখন সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ। মনে আছে, ১৯৮৭ সালের ১২ জুন, তদানীন্তন পশ্চিম জার্মানি নিয়ন্ত্রিত পশ্চিম বার্লিনের ব্রান্ডেনবার্গ দুয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগন সোভিয়েট ইউনিয়নের সর্বোচ্চ নেতা মিখাইল গর্বাচেভকে বলেছিলেন, “খুলে দিন ওই গেট, মিস্টার গর্বাচেভ, ভেঙে ফেলুন এই দেওয়াল!” তার দু’বছর পরে, ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর ব্রান্ডেনবার্গ গেট সংলগ্ন দেওয়াল খুলে দেওয়া হয়, আর তারও ছ’সপ্তাহ পরে ২২ ডিসেম্বর ব্রান্ডেনবার্গ গেট খুলে যায়।
তার পর শুধু জার্মানির দানিউব এবং রাইন নদী দিয়ে নয়, পশ্চিমবঙ্গেও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। কিন্তু বিধানসভার জানালা-দরজা বন্ধই রয়ে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের জনগণ কি বিধানসভার অধ্যক্ষ এবং মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি করতে পারেন না: বিধানসভার জানালা-দরজা খুলে দিন, সাংবাদিকদের অবাধ ভাবে বিধানসভায় বিচরণ এবং খবর করতে দিন, বিধানসভার কার্যক্রম লাইভ টেলিকাস্ট করুন?
বিধায়ক, বিজেপি, পশ্চিমবঙ্গ
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)