E-Paper

মধ্যপন্থার দাম দেওয়া যাবে তো

শুধু ইরানের ক্ষেত্রেই নয়, সম্প্রতি প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রেও ভারতের নীতির কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। গাজ়ায় মানবিক সঙ্কট তীব্র বিন্দুতে চলে যাওয়ার পরও ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোট দেয়নি ভারত।

সৌরজিৎ দাস

শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ ০৭:০৯

দু’টি ঘটনা। ১২ জুন প্যালেস্টাইনে সামরিক আগ্রাসন বন্ধের জন্য ইজ়রায়েল-এর উপর চাপ সৃষ্টি করতে একটি খসড়াপ্রস্তাবে ভোটাভুটি হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সম্মেলনে। ভারত সেখানে ভোট দেয়নি। ঠিক তার দু’দিন পরেই ইরানে আক্রমণের জন্য শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাজ়েশনের বৈঠকে চিন-সহ একাধিক রাষ্ট্র ইজ়রায়েলকে ভর্ৎসনা করলেও, তাতে অংশগ্রহণ করেনি ভারত। বরং ভারত সরকারের তরফে দু’পক্ষকেই কূটনীতি ও সংলাপে ফিরে আসার ডাক দেওয়া হয়। এ দিকে, গত সপ্তাহেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের খাতিরে ইজ়রায়েলের সঙ্গে তাদের বিরোধের মাঝেই ভারতীয় নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেদের আকাশসীমা খুলে দিয়েছিল ইরান। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, যে রাষ্ট্রটির সঙ্গে এত কাল ভাল সম্পর্ক রেখে এসেছে দিল্লি, হঠাৎ কি তাদের ক্ষেত্রে নীতি বদল হল?

শুধু ইরানের ক্ষেত্রেই নয়, সম্প্রতি প্যালেস্টাইনের ক্ষেত্রেও ভারতের নীতির কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। গাজ়ায় মানবিক সঙ্কট তীব্র বিন্দুতে চলে যাওয়ার পরও ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপুঞ্জে ভোট দেয়নি ভারত। তবে কি প্যালেস্টাইনের থেকে ইজ়রায়েলকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে দিল্লি? অথচ প্যালেস্টাইনের প্রতি ভারতের সমর্থন আজকের নয়। এর শুরু ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে ১৮১ নম্বর প্রস্তাবের অনুমোদনের সময় থেকে, যেখানে প্যালেস্টাইনকে আলাদা ইহুদি এবং আরব রাষ্ট্রে ভাঙার আহ্বান জানানো হয়। সেই সময় ভারত ছিল অ-আরব রাষ্ট্রগুলির অন্যতম, যারা ১৯৭৪ সালে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজ়েশন’ (পিএলও)-কে এবং ১৯৮৮-তে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রকেও স্বীকৃতি দেয়। তখন থেকেই ধারাবাহিক ভাবে ইজ়রায়েলের পাশাপাশি একটি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন করে এসেছে ভারত। অন্য দিকে, ইজ়রায়েলের সঙ্গে ভারতের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয় অনেক পরে, ১৯৯২ সালে।

গত এক দশকে দেখা গিয়েছে, মোদীর ভারত ক্রমেই ইজ়রায়েল-এর সঙ্গে একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক জোটের দিকে এগোতে শুরু করেছে। বোঝা কঠিন নয়, হিন্দুত্বের পুনরুত্থানের পর ভারতের সঙ্গে ইজ়রায়েলের ইহুদিবাদের আদর্শগত মিল রয়েছে অনেকখানি। দু’টি দেশই নিজেদের ‘শত্রু-বেষ্টিত’ মনে করে। নিজেদের একটি ‘শক্তিশালী রাষ্ট্র’ হিসাবে দেখাতে চায়। ফলে স্বাভাবিক কূটনৈতিক কারণেই গত এক দশকে ভারত ইজ়রায়েল-এর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে— বিশেষত, প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে। গত মাসে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে ভারতকে ইজ়রায়েলের তৈরি বিভিন্ন অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছে। সুতরাং অনুমান করাই যায়, বর্তমান ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে দিল্লির কাছে প্যালেস্টাইন সঙ্কটের তাৎপর্য বেশ খানিক পাল্টেছে। যে সঙ্কটের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, তাতে পক্ষগ্রহণ এড়িয়ে চলতে চাইছে দিল্লি।

প্রশ্ন হল, ইরানের ক্ষেত্রেও কি এই একই পন্থা নেবে দিল্লি, ইজ়রায়েলের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের খাতিরে? পশ্চিমি দেশগুলি বহু কাল ইরানকে একঘরে করে রেখে এলেও গত কয়েক দশক ধরে নিজেদের মধ্যে সুসম্পর্কই বজায় রেখে এসেছে দিল্লি ও তেহরান। এমনকি কাশ্মীর এবং ভারতে সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ নিয়ে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই বার কয়েক সমালোচনা করলেও, তার প্রভাব পড়েনি দুই দেশের সম্পর্কে। ২০০১ সালের এপ্রিলে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য ইরান সফর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী, তেহরান ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে দুই দেশ। ২০১৬ সালে তেহরান সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মোদী, যেখানে তিনি ভারত, ইরান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য, পরিবহণ এবং যাতায়াত সংক্রান্ত ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই প্রেক্ষিতে, দিল্লির সাম্প্রতিক অবস্থানে তেহরানের খুশি না হওয়ারই কথা।

অবস্থান পরিবর্তনের ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য হতে পারে বিরাট। এক দিকে এই অঞ্চলে প্রায় ৯০ লক্ষ ভারতীয় প্রবাসী রয়েছেন, যাঁদের থেকে দেশে প্রচুর অর্থ আসে। ২০১৭ সালে ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পর ট্রাম্প ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানোর আগে, ইরান ছিল ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী। কিন্তু ইরান থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, ২০১৮-১৯’এর থেকে এর বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হয় ভারত। উদ্বেগ রয়েছে চাবাহার বন্দর নিয়েও, যেটিকে পাকিস্তানের গদর বন্দরের প্রতিযোগী হিসেবে তৈরি করছে ভারত। ওমান উপসাগরে ভারত ও ইরানের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই বন্দরে তৈরির জন্য ইতিমধ্যেই কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে দিল্লি। এ দিকে ফেব্রুয়ারিতে, ট্রাম্প দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর, ইরানের উপর নতুন নিষেধাজ্ঞায় অর্থনৈতিক চাপ দ্বিগুণ করেছে আমেরিকা। ইরানের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও আঞ্চলিক অস্থিরতার কারণে এই প্রকল্পটি ব্যাহত হলে ভারতের বড় ক্ষতি হতে পারে, এবং— সেই সুযোগে চিনের লাভ হতে পারে।

ইজ়রায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে আগামী দিনে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অনেকটাই সুবিধা পেতে পারে দিল্লি। কিন্তু তাতে তার পশ্চিম এশিয়ায় কৌশলগত স্বার্থ আহত হবে। ‘মধ্যপন্থা’-র এতটা দাম কি দিতে পারবে দিল্লি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Iran Isreal conflict palestine

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy