E-Paper

সব দোষ ‘বাবুদের বাড়ি’র?

পরিচারিকার পেশায় কেউ শখ করে আসেন না বা নিজের সন্তানকে কেউ এই পেশায় আনতে চান না। অর্থাৎ, তিক্ত সত্য হল এটাই যে, এঁরা নিজেরাই এঁদের পেশাকে সম্মান করেন না।

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:০০

সর্বদাই স্রোতের বিপরীতে কথা বলা বিপজ্জনক, বিশেষ করে তা যদি হয় শ্রমজীবী নিম্নবিত্ত মানুষের বিষয়ে, তা হলে কাজটা আরও কঠিন হয়। কিন্তু সামাজিক ভাবে বঞ্চিত মানুষদের হাতে প্রাপ্য অধিকার তুলে দিতে গেলে শুধু সহানুভূতিতে কাজ হয় না, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপও করতে হয়। গত জুনে গৃহশ্রমিক দিবস উপলক্ষে গৃহপরিচারিকাদের আন্দোলনের ছবি দেখে কথাগুলো আবার মনে হল। এই মাসি-পিসিরাই আমাদের বাসন ধোয়া, ঘর মোছা, কাপড় কাচার মতো কাজগুলো সামলে দেন সারা বছর। এঁরা একটি বিরাট সংখ্যক অসংগঠিত নারী-শ্রমিক, এখনও যাঁদের শ্রমিকের স্বীকৃতি নেই। বেশ কিছু বছর এঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা হচ্ছে। তাঁদের হয়ে সে-সব দাবি তুলে ধরেন যে সমাজকর্মীরা, এই লেখা তাঁদেরই জন্য। কারণ, এত বছরে পরিচারিকাদের দাবিগুলি সে ভাবে প্রতিষ্ঠিত হল না কেন, সেটা বুঝতে গেলে কিছুটা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ দরকার। অর্থাৎ, পরিচারিকাদের অবস্থান, অধিকার, দায়িত্বের পাশে তাঁদের সমস্যাগুলো যে জন্য গুরুত্ব ও সমর্থন পায় না, সেটাও ভাবা দরকার।

পরিচারিকাদের বিষয়ে যে কোনও আলোচনা শুরু হয় ওঁদের দুরবস্থা ও নিয়োগকারীদের প্রতি একতরফা অভিযোগ দিয়ে, আর খুব তাড়াতাড়ি তা কাজের লোক ও কাজের বাড়ির দোষ-গুণ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বৃত্তে ঢুকে পড়ে। দাবি ও অধিকারের কথা উঠতেই পারে না। ১৬ জুন কলকাতার একটি সংস্থা পরিচারিকাদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। সেখানে পরিচারিকাদের আঁকা কিছু পোস্টার থেকে সমাজমাধ্যম মারফত জানা গেল, তাঁদের ন্যূনতম বেতন, সপ্তাহে একটি ছুটি, পুজোয় বোনাস এবং ৫৫ বছর বয়সে পেনশন ইত্যাদি দাবি রয়েছে। নথিভুক্ত শ্রমিকের উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও সুবিধার দাবি তো সরকারের কাছে পেশ হওয়ার কথা। এঁদের অনেক দাবিও ২০১৭ সালে রাজ্যসভায় আনা ‘গৃহশ্রমিক বিল’-এ উল্লেখ করা আছে। কিন্তু সেই বিল এখনও আইন হল না কেন? সেই সব আলোচনার বদলে সমস্বরে ‘বাবুদের বাড়ি’কে কাঠগড়ায় তোলাটাই চোখে পড়ল। এমনকি যাঁরা এঁদের দাবিগুলি তুলে ধরছেন, তাঁরাও দেখলাম লড়াই, আন্দোলন, ভিউ, শেয়ার ইত্যাদি নিয়েই খুশি, ন্যূনতম গঠনমূলক আলোচনাতে আগ্রহী নন। ফলে দিনের শেষে আসল ছবিটা বদলানোর সম্ভাবনা তৈরিই হল না।

২৫ পাতা গৃহশ্রমিক বিলের যে সামান্য অংশ নিয়োগকারীর সঙ্গে কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে সরাসরি কথা বলে, সেইটুকু পড়লেও মনে হয় যাঁরা এই বিলের খসড়া রচনা করেছেন, এই বিষয়ে তাঁদের ধারণা আদৌ স্পষ্ট নয়। তাই গৃহশ্রমিকরা যদিও মূলত মহিলা, সর্বত্র তাঁদের ‘হি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটি, বার্ষিক ছুটি, বিশ্রাম ও শৌচালয় ব্যবহারের অধিকার, নিরাপত্তা, সম্মান ইত্যাদি নিয়েই যাবতীয় কথা হয়েছে, যেন এইগুলোই সবচেয়ে বড় কথা। কিন্তু তাঁদের ন্যূনতম বেতনের অঙ্কটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যে পরিচারিকারা দিনে এক-দু’ঘণ্টা হিসাবে বিভিন্ন পরিবারে কাজ করেন, এই সব শর্তের বেশির ভাগই তাঁদের স্পর্শ করে না। আর এইখান থেকেই এই আলোচনা শুরু হতে পারে।

প্রথমত, পরিচারিকারা নিঃসন্দেহে সামাজিক ভাবে বঞ্চিত ও শোষিত। কিন্তু সেই বঞ্চনার মূলে আছে এঁদের নিজেদের পরিবার, নিয়োগকারী নন। দ্বিতীয়ত, এঁদের ‘কাজের বাড়ি’টা কোনও লাভজনক ব্যবসা নয়, নিয়োগকারীও ‘মালিক’ নন, এমনকি সব সময় খুব উচ্চবিত্ত মানুষও নন। বরং এই অ-প্রশিক্ষিত মহিলা কর্মীদের কাছে এটা কিছুটা সহজ ভাবে উপার্জন করার একটা উপায়। যেমন, গ্রামের দিকে পনেরো-কুড়ি বছর আগেও ঘরের কাজ বাড়ির মেয়েরাই করে নিতেন। পরবর্তী কালে গ্রামের মহিলারা চাকরি করতে বেরোচ্ছেন বা তাঁদের আর্থিক উন্নতি হয়েছে, যে কারণে তাঁদের সংসারের কাজ করতে এসেছেন সেই মেয়েরা, যাঁরা চাষের মাঠে কাজ করতেন বা মাটি কাটতেন। এটি কিন্তু উভয়ের পক্ষেই সুবিধাজনক, কারণ এই সব কাজের চেয়ে ঘরের কাজে পরিশ্রম কম এবং নিজের সংসারও কিছুটা দেখাশোনা করা যায়। এই ভাবে পারস্পরিক সুবিধার্থে গড়ে উঠেছে একটা ব্যবস্থা ও সম্পর্ক। মনে রাখতে হবে ‘বাবু’রা নন, পরিচারিকারা মূলত গৃহবধূদের ঘরের কাজে সাহায্য করেন। আর রান্না, বাসন ধোয়া, বয়স্কদের দেখাশোনা, এই সব জরুরি কাজ করেন, যা পরের দিনের জন্য ফেলে রাখা যায় না। এই চাপটা মূলত ঘরের মহিলাদেরই নিতে হয়, যাঁরা নিজেরাও অনেক রকম পারিবারিক নিষ্পেষণের শিকার। এমনকি পরিচারিকারা নিজেরাও এক-এক জন গৃহবধূ। তাই তাঁদের মঙ্গলের জন্য নিয়ম তৈরি করতে গেলে গৃহবধূর প্রয়োজনটাকে অস্বীকার করে তাঁকে বিপ্রতীপ অবস্থানে দাঁড় করালে সমস্যার সুরাহা হবে না।

দ্বিতীয়ত, পরিচারিকাদের সমস্যাগুলিও তাঁদের অবস্থান থেকে বুঝতে হবে। এঁরা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এলেও সকলের অবস্থান সমান নয়। কেউ সংসার চালানোর জন্য প্রয়োজনে বাড়ি থেকে অনেক দূরে ট্রেনে করে এসে (বা আয়া সেন্টারের মাধ্যমে) সারা দিন কাজ করেন। কেউ সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনতে বাড়ির কাছাকাছি কাজ করেন। দু’পক্ষের প্রয়োজন ও সুবিধার দাবিও এক রকম নয়। প্রথম দলের কাছে মাইনের অঙ্কটা খুব বড়, যে কোনও কাজে তাঁদের আপত্তি নেই। দ্বিতীয় দলের কাছে কাজের বাড়ির দূরত্ব, কাজের ধরন, সময় ও পরিবেশ বিবেচ্য। তেমনই প্রথম দলের কর্মীদের কাছে সপ্তাহে এক দিন ছুটি যতটা দরকার, দ্বিতীয় দলের পক্ষে নিজের দরকার মতো এক সঙ্গে দু’-তিন দিন ছুটি নেওয়া বেশি সুবিধাজনক। তাই সপ্তাহে এক দিন ছুটির দাবি, যেটা নিয়োগকারীর সঙ্গে কথা বলেই ঠিক করা যায়, সেটা না করে ছুটির ব্যাপারে যে যার মতো চুক্তি করে নেন। সেই চুক্তি দু’-তরফে মেনে চললে কেউ একই বাড়িতে বহু দিন কাজ করেন, না হলে ঘন ঘন বদলায় কাজের বাড়ি কিংবা কাজের সহায়িকা।

পরিচারিকাদের প্রথম দাবি হল (ন্যূনতম) বেতন, যা নিয়ে সর্বদাই কিছু দরকষাকষি চলে। যে সব বিষয়ে কোনও ধরাবাঁধা ‘দর’ নেই, সেখানে দু’পক্ষই ‘ঠকে যাওয়া’র ভয়ে ভোগেন। যে কারণে লোকে ‘বাঁধা দাম’-এর দোকানে ঢুকে নির্দ্বিধায় হাজার হাজার টাকার কেনাকাটা করলেও ফুটপাতের জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে পঞ্চাশ টাকার জন্যও দরকষাকষি করেন। তাই উভয়েই কমিয়ে বলা ও বাড়িয়ে বলার চক্রে ঢুকে পড়েন। সুতরাং, প্রথম দাবি অবশ্যই পরিচারিকাদের জন্য ন্যূনতম বেতন ও একটা বেতনকাঠামো স্থির করা। বিষয়টি বহুস্তরীয়। যেমন, এই বেতন কি সব পরিচারিকার একই হবে? তাতে ওঁরা খুশি হবেন তো, কারণ এমনিতে এক ঘণ্টা রান্না ও এক ঘণ্টা বাসন মাজা-ঘর মোছার বেতন সমান হয় না। তাই ন্যূনতম একটা বেতন ঠিক করা ও কাজের চাপ অনুযায়ী কী ভাবে বেতন কিছুটা সংশোধন হবে— সেটাও উল্লেখ করতে হবে। আর এই দাবি অবশ্যই সরকারের কাছে পেশ হওয়া দরকার। এ ছাড়া নথিভুক্ত পরিচারিকাদের কাজকে একশো দিনের কাজ বা সমতুল্য কোনও প্রকল্পের আওতায় আনা যায় কি না, সেটাও ভেবে দেখা যায়।

তবে, সত্যিই কি পরিচারিকাদের দিন একেবারেই বদলায়নি? বাস্তব চিত্র বলে, গ্রাম-শহর উভয় ক্ষেত্রেই পরিচারিকার প্রয়োজন ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু বিভিন্ন বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা থাকায় পরিচারিকার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তাই তাঁরা এখন আর ততটা অসহায় নন। তাঁদের নানা ছুতোয় কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া, মাইনে বা বোনাস না দেওয়া— এ সব এখন অনেক কমে গিয়েছে। কারণ, এমন করলে সেই খবর ছড়িয়ে যায়, সেই বাড়িতে কেউ কাজ করেন না। পরিচারিকারা মুখের উপর ‘না’ বলতে অভ্যস্ত হয়েছেন। গৃহকর্ত্রী ও পরিচারিকার সম্পর্কটা সময়ের দাবি মেনে অনেকটা আধুনিক হয়েছে। গৃহকর্ত্রীও বিনা পয়সায় কোনও বাড়তি কাজের কথা বলেন না, পরিচারিকাও ছুটি নিতে হলে আগে জানিয়ে রাখেন বা অন্তত আগের দিন ফোনে জানিয়ে দেন। তাই তাঁদের এক তরফা শোষিত হওয়ার গল্প এখন আর ততটা সত্যি নয়। বেতনকাঠামো স্থির হলে এঁদের সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করা যায়।

কিন্তু তার পরেও সব পেশার মতো ‘এক্সপ্লয়টেশন’, যৌন হয়রানি, অত্যাচার আছে এখানেও। তেমন কিছু হলে এঁরা কার কাছে যাবেন, জানা দরকার। এঁদের নির্দিষ্ট সংগঠন থাকাও প্রয়োজন, যাতে পায়ের তলার জমিটা শক্ত হয়। কিন্তু প্রত্যেকের কাজের শর্ত এবং ‘কাজের বাড়ি’র চরিত্র আলাদা আলাদা বলে সেই সংগঠন তালিকা ধরে একই নিয়ম সকলের জন্য আরোপ করতে পারে না। তবে শোষণ ও হয়রানির গল্পের চেয়ে সহানুভূতি ও সাহায্যের গল্পের অংশ যে কম নয়, সে কথাও স্বীকার করা উচিত, ওঁরা সেটা করেনও। বরং, ওঁদের কথা যাঁরা বলেন, তাঁরা যে ভাবে একমাত্রিক শোষণের ছবি আঁকেন— তাতেই আলোচনার ভরকেন্দ্র ‘আমরা বনাম ওরা’তে সরে যায়।

বয়স নির্বিচারে পরিচারিকাকে নাম ধরে ডাকা বা তুই-তোকারি করা এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তবু পরিচারিকার পেশায় কেউ শখ করে আসেন না বা নিজের সন্তানকে কেউ এই পেশায় আনতে চান না। অর্থাৎ, তিক্ত সত্য হল এটাই যে, এঁরা নিজেরাই এঁদের পেশাকে সম্মান করেন না। সেটা শুধু আর্থিক কারণেই নয়, এঁদের শ্রমের মূল্য প্রতিষ্ঠা হয়নি বলে। এটা এঁদের অপরাধ নয়, এটাই সামাজিক নির্মাণ, তার পিছনেও হয়তো গৃহশ্রমের মূল্যহীনতার ধারণা আছে। শ্রমের সম্মান না থাকলে শ্রমিকের সম্মান কী করেই বা থাকবে!

কলেজ পড়ুয়া ঝকঝকে তরুণী যদি হাতখরচা জোগাড় করতে আমাদের বাড়িতে এসে বাসন ধুতে বা রুটি করে দিতে চায়, তখন কি কেউ তাকে টয়লেট করতে বাধা দিতে পারবেন?

রসায়ন বিভাগ, সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Workers Labours Servant

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy