E-Paper

বাংলার লোকায়ত বড়দিন

বড়দিনের আগের রাতে ‘আগমনী গান’ গাইতে গাইতে বেরোয় খ্রিস্টকীর্তনীয়ার দল, খোল করতাল ঢোল খঞ্জনি বাঁশি হারমোনিয়াম নিয়ে।

সুরঞ্জন মিদ্দে

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:১৪
Christmas

—ফাইল চিত্র।

কলকাতার গির্জায় ২৪ ডিসেম্বর রাতে যখন গাওয়া হবে ‘সাইলেন্ট নাইট, হোলি নাইট’, ঠিক তখনই দ্বীপময় দক্ষিণবঙ্গের কোনও গির্জা মুখরিত হবে এ গানে: ‘সুন্দর এই পুণ্য রাত/ উজল তারার আলোয় ভরা পুণ্য রাত... জেগে থাকো তুমি, জেগে থাকো/ প্রাণের আঙিনা সাজিয়ে রাখো/ ধ্যান-বাণী ভরা শান্তি-মগ্ন পুণ্যরাত।’ সুন্দরবনের প্রান্তিক পাখিরালার বিধবা পল্লির প্রার্থনাঘরে বাউল সুরে গাওয়া হবে, ‘প্রভু জিশুর চরণ ধরে ওরে ভোলামন/ ওই চরণ না ভজিলে যে বৃথা যাবে জীবন।’ গেঁওখালির পর্তুগিজ় পল্লির উপাসনালয়ে গাওয়া হবে ‘উজানে নায় দিয়া পাড়ি/ ছাইড়া যাব দুনিয়াদারি, শ্রীখ্রিস্ট চরণ ধরি বাইয়া যাওরে মন।’ এই ‘গায়ক’দের কাছে বড়দিন মানে ২৪ ডিসেম্বরের আগে পশ্চিম এশিয়া বা ইউরোপের কোনও দেশ থেকে ফিরে আসা, এঁদের নাম সুনীল পেরেরা, অগাস্টিন ডি-ক্রুজ়, অঞ্জলি গোমেজ়, সিমসন ডি-কস্তা বা সুনীল রোজ়ারিয়ো। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ যেন ‘খ্রিস্টাষ্টমী’র পারিবারিক মিলনমেলা। পর্তুগিজ়পাড়ার অতিথি-আপ্যায়ন মনে রাখার মতো, পিঠেপুলির সঙ্গে ভাজাকারি বা বিন্দে-আলু। বাংলার বড়দিনের লোকায়ত ভুবন রসনাতৃপ্ত। সেখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য মিশে গেছে: বড়দিনের রাত থেকে প্রার্থনাসঙ্গীত, সংস্কৃত চণ্ডীপাঠের সুরে শ্রীজিশু-স্তোত্রে ভরে ওঠে গির্জার বেদি। মোমের স্নিগ্ধ আলোতে মেশে ধূপ-ধুনোর গন্ধ।

বড়দিনের আগের রাতে ‘আগমনী গান’ গাইতে গাইতে বেরোয় খ্রিস্টকীর্তনীয়ার দল, খোল করতাল ঢোল খঞ্জনি বাঁশি হারমোনিয়াম নিয়ে। ভারতীয় রাগ আর দেশি কীর্তনের সুর, দশকোষী তেওট লোফা ঝাঁপ রূপক একতাল সমতাল দোঠুকী গড়খেমটা তালে— গীত বাদ্য নৃত্যের নব নগরকীর্তন এই ‘জিশুলীলা’র গান। বাংলা ভাষার ক্যারলগুলি দুই বাংলায় কীর্তনের নবধারা। চট্টগ্রাম থেকে সপ্তগ্রাম, কবরডাঙা থেকে আঠারো গ্রামের ঘরে ঘরে খ্রিস্টকীর্তন মনে করিয়ে দেয় বড়দিনও বাঙালির প্রিয় উৎসব: ‘আজ নিশীথে এই ভবেতে কিসের বার্তা ভেসে যায়, আজি এই ধরাতে গোশালা ঘরেতে মেরির কোলে শিশু জিশু জন্মিলেন।’

‘শ্রীজিশু’র জন্ম কবে, তিনি শ্বেতাঙ্গ না কৃষ্ণাঙ্গ, বাংলার কৃষিজীবী মানুষের কাছে এ সব প্রশ্ন অবান্তর। ২৪ ডিসেম্বরের আগে শীতের আমন ধান ঘরে তুলতে হবে, তৈরি হবে পিঠেপুলি, ঘরে বানানো হবে ‘রোজ় কুকি’। বিকেলে বড়দিনের খ্রিস্টমেলায় মিশে যায় হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান। এই মেলা যেন শীতের শারদীয়া। বড়দিন ও নতুন বছরের শুভেচ্ছা কার্ড, মোমবাতি, ক্যারল, কেকের সঙ্গে কমলালেবু আর নলেনগুড়ের মোয়া। ঘর, গির্জা প্রাঙ্গণ, মিশন স্কুলের মাঠ, হস্টেল সাজে রঙিন কাগজে বেলুনে। সেজে ওঠে ক্রিসমাস ট্রি, সবচেয়ে বড় আকর্ষণ গোশালা সাজানোয়। সেখানে শিশু জিশু শুয়ে খড়ের জাবপাত্রে, এক দিকে পালক পিতা জোসেফ, অন্য দিকে মা মেরি, মেষশাবক-সহ রাখালদল আর তিন পূর্বী পণ্ডিত, হাতে উপহার স্বর্ণ-কুন্দ-গন্ধরস। ঠাকুরপুকুর থেকে কবরডাঙা-নেপালগঞ্জ পর্যন্ত বড়দিনের গোশালামঞ্চ যেন বাঙালি মাতৃমণ্ডলের কারুক্ষেত্র, কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্প এখানে জিশুর জন্মক্ষণকে রূপ দিয়েছে শিল্পে।

পূর্ববঙ্গের আঠারো গ্রামে ইছামতীর দুই পাড়ের পর্তুগিজ় পদবিসমন্বিত বাঙালি ঘরে উৎসব পিঠেপুলি, দই-চিঁড়ে-বিন্নির খই, বাতাসা আর সোনারং মর্তমান কলায়। ও-পারের দোম আন্তোনিয়ো আর এ-পারের ‘এন্টনী ফিরিঙ্গি’র গানে লেখা সম্প্রীতির সঙ্গীত। সুন্দরবনের বাসন্তী দ্বীপের সজিনাতলা গ্রামে বড়দিনে বসে সম্প্রীতি মেলা, শতর্বষ ধরে যা গ্রামীণ শান্তি ও সমন্বয় বজায় রেখেছে। এখানে মধুসূদন মোতালেব সিমসনদের সহাবস্থান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মৃদঙ্গ বাজান মহাদেব নস্কর, বাঁশিতে উজির আলি আর হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেন জোহন মণ্ডল। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারের গির্জার মাঠে গারো, মেচ, রাভার সঙ্গে মিলেমিশে যান সাঁওতাল ও মুন্ডারা— বড়দিনের বড় আনন্দে।

‘ইশা-মুসা’ এসেছেন বাংলার বাউল গানে, পরে সাধারণ্যে বড়দিন জায়গা করে নিয়েছে লোকধর্ম-সংস্কৃতির সূত্রে। চড়ক, ইদের গানের মতো বড়দিনের গানও বাঙালির সংস্কৃতি। সঙ্কীর্তনের মতো বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাওয়া বড়দিনের আগমনী গানও সেই ঐতিহ্যেরই পরম্পরা। জোব চার্নক আসার আগে পর্তুগিজ় মিশনারিরা এসে গেছেন চট্টগ্রাম থেকে হুগলিতে, তৈরি হচ্ছে ব্যান্ডেল গির্জা। আবার কয়েক শতক পেরিয়ে শান্তিনিকেতনে হচ্ছে খ্রিস্টোৎসব। ১৯২৩-এর ২৫ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “তাই তোমার আনন্দ আমার পর, তুমি তাই এসেছ নীচে।” ১৯৩২-এর ২৫ ডিসেম্বর লিখছেন, “বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করবার দিন, নিজেকে নম্র করবার দিন।” আজও শান্তিনিকেতন মন্দিরে পালিত হয় খ্রিস্টোৎসব, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে বড়দিনে হয় জিশুপুজো। বাঙালির ঘরের দেওয়াল আলো করে থাকে যামিনী রায়ের দেশজ খ্রিস্টচিত্রে চিরন্তন মা-শিশু। গ্রামে গ্রামে বড়দিনের খ্রিস্টমেলায় ধূপ-মোম-বাতাসা নিয়ে মানত মেটাতে আসে ধর্ম বর্ণ-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ। বাঙালি মা মেরিকে পরিয়েছে ধনেখালি তাঁতের শাড়ি, শিশু জিশুকে পাজামা-পাঞ্জাবি। সার্থক তার লোকায়ত বড়দিন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

christmas West Bengal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy