Advertisement
E-Paper

পৌরুষ ও হিংসা, এক সমীকরণ

আজও মেয়েরা খেলাধুলা থেকে শুরু করে সব কিছুতে অংশগ্রহণ করলেও যেন বুঝিয়েই দেওয়া হয় যে, তাকে খেলার জুতো নয়, লিপস্টিক কিনতে নজর দিতে হবে।

মৌমিতা

শেষ আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২২ ০৫:০১
হিংসা থেকে পৌরুষকে বিযুক্ত করতে না পারলে আগামী দিনের সংসার, সমাজ, একত্রবাস, বিবাহ যে কোনও দ্বৈত সম্পর্কই কিন্তু বিপন্ন।

হিংসা থেকে পৌরুষকে বিযুক্ত করতে না পারলে আগামী দিনের সংসার, সমাজ, একত্রবাস, বিবাহ যে কোনও দ্বৈত সম্পর্কই কিন্তু বিপন্ন। প্রতীকী ছবি।

বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া শ্রদ্ধা ওয়ালকরের শরীরের ৩৫ টুকরো হওয়া আজ আর কোনও নতুন খবর নয়। তাঁর তথাকথিত প্রেমিকের ‘রাগের মাথায় মেরে ফেলেছি’ বক্তব্যটিও আর বিস্ময় জাগায় না। রাগের মাথায় পুরুষ মেয়েদের তো আজ মারতে শুরু করেনি, পুরুষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে নারীকে মেরে ফেলার দৈব অধিকার নিয়েই পুরাকাল থেকে পুরুষ জন্মেছে। ক’দিন আগেই এ রকমই প্রত্যাখ্যান করে হরিয়ানার নিকিতা তোমর কিংবা ঝাড়খণ্ডের অঙ্কিতা তথাকথিত প্রেমিকদের গুলি কিংবা আগুনে, মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েছেন। অঙ্কিতার খুনিকে বাঁচাতে পুলিশ অফিসারের সক্রিয় ভূমিকাও নজরে এসেছে। উত্তর ভারতে বিপুল প্রভাবশালী সম্প্রতি প্রয়াত রাজনৈতিক নেতার উক্তিটি মনে আছে? “ধর্ষকদের ফাঁসি কেন হবে”— এই প্রশ্ন করে জুড়ে দিয়েছিলেন দৈববাণী! “বাচ্চে হ্যায় গলতি হো যাতি হ্যায়।” শ্রদ্ধার লিভ-ইন সঙ্গী কিংবা নিকিতা তোমরের পিছনে ঘুরে-বেড়ানো লোকটি কিংবা অঙ্কিতার গায়ে আগুন লাগানো জল্লাদ সবাই বাচ্চা, সবারই গলতি হয়ে যায়। দশ বছর আগের নির্ভয়া কাণ্ডও মনে পড়ে। সবচেয়ে নৃশংস ছেলেটি স্রেফ পাঁচ না ছয় মাস বয়স কম থাকার সুবিধায় তিন বছর গেস্টহাউস-সুলভ কারাবাস করে বেরিয়ে গিয়ে ভারতের কোথায় না জানি কী কাজ করছে এবং আগামী দিনে আরও কত মেয়ের জীবনের প্রতি ‘সম্ভাব্য হুমকি’ হিসাবে বিচরণ করছে। ব্যাপারগুলো আমাদের গা-সওয়া। আমাদের মানবাধিকার মানে এনকাউন্টার নিয়ে যতটা কথা বলা— মেয়েদের ৩৫ টুকরো করে ফেলা বা আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া নিয়ে ততটা কথা বলা নয়। তবে, সন্দেহ হয়, যদি উল্টোটা হত, যদি একটি মেয়ে প্রেমিক কিংবা স্বামীকে খুন করত, প্রথম পাতায় সেই খবর সাত দিন চলত। বাসে-ট্রেনে-ট্রামে আলোচনা হত মেয়েরা আজকাল অত্যধিক স্বাধীনতা পেয়ে কী ভয়ঙ্কর হয়ে গিয়েছে!

মেয়ে হিসাবে কোনও অতিরিক্ত সুবিধার কথা এখানে আলোচ্য নয়। কেবল বলা হচ্ছে, বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আচরণে এ-হেন বৈপরীত্য আমরা বহন করেই চলেছি। অমুক মেয়েটা ঠকিয়েছে বলে বহরমপুরের যে ছেলেটি ক্রমাগত ছুরি গেঁথেছিল প্রেমিকার শরীরে তাকে কি আদালতে জিজ্ঞাসা করা হবে, ঠকানোর শাস্তি দিতে সত্যিই ছুরি মারা জরুরি কি না? পৃথিবীতে অগণিত পুরুষ বহুগামিতায় লিপ্ত, তারা তো ছুরিকাহত হয় না! এই যে নারী-পুরুষের দ্বৈত জীবনের মধ্যে হিংসা বড় ভূমিকা নেয় মূলত পুরুষেরই কারণে, এবং বাকি সমাজের গা-সওয়া হয়ে যায়— এটাই দুশ্চিন্তার।

কিছু সংলাপ কিছু প্রলাপ নামে একটি সিনেমা হয়েছিল। নারী-পুরুষের কথোপকথনকে সব সময় এই সংলাপ আর প্রলাপের দ্বিত্বে বাঁধা যায়? অযৌক্তিক হোক বা অনৈতিক— মেয়েদের কথা তাও একটা সংলাপের ভিতর থাকে। কিন্তু হিংসার মিশেলে পুরুষের কথা ক্রমাগত প্রলাপ হয়ে উঠতে থাকে। ফলে সে সংলাপের বাইরে বেরিয়ে শারীরিক আঘাত করতে শুরু করে। সেই পুরুষটিকে যদি কেউ এনকাউন্টার করেন, সেটাকে কেউ কেউ বাহবা দেন, কেউ কেউ দেন না। কিন্তু মূল রহস্যটা অনেক গভীরে। নারী-পুরুষের সংলাপের মধ্যে, সম্পর্কের মধ্যে, ভালবাসা বা ঘৃণা থাকতে পারে। কিন্তু, হিংসাকে কে নিয়ে আসছে? এই হিংসাকে আনার দায় হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ড, দিল্লি, মুম্বই, বাংলা থেকে যদি পুরুষেরই হয়— তবে আজই ছেলেদের স্কুলের সঙ্গে রিহ্যাব চালু করার কথা ভাবা দরকার কি?

আজও মেয়েরা খেলাধুলা থেকে শুরু করে সব কিছুতে অংশগ্রহণ করলেও যেন বুঝিয়েই দেওয়া হয় যে, তাকে খেলার জুতো নয়, লিপস্টিক কিনতে নজর দিতে হবে। সে নিজেরই সর্বনাশ করে নিজেকে ম্যানিকুইন, বার্বি পুতুল সাজায়। সেই পুতুলকে নাগালে না পেলেই উন্মত্ত হিংসার আশ্রয় নেয় পুরুষ। ‘কবীর সিং’-এর মতো সামাজিক অপরাধী বা ‘পুষ্পা’র মতো পরিবেশদস্যুকে নায়ক বানিয়ে মেয়েদের বিপদের রাস্তাটা নতুন করে খুলে দেওয়া হয়। ক’টা হিন্দি, তেলুগু বা অন্য ভাষার অতি জনপ্রিয় সিনেমা মনে পড়ে যেখানে নায়ক আদ্যন্ত ভদ্রলোক? নায়কের হিংসায়, স্থূলকায় পরিচারিকাকে তাড়া করে ছোটার দৃশ্যে, যেখানে তিনি সিঁড়ি থেকে পড়ে মরেও যেতে পারতেন— সেখানে হলভর্তি লোকের সিটিতে বোঝা যায় বিপন্নতা অনেক গভীরে। পুরুষকে পুরুষ হয়ে ওঠার জন্য হিংস্র চেহারা নিতে হবে। যেন কেশর ছাড়া সিংহের মতো, হিংস্রতা ছাড়া পুরুষকে গ্রহণ করা হবে না। স্কুলে, সমাজে, সিনেমায়, পরিবারে এই বোধকে যাঁরা লালন করছেন, প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁরা মেয়েদেরই আরও নতুনতর বিপন্নতায় ঠেলে দিচ্ছেন।

হিংসা থেকে পৌরুষকে বিযুক্ত করতে না পারলে আগামী দিনের সংসার, সমাজ, একত্রবাস, বিবাহ যে কোনও দ্বৈত সম্পর্কই কিন্তু বিপন্ন। হিংসার আগ্নেয়গিরির কোলে একটি অসহায় ফুলের মতো মহা-অনিশ্চয়তার কোলে নিক্ষিপ্ত।

Crime Women men Society Violence
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy