Advertisement
E-Paper

ভারতের কৃতিত্ব, এখনও অবধি

বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি সুরক্ষিত রাখা ছাড়াও, জি-২০ বৈঠককে সার্থক করার আরও একটা তাগিদ ছিল ভারতীয় কূটনীতিক দলের।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৩২
এ বছর ভারত জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করল ইন্দোনেশিয়ার থেকে, ২০২৩ সালের শীর্ষ সম্মেলন হবে দিল্লিতে।

এ বছর ভারত জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করল ইন্দোনেশিয়ার থেকে, ২০২৩ সালের শীর্ষ সম্মেলন হবে দিল্লিতে। ফাইল চিত্র।

বালিতে জি-২০ বৈঠক কিন্তু ব্যর্থ হয়নি। যে যা-ই বলুক, দু’দিনের এই বৈঠক (১৫ ও ১৬ নভেম্বর) সার্থক, সফল। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে বড় ইংরেজি দৈনিক জাকার্তা পোস্ট জি-২০ বৈঠকে আগত নেতাদের উদ্দেশে বলেছিল, “প্লিজ়, কেবল ঝগড়া করতে আসবেন না।” মনে হচ্ছে, নেতাদের কানে সে কথাটা ঢুকেছিল। আশঙ্কা ছিল, নেতাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে জি-২০ বৈঠকের শেষে যে সম্মিলিত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, এ বার হয়তো তা সম্ভব হবে না। তা যে সম্ভব হয়েছে, সে জন্য ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইডোডো নিঃসন্দেহে কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। স্বীকৃতি প্রাপ্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, এবং বিদেশ মন্ত্রকেরও। নেতাদের মধ্যে সংঘাত এড়িয়ে সকলকে এক মঞ্চে রাখার চেষ্টা সফল হয়েছে।

পশ্চিমের দেশগুলি চেয়েছিল, জি-২০ বৈঠক থেকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের বিরুদ্ধে কঠোর বিবৃতি হোক। কিন্তু ভারত ও চিন রাশিয়ার সমর্থক, তারা সম্মত না হলে এমন বিবৃতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জি-২০ বৈঠকের আগে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট করে দেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে চিন উদ্বিগ্ন, যথাসম্ভব শীঘ্র তার নিষ্পত্তি চায়। গত কয়েক মাসে রাশিয়া কয়েক বার ইউক্রেন যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়ে অস্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছিল, সরাসরি সে সম্ভাবনা খারিজ করেনি। শি কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানান। অনেকে ভেবেছিল, এটা তবে রাশিয়ার প্রতি চিনের নিন্দা।

সেপ্টেম্বরে উজ়বেকিস্তানে ‘শাংহাই কোঅপরেশন অর্গানাইজ়েশন’-এর বৈঠকেই মোদী রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধের উপযুক্ত সময় এটা নয়। কয়েক মাস ধরেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করে আলোচনায় ফেরার কথা বলে আসছে। কিন্তু বালিতে ভারতীয় কূটনীতিকদের বেশ খানিকটা ভারসাম্যের খেলা দেখাতে হয়েছে। শেষ অবধি দেখা গেল, জি-২০ বৈঠকের সম্মিলিত বিবৃতি কঠোর ভাবে ইউক্রেন-যুদ্ধের নিন্দা করেছে, বিশ্ব-অর্থনীতিতে তার প্রতিকূল প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছে, কিন্তু তার জন্য রাশিয়াকে প্রকারান্তরে দায়ী করলেও সরাসরি নিন্দা করেনি। জি-২০ সদস্য দেশগুলি রাষ্ট্রপুঞ্জে রাশিয়ার যে সব সমালোচনা করেছিল, সেগুলোকেই বিবৃতিতে উদ্ধৃত করার কৌশল নেওয়া হয়েছে। জি-২০ প্রধানত অর্থনৈতিক বিষয় আলোচনার মঞ্চ, নিরাপত্তার প্রসঙ্গের জন্য নয়, এই যুক্তিতে সংঘাত এড়ানো হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট অবশ্য নিজে আসেননি, বিদেশমন্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন বালিতে।

বিশ্বে ভারতের ভাবমূর্তি সুরক্ষিত রাখা ছাড়াও, এই বৈঠককে সার্থক করার আরও একটা তাগিদ ছিল ভারতীয় কূটনীতিক দলের। এ বছর ভারত জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করল ইন্দোনেশিয়ার থেকে, ২০২৩ সালের শীর্ষ সম্মেলন হবে দিল্লিতে। ইউক্রেন প্রশ্নে জোটে ফাটল ধরলে সে কাজ অনেক কঠিন হত। নানা সংঘাত সত্ত্বেও বিশ্ব-অর্থনীতি ও রাজনীতিতে জি-২০ জোটের গুরুত্ব অপরিসীম। এখন জি-২০ দেশগুলির মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চিন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুর্ক, ব্রিটেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আমেরিকা। বিশ্বের মোট উৎপাদনের আশি শতাংশ উৎপন্ন করে এই দেশগুলি, বিশ্ববাণিজ্যের পঁচাত্তর শতাংশ এদেরই দখলে, এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ষাট শতাংশ এই সব দেশে বাস করে।

ইন্দোনেশিয়া যখন জি-২০ জোটের প্রেসিডেন্ট পদ পেয়েছিল, তখন সকলে আশা করেছিল যে অতিমারির আঘাতে বেসামাল বিশ্ব-অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসার উপায় বাতলাবে পরবর্তী বৈঠক। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনীতিকে আরও বড় সঙ্কটে ফেলে দিল। যুদ্ধের ছায়া প্রত্যাশিত ভাবেই বালি বৈঠকে একটা থমথমে পরিবেশ তৈরি করেছিল। রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করে কোণঠাসা করতে চেয়েছিল আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলি। ভারত আর চিনের অবস্থান ছিল ভিন্ন— তারা যুদ্ধ সমর্থন না করলেও, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি। শীর্ষ বৈঠকের আগে বেশ কিছু প্রাক্-আলোচনা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটাই তীব্র বিতর্কে শেষ হয়েছে। তাই ভয় ছিল, বালিতে হয়তো তিক্ততা আরও বাড়বে। শেষ অবধি তা অবশ্য হয়নি। সম্মিলিত বিবৃতির সতেরো পাতার খসড়া শেষ অবধি সব নেতাই গ্রহণ করেছেন।

ওই বিবৃতিতে অবশ্য বিশ্ব-অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার প্রয়োজন, সুস্থায়ী উন্নয়ন, আরও কাজ তৈরির কথাও বলা হয়েছে। তবে জি-২০ জোটের চিরকালীন দুর্বলতা, এর সিদ্ধান্তগুলি সুপারিশ হয়েই রয়ে যায়। ২০২৩ সালে দিল্লি সম্মেলনের প্রস্তুতি পর্বে প্রায় দু’শোটি আন্তর্জাতিক বৈঠক হতে চলেছে। এটা যেমন ভারতের কাছে পরিকাঠামোগত মস্ত চ্যালেঞ্জ, তেমনই একটি সুযোগও— দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বৈঠকের আয়োজন করে ভারতীয় সংস্কৃতির বৈচিত্র তুলে ধরা যায় বিশ্বের কাছে। পশ্চিমের দেশগুলি ও রাশিয়া, দুই তরফেই কথা বলে ভারত দ্রুত যুদ্ধ মেটানোর চেষ্টা করতে পারে। তাতে বিশ্বে ভারতের দায়িত্বশীল ভাবমূর্তি সবল হবে। সভাপতিত্বের সময়কালে এই জোটকে একটি প্রধান আন্তর্জাতিক মঞ্চ হিসেবে আরও জোরদার করতে পারবে কি না মোদী সরকার, প্রশ্ন সেটাই। নয়তো সেই ফাঁকা বুলি কপচানোর মঞ্চ হয়েই থাকবে জি-২০।

G20 summit bali
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy