Advertisement
০৬ মে ২০২৪
বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের বহু শক্তি
Bangladesh

ভারসাম্য রক্ষার লড়াই

শুধু নির্বাচন তো নয়, বাংলাদেশে যে কোনও রাজনৈতিক সঙ্কট এলেই তৎপর হতে দেখা গিয়েছে সে দেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যার শুরু।

পরীক্ষা: বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লিট রিভিউ’-এর মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ৭ ডিসেম্বর, ২০২২। পিটিআই

পরীক্ষা: বাংলাদেশ আয়োজিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্লিট রিভিউ’-এর মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ৭ ডিসেম্বর, ২০২২। পিটিআই

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০২৩ ০৫:৫১
Share: Save:

বেগম খালেদা জিয়ার হাত থেকে তখন সবে ক্ষমতা গিয়েছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ফকরুদ্দিন আহমেদের হাতে। সংবিধান সংশোধনীকে কেন্দ্র করে বিরোধীদের উত্তাল আন্দোলনের মধ্যে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তখন।

সেই সময় বাংলাদেশের বিদেশি দূতাবাস পাড়ার অভিজাত কূটনৈতিক মহলে খুবই তৎপর ছিল একটি গোষ্ঠী, যাকে ডাকা হত ‘কফি গ্রুপ’ বলে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে এই গ্রুপ নিয়মিত বৈঠকে বসত। তার সদস্য ছিলেন আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানির রাষ্ট্রদূতরা। ডাকা হত জাপানকেও। অনেক পরে উইকিলিক্স-এ প্রকাশিত আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বুটেনিসের গোপন তারবার্তা থেকে এ বিষয়ে জানা যায়। ২০০৭ সালের জুনে (তখন ভরপুর চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার) দি ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতিবেদনে প্রকাশ, দুই প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে প্যাট্রিসিয়া নাকি বলেছিলেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে।

এর পর কেটেছে পনেরো বছর। আরও একটি নির্বাচনের ঘণ্টাধ্বনি পদ্মাপারের মাটিতে। কিন্তু ‘কফি গ্রুপ’-এ চিনির স্বাদের কিছু ইতরবিশেষ ঘটলেও, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে! বাংলাদেশে নির্বাচনের মেঘ ঘনালেই আমেরিকা, জাপান, পশ্চিমের দেশগুলি ছাতা খুলতে থাকে! সাউথ ব্লকেও সক্রিয়তা কম হয় না। নড়ে বসে চিন, রাশিয়া।

যাঁদের স্মরণে নেই, তাঁদের এক বার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে আগের নির্বাচনের (২০১৮) দিকে ফিরে দেখি। ভোটের ঠিক পরে তৎকালীন জাপানি রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যে তোলপাড় হয় ঢাকা। তাঁর মন্তব্য ছিল, ভোটের আগের দিনই ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়েছে! এই অভিযোগে গলা মেলায় বিএনপি-ও। তারাও আশঙ্কা প্রকাশ করে এসেছে যে, নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে বুথে এনেছিল আওয়ামী লীগ।

শুধু নির্বাচন তো নয়, বাংলাদেশে যে কোনও রাজনৈতিক সঙ্কট এলেই তৎপর হতে দেখা গিয়েছে সে দেশে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের। মুক্তিযুদ্ধ থেকে যার শুরু। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে পরবর্তীতে একাধিক সামরিক শাসন, ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন, এমনকি ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরে প্রতিটি রাজনৈতিক ওঠাপড়ায়, কমবেশি সব নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি শক্তির সক্রিয়তা প্রকাশ্যে এসেছে। আবার কোনও ক্ষেত্রে তা থেকেছে পিছনে।

এখনও পর্যন্ত স্থির আছে, ২০২৪-এর জানুয়ারির গোড়ায় বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন। অর্থাৎ, এখনও বাকি গোটা এক বছর। কিন্তু ঢাকার মাটিতে আমেরিকা এবং রাশিয়ার ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি দেখে বোঝা দায়, আসলে ভোটটা কাদের! সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রোটোকল দফতরের কাউকে না জানিয়ে, ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, নিখোঁজ বিএনপি নেতা সায়েদুল ইসলাম সুমনের বাড়ি (ঢাকার শাহিন বাগে) পৌঁছে যান গোপনে। উদ্দেশ্য, সায়েদুলের পরিবারের সঙ্গে দেখা করা। প্রায় এক দশক ধরে সায়েদুলের খোঁজ পাচ্ছে না তাঁর পরিবার। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত সেখানে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন কি না, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু ঢাকার মতো শহরে গোপন কিছুই থাকে না! গিয়ে পিটার হাস বস্তুত ফেঁসে যান। তিনি যখন সায়েদুলের বাড়িতে তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গে আলোচনারত, খবর পেয়ে সেখানে এসে হাজির ‘মায়ের কান্না’ নামের একটি সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনাবাহিনীর যে সব সদস্যের ফাঁসি হয়েছিল, তাঁদের পরিবারের সংগঠন এই ‘মায়ের কান্না’। তাঁরা বাইরে প্ল্যাকার্ড দেখানো, হইচই শুরু করলে আলোচনা সংক্ষেপ করে বেরিয়ে আসেন পিটার হাস। তাঁকে ঘিরে ধরে অভিযোগ জানানো হয়। নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হওয়ায় হাস বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রকে গিয়ে অভিযোগ জানান। বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, কেন ‘মায়ের কান্না’ ঠিক সেই সময়ই ওই বাড়ির সামনে হাজির হল, সে ব্যাপারে তাদের কাছে নাকি তথ্য নেই। আরও একটি কথা ঢাকা কড়া ভাবে জানিয়েছে আমেরিকার দূতাবাসকে— সরকারকে না জানিয়ে কেন বিএনপি নেতার বাড়ি পৌঁছেছিলেন তিনি?

এই ঘটনার পর পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার দূতাবাস। চলেছে আমেরিকা এবং রাশিয়ার দূতাবাসের পক্ষ থেকে টুইটের লড়াই। এমনকি রাশিয়ার বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা পর্যন্ত বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, “আমেরিকার রাষ্ট্রদূত যে কাজ করেছেন, তার প্রত্যাশিত ফলাফলই ঘটেছে। তিনি বাংলাদেশের জনগণের অধিকারকে মর্যাদা দেওয়ার যুক্তি দেখিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।”

বাইরের দেশের খবরদারি এবং চাঞ্চল্যের এই তরঙ্গ অস্থির, উত্তাল এবং পূর্বাভাসহীন বাংলাদেশের আসন্ন সংসদীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে বাড়ছে। আওয়ামী লীগের একটা অংশ এক দিকে আঁচ করার চেষ্টা করছে ভারতের সম্ভাব্য ভূমিকা। সাদা চোখে অন্য দেশের নির্বাচনে ভারতের নাক গলানোর কথা নয়। কিন্তু কূটনীতিতে, বিশেষত প্রতিবেশী কূটনীতিতে, এমন অনেক কিছুই অন্তঃসলিলা হয়ে বয়ে যায়, যাকে অগ্রাহ্য করার নয়। নাম গোপন রেখে তাই আওয়ামী লীগ সরকারের এক শীর্ষ নেতা বলেন, “১৪ এবং ১৮ সালের বাংলাদেশ নির্বাচনে ভারতের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। এ বারেও আমরা অপেক্ষা করছি। এখনও পর্যন্ত কোনও সুস্পষ্ট বার্তা না পাওয়া গেলেও সম্প্রতি ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রশংসা করেছেন। সেটাকে ইতিবাচক সঙ্কেত হিসেবে নিচ্ছে আওয়ামী লীগ।” এটাও বলা হচ্ছে, অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের পর ভারত থেকে দূত এসেছিলেন ঢাকায়, নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের নেতৃত্বের সঙ্গে।

সব মিলিয়ে এ বারও বাংলাদেশের নির্বাচন এক রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস! আয়তনে ক্ষুদ্র, সামরিক শক্তি বা অর্থনীতিতেও অপেক্ষাকৃত ছোট এই সুজলা সুফলা দেশের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের দিকে নানা কারণে তাকিয়ে রয়েছে বিশ্বের বহু শক্তি। কারণ, তার ভূকৌশলগত অবস্থান। কারণ, শেখ হাসিনার আমেরিকা এবং রাশিয়া, ভারত এবং চিনের মধ্যে ভারসাম্যের কূটনীতি। কারণ, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিকে বাইরে থেকে হলেও ধর্মনিরপেক্ষ চেহারা দেওয়ার চেষ্টা। পাকিস্তানপন্থী জামাতকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার প্রয়াস। কট্টরপন্থাকে পরিহার করে রাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের কৌশল।

এ বারের নির্বাচনের সূত্র কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। গুঞ্জন, খালেদা জিয়ার বিএনপি-র ভিতর যাঁরা ভোটপন্থী (বয়কটে যে লাভ নেই, তা এখন বিএনপি-র অনেক নেতা বুঝছেন) অংশ এবং তার সঙ্গে আরও কিছু বিরোধী দলকে নিয়ে একটি আপাত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করার চেষ্টা রয়েছে আওয়ামী লীগের। সে ক্ষেত্রে মোট ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৮০টিতে আওয়ামী লীগ তার জয় সুনিশ্চিত করে, বাকি ১২০টি আসনে অন্তত সুষ্ঠু ও অবাধ ভোট করানোর চেষ্টা করবে। ৬০ থেকে ৭০ আসন বিরোধীদের জন্য ছেড়ে রাখা হতে পারে। বিএনপি-র কিছু সাংসদ, বাংলাদেশ সংসদে থাকলে আখেরে আওয়ামী লীগেরই লাভ। আমেরিকা, জাপানের মতো দেশ মৌনী হবে। তা ছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতায় কে রয়েছে, সেটাই বড় কথা। এখানকার ধাঁচ একশৈলিক (মনোলিথিক) সরকারের। ফলে কিছু বিরোধী সংসদে থাকলেও সমস্যার তো কিছু নেই।

অন্য দিকে, গত ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিএনপি-র সমাবেশকে ঘিরে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং অন্যান্য বারো দফা দাবিতে বিএনপি মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছিল। সমাবেশ নিয়ে যতটা গর্জন ছিল, ততটা বর্ষণ না হলেও জড়ো হয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। সমাবেশে দু’টি মূল দাবি নিয়ে সওয়াল করে বিএনপি। এক, সাধারণ নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি। দুই, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়েছে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিষয়টি নিয়ে তারা আলোচনা করতেও রাজি নয়। আওয়ামী লীগের বক্তব্য, তা বাংলাদেশের সাংবিধানিক কাঠামোর পরিপন্থী।

সমাবেশে দাবি তুলে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ঘটানো সম্ভব নয় বলেই প্রচারে গিয়েছে হাসিনার দল। পাশাপাশি কড়া ভাষায় এটাই পশ্চিম বিশ্বকে ভোটের আগে মনে করিয়ে দিতে চাইছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা যে, বিএনপি পাকিস্তান শুধু নয়, চিনের দিকেও রাজনৈতিক ভাবে বেশি ঝুঁকে। হাসিনার বার্তা স্পষ্ট, গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলার পরিস্থিতি তখনই থাকবে, যখন ফের আওয়ামী লীগ সরকার গড়বে। অন্যথায়, বিএনপি-র ছায়াসঙ্গী কট্টর জামাত-রাজ শুরু হলে, উপরোক্ত মানবাধিকার নিয়ে চর্চা করার মতো কোনও মঞ্চই বাংলাদেশে অবশিষ্ট থাকবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE