Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
ভূত-পেতনির গল্পে ছড়িয়ে মেয়েদের জীবনচর্যার করুণ সুর
ghost

প্রেতজন্মে মুক্তির স্বাদ

ভূত-পেতনির গল্পের মজাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটু বেখাপ্পা ঠেকে। মজা ছাপিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়ে সে সময়ের মেয়েদের জীবনচর্যার করুণ সুরটি।

অশরীরী।

অশরীরী।

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২ ০৬:১৭
Share: Save:

মধ্যরাতে ঘরে অতিথি, তা হোক না অশরীরী। সে চায় কেবল মানুষের কাছে বসে মানুষের মতো একটু গল্প করতে। গল্পের ছকটি অবশ্য তেমন অভিনব নয়। ছাব্বিশ বছরে শেষ হয়ে যাওয়া জীবনের কথা শোনাতে চায় অতিথি, যা নাকি জগৎসংসারের সবচেয়ে মজার গল্প। বেঁচে যখন ছিল তখন সে যমের মতো ভয় পেত তার স্বামীকে। নিজেকে মনে হত বঁড়শিতে গেঁথে যাওয়া মাছ— স্বামী যেন তাকে টান মেরে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার জন্মজলাশয়টির স্নিগ্ধ গভীর আশ্রয় থেকে। তবে সে যন্ত্রণা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কারণ বিয়ের দু’মাস পরেই তার স্বামী মারা যায়। শ্বশুর তখন অনেকগুলি লক্ষণ মিলিয়ে দেখে নিশ্চিত হন, “শাস্ত্রে যাহাকে বলে বিষকন্যা এ মেয়েটি তাই।” এটুকু শুনেই শ্রোতা শ্লেষের সুরে বলে ওঠেন, বেশ, গল্পের আরম্ভটি বেশ মজার। এ কাহিনি রবিঠাকুরের উত্তমপুরুষে লেখা ছোট গল্প ‘কঙ্কাল’-এর ভিতরের গল্প। অনাত্মীয় পুরুষের মাথার গোড়ায় বসে মধ্যরাতে অসঙ্কোচে গল্প করতে চায় রূপসি যুবতী প্রেতিনী। লেখকের ঘরে সে তার হারিয়ে যাওয়া কঙ্কালটি খুঁজতে এসেছে।

শঙ্খচূর্ণী, পিশাচিনী, পেত্যা বা পেতনিদের এমন আজ়াদির উচ্চারণ বাংলা সাহিত্যের আনাচকানাচে উঁকি দিলেই কানে আসে। বেঁচে থেকে যে মুক্তির স্বাদ মেলেনি তাদের, তা যেন দ্বিগুণ হয়ে ফিরে আসে মৃত্যুর পরে। বেঁচে থাকার সময় যে মহিলাদের ‘দজ্জাল’ আখ্যা দেয় সমাজ, তাঁরা যে মারা যাওয়ার পরে বহুগুণে খরতর হয়ে ওঠেন, তা তো পরশুরাম দেখিয়েই দিয়েছেন তাঁর ‘ভুশণ্ডীর মাঠে’ গল্পে। কিন্তু যাঁরা ‘লক্ষ্মী সতী, ভালমানুষ অতি’? তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভূত পুরাণ’-এর মুখুজ্জেগিন্নিকে মনে করুন। মিষ্টভাষী, গৃহকর্মনিপুণা, সবার মনোরঞ্জন করে চলা ভদ্রমহিলা মারা যাওয়ার পরেই বিটকেল সব উৎপাত শুরু করলেন আশেপাশের লোকেদের উপরে। লোকেদের মাথায় বালি-কাঁকরের ঘুটিং বৃষ্টি ঘটানো থেকে পথচারীদের মাথায় রামগাঁট্টা মারা, বাদ যায় না কিছুই। আবার বাড়ির লোকেদের শাসিয়ে রাখেন যে কেউ তাঁর পিণ্ডি দিতে গেলেই তিনি তার ঘাড় মটকে দেবেন। পড়তে পড়তে এক অদ্ভুত মায়ায় ভরে যায় মনটা—চিরকিশোরীর এই দুষ্টুমি-ভরা, মুক্ত যাপনের স্বাদ হারাতে চান না প্রবীণা মুখুজ্জেগিন্নি। আহা! ভূত-জীবন অক্ষয় হোক তাঁর।

ভারতচন্দ্র লিখেছেন, “চলে ডাকিনী যোগিনী ঘোর বেশে/ চলে শাঁকিনী পেতিনী মুক্ত কেশে।” তারা “করতালি দিয়া বেড়ায় নাচিয়া—/ হাসে হি-হি হি-হি হি-হি!” ত্রৈলোক্যনাথের ‘লুল্লু’ গল্পেও দেখি ভূতিনীরা ভূতেদের সঙ্গে সমান তালে নাচে রাতের মজলিশে। ত্রৈলোক্যনাথের পুরুষ-ভূতেরা বরং মাঝে মাঝে তাঁর ‘পূর্ণযৌবনী ভূতকামিনী’দের তুলনায় লাজুক। ঘ্যাঁঘোঁর কথাই ধরুন, অনিন্দ্যসুন্দরী নাকেশ্বরীর রূপমুগ্ধ সে, কেবল চোখ ঠেরে অল্প হাসে, খুব বেশি কথাবার্তাও বলতে পারে না।

বটগাছের ডাল ধরে ঝোলে তারাশঙ্করের নৃত্যগীতপটীয়সী ফণা পেতনি। দোল খেয়ে খেয়ে তার আশ মেটে না। আবার পেত্যা বা আলেয়াদের মজলিশ বসে নদীর ধারে, মধ্যরাতে। এই আলেয়ারা সবাই মেয়ে-ভূত। চার পাশের দশ-বারোখানা গ্রাম থেকে এরা দল বেঁধে এসে যোগ দেয় প্রতি রাতের আড্ডায়।

ভূত-পেতনির গল্পের মজাটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটু বেখাপ্পা ঠেকে। মজা ছাপিয়ে যেন ছড়িয়ে পড়ে সে সময়ের মেয়েদের জীবনচর্যার করুণ সুরটি। নিতান্ত লঘু চালে লেখা ‘ভূত পুরাণ’-এর আলেয়াদের মৃত্যু হয়েছে আগুনে পুড়ে। এরা জ্বলতে জ্বলতে নিবতে নিবতে চলে। গায়ের রং “চামড়া-ওঠা ফ্যাকফ্যাকে, অর্থাৎ দগদগে লাল সাদা।” রাতের অন্ধকারে তাদের গা থেকে দপ দপ করে আগুন বেরোয়।

আবার, নেই-আঁকুড়ে দাদার পুণ্যবতী বিধবা বোন একাদশীর দিন আঙোটপাতায় ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল বলে তার মাথায় ক্রমাগত ডাঙশ মারার আদেশ দিয়েছিলেন যম। ত্রৈলোক্যনাথ অবশ্য তাকে জিতিয়ে দেন। নেই-আঁকুড়ে দাদার কাছে তর্কে হেরে গিয়ে যম তার সেই শাস্তি মকুব করে দিতে বাধ্য হন। আন্দাজ করা যায়, এক বার ভূত-জীবন প্রাপ্ত হয়ে গেলে আর বিধবার আচার-ব্যবহার মেনে চলতে হত না তাকে। বামুনের থলে থেকে মাছের মুড়োটি তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া যে মেয়ে-ভূতেদের জন্য আজকের ভাষায় সেরা ‘সোয়্যাগ’, তার নজির তো কতই রয়েছে আমাদের সাহিত্যে।

জাপানি লেখক আওকো মাৎসুদা তাঁর হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড লেডিজ় আর বইতে লিখেছেন, ছোট থেকেই সাহিত্য-সিনেমার মেয়ে-ভূতের চরিত্রগুলি খুব টানত তাঁকে। মেয়েদের চালচলন কেমন হবে তা নিয়ে সমাজের যে চলিত বিধি, তা যেন অনায়াসেই ডিঙিয়ে যায় এই চরিত্রেরা। মেয়েদের নিখাদ ইচ্ছেগুলো যেন সমস্ত পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে আসে মৃত্যুর পরের কল্পজীবনে। “আমার কাছে পেতনি-ডাকিনী বা ‘য়োকাই’-এর তফাত নেই— এরা সবাই ‘ওয়াইল্ড লেডি’,” আওকো বলেন। জাপানি লোককথা অনুযায়ী ওকিকু নামের এক মহিলাকে চুরির অপবাদ দিয়ে খুন করে এক দল পুরুষ। তারা মিথ্যে অভিযোগ করে, দশটি দামি থালার একটি সরিয়েছে ওকিকু। প্রতি রাতে ওকিকুর আত্মা সেই থালাগুলি গুনতে বসে। এক, দুই, তিন... নয় পর্যন্ত গুনেই বিস্মিত ওকিকু বলে, “সত্যিই তো একটা কম আছে!” আবার গোড়া থেকে গুনতে বসে মেয়ে। বাসনের ঝনঝন আর তার অসহায় কণ্ঠের ‘এক দুই তিন’ বাতাস চিরে দেয়। ভূতের গল্পের নিদারুণ প্রতিশোধের চেনা আখ্যান নয় এ গল্প। কিন্তু ওকিকুর সহজ বিশ্বাস, সারল্য আর নাছোড় অপেক্ষাই ভীষণ ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে তার বেঁচে থাকা পুরুষ-শত্রুদের কাছে। মনে পড়ে যায় অমর কৌশিকের হিন্দি ছবি স্ত্রী। প্রতি রাতেই ফিরে যায় চুড়েল, তাকে কাল আসতে বলা হয়েছে বলে। তবু তার ভয়ে কাঁপতে থাকে সমস্ত পুরুষ। স্ত্রী বাইরে গেলে মাথায় ঘোমটা টেনে ঘরে দোর দিয়ে বসে থাকে তারা, একা থাকতে ভয় পায়।

ইন্দোনেশিয়ার আইনবিদ্যার গবেষক গীতা পুত্রী দামায়না লিখেছেন, লোককথা ঘাঁটলে দেখা যায় মেয়ে-ভূতেরা সবাই যেন ‘ভিকটিম’। তাদের বিরুদ্ধে ঘটা অপরাধের ভয়াবহতাই যেন তাদের ভীতিপ্রদ করে তোলে। পড়তে পড়তে মনে হয় যেন তারাশঙ্করের রসি পেত্যার বৃত্তান্তের কথাই বলছেন গীতা। জলে গা ভিজিয়ে মধ্যরাতে যে চিৎকার করে ওঠে, ‘জ্বলে মলাম’ বলে। ইন্দোনেশিয়ার সবচেয়ে আলোচিত দুই মেয়ে-ভূত, কুন্তিলক আর সুন্দেল বোলোং। দু’জনেই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। সুন্দেল বোলোং ধর্ষিত হয় এবং তার গর্ভে আসে সন্তান। ইন্দোনেশীয় লোককথা অনুযায়ী কুন্তিলক সদ্যোজাত শিশুদের চুরি করে নিয়ে যায় আর সুন্দেল বোলোং রাতবিরেতে একলা পুরুষদের দেখলেই তাদের ভয় দেখায়।

মেয়ে-ভূতেদের অবাধ স্বাধীনতা দেখে আওকোর ঈর্ষা হয়। তাদের মতো হয়ে উঠতে ইচ্ছে করে। আদর্শ ‘নারীসুলভ’ আচরণ কোনটি তা নিয়ে সর্ব দেশ ও সর্ব কালের পুরুষদের মাথাব্যথার অন্ত নেই। এ দেশের আধুনিক মেয়েরাও যদি আজ ‘মুণ্ডুঝোলা উল্টোবুড়ি’ বা ‘চাঁদনীরাতের পেত্নীপিসি’কে রোল মডেল বানাতে চান তবে সমাজের স্বঘোষিত অভিভাবকেরা নিশ্চয়ই তা ভাল চোখে দেখবেন না। এ বিষয়ে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের লিঙ্গতত্ত্বটি স্মর্তব্য। বছর ছয়েক আগে তিনি একটি প্রবন্ধে লেখেন— দয়া, বিনয়, প্রেম এই জাতীয় ‘নারীসুলভ’ গুণগুলি আয়ত্ত করতে পারলে দেবত্ব প্রাপ্ত হন পুরুষেরা। কিন্তু শৌর্য বা পুরুষার্থ একান্ত ভাবেই পুরুষের গুণ। এগুলি কোনও মহিলার মধ্যে দেখা দিলে তিনি রাতারাতি হয়ে ওঠেন অপদেবতা বা ভূত। নৃতত্ত্বের গবেষণায় উঠে এসেছে, উত্তর ভারতের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নববধূরা অনেক সময়ে ভূতে-পাওয়ার ভান করেন। সেই ভাবে কয়েকটা দিন মুক্ত জীবনের স্বাদ উপভোগ করেন তাঁরা, ঠিক যেন তারাশঙ্করের মুখুজ্জেগিন্নি।

অর্থনীতি বিভাগ, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ghost Society Women
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE