জীবনে তো বটেই, মৃত্যুর পরেও স্বদেশের প্রচারমাধ্যমে ব্রাত্য ছিলেন তিনি। ২০১৭-র ১৩ জুলাইয়ের পর চিনা ওয়েবসাইট ‘ওয়েইবো’তে তাঁর নাম বা ছবি দিয়ে খুঁজলে আসছিল, দেশের আইন ও নীতি অনুযায়ী এই ‘সার্চ রেজ়াল্ট’ প্রকাশ্য নয়। মোমবাতির ছবি, ইমোজি, এমনকি ‘আরআইপি’ লিখলেও মুছে দেওয়া হচ্ছিল তা। স্বৈরতন্ত্রী আবহে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশে দেশে যুগে যুগে লড়ে গিয়েছেন বহু প্রাণ, তাঁদের মধ্যেও অনন্য লিউ জিয়াওবো— চিনের নির্যাতিত, নিঃসঙ্গ বিবেকের কণ্ঠস্বর তিনি। প্রতিটি ১৩ জুলাই আজও মনে করিয়ে দেয় তাঁর জীবনমন্ত্র: ‘ফ্রিডম’।
বাক্স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার, সর্বোপরি তাঁর বিচারে মাও-প্রভাবিত ‘ঘৃণা, হিংসা ও ঔদ্ধত্যে পূর্ণ’ মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে নৈতিক মূল্যবোধযুক্ত, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক, মানবিক চিনের স্বপ্নে নানা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন লিউ। তিয়েনআনমেন স্ক্যোয়ারে নির্বিচারে ছাত্র-হত্যার ঘটনা তাঁর জীবনকে অন্য খাতে প্রবাহিত করে। সেই ছাত্রদের মায়েদের উদ্দেশে কবিতা লিখেছেন, কারাবরণ করেছেন স্বৈরতন্ত্রের প্রতিবাদে। জেলে নোবেলপ্রাপ্তির খবর শুনে পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন তিয়েনআনমেনের শহিদদের। চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যমের প্রতিক্রিয়া ছিল, এই পুরস্কার চিনের আইনি সার্বভৌমত্বে অভব্য হস্তক্ষেপ। ২০১৭-র ১৩ জুলাই কারাগারে লিউয়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে প্রশাসন অবিশ্বাস্য তৎপরতায় তাঁর দেহ সৎকার করে, ভস্ম সমুদ্রে ফেলে বিবেকের কণ্ঠস্বর ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিল।
জীবনের অধিকাংশ সময়ই কারান্তরালে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে যখনই সরব হয়েছেন, কারাগার বা শ্রম শিবিরে আটক করে রাখা হয়েছে তাঁকে। ১৯৮৯-এর ২ জুন কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে তিয়েনআনমেন স্ক্যোয়ারে সমবেত ছাত্রদের অনশন ধর্মঘটে শামিল হন; চিনা ট্যাঙ্কের আক্রমণে অগণিত ছাত্রের মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করে। বহু ছাত্র গ্রেফতার হন, ‘প্রতিবিপ্লবী দাঙ্গার সংগঠক’ অভিযোগে লিউও। উনিশ মাস কারাবাসের পর মুক্তি পেলেও জীবন হয়ে ওঠে কণ্টকময়। প্রশাসন তাঁর সব লেখার প্রকাশ নিষিদ্ধ করে। পড়ানোর চাকরি চলে যাওয়ায় আর্থিক দুরবস্থায় পড়েন। যদিও অনটন মুক্তচিন্তায় বাধা হতে পারেনি। ১৯৯৬-এ চিনের একদলীয় শাসনব্যবস্থার সমালোচনা করায় আবার তাঁকে তিন বছরের জন্য শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়।
বন্দিশালায় তিয়েনআনমেন-এর প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপনে লিউ লিখেছেন, “মার গুলি— খুন কর/ খুন কর— গুলি মার/ শান্তিপূর্ণ আবেদন, অস্ত্রহীন হাত/... জল্লাদের হেলদোল নেই/ চোখ পুড়ে লাল/ বন্দুক ব্যারেলে লাল ছিটে/ হাতগুলি রক্তে লাল/ প্রত্যেকটি বুলেট থেকে উপচে পড়ে থকথকে গোপন জঘন্যতম অপরাধ।” (কবিতা: ‘মৃত্যুর অভিজ্ঞতা’)। ‘একটি কাঠের পাটাতনের আত্মকথা’ কবিতায় লিখছেন, “আমি শুধু এক বরবাদ কাঠের পাটা/ গড়িয়ে আসছে হিংস্র ইস্পাত গুঁড়িয়ে দিতে তোমাদের/ কী করে রুখব তাকে?/ তবু আমি বাঁচাতে চাই/ প্রত্যেককে/ ইতিমধ্যে মরে গেল যারা, শেষ শ্বাসটুকু নিভে গেল যাদের...”
তিয়েনআনমেন স্ক্যোয়ারে অগণিত ছাত্রের মাঝে লিউ যে ইস্তাহার পাঠ করেছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হননি। বলেছিলেন, চিনের নাগরিকরা গণতান্ত্রিক নীতিতে দেশ পরিচালনার অধিকার থেকে বঞ্চিত। কিন্তু ঘৃণা, শত্রুতা দিয়ে একটা গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করা যায় না। সেটা করা যায় আলোচনা, বিতর্ক ও ভোটের পথে; পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মান, সহিষ্ণুতার ইচ্ছা থেকে। মানবাধিকার আন্দোলনে অগ্রণী এই মানুষটি জীবনের শেষ সীমায় এসেও বলেছেন, কারও সঙ্গে তাঁর শত্রুতা নেই, ঘৃণা নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কবি ও মানবাধিকার কর্মী লিউ ছাত্রদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় বলে রাষ্ট্রশক্তি তাঁকে বাঁকা নজরেই দেখত। রাজনীতি সাহিত্য ইতিহাস সর্বস্তরেই ছিল তাঁর অবাধ যাতায়াত। কবিতায় গেয়েছেন গণতন্ত্রের জয়গান; মাও যুগের নির্মমতার বলি, তাঁর পূর্ববর্তী চিনা মনীষী লিন ঝাও-এর প্রতি শ্রদ্ধায় লিখেছেন গদ্যকবিতা।
একদলীয় শাসনের অবসান, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, বিরুদ্ধ রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের অধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার গঠনের দাবি নিয়ে ২০০৮-এ ‘চার্টার ০৮’ নামে মানবাধিকারের ইস্তাহার প্রকাশ করেন প্রায় তিনশো চিনা বুদ্ধিজীবী। এই সনদের খসড়া সম্পাদনায় বিশেষ ভূমিকা ছিল লিউয়ের। দশ হাজারেরও বেশি মানুষ সনদে স্বাক্ষর করায় চিনা প্রশাসন তৎপর হয়ে ওঠে, শুরু হয় ধরপাকড়, জেরা। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণের অপরাধে ২০০৯-এর জুনে এগারো বছর কারাদণ্ডের সাজা পান। ‘শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনের পক্ষে’, শুধু এই শব্দবন্ধের উল্লেখেই তাঁকে রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমাণে সফল হয় প্রশাসন।
নোবেলপ্রাপ্তির অনুষ্ঠানে যে রচনাটি তাঁর অনুপস্থিতিতে পাঠ করা হয়, সেখানে লিউ লেখেন, “আমি আশা করি, চিনের অন্তহীন ‘ইনকুইজ়িশন’-এর আমিই শেষ বলি হব, এর পর থেকে আর কাউকে শুধু কথা বলার জন্য শাস্তি পেতে হবে না।” কোনও এক দিন চিনে গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, এই প্রত্যয়ই ছিল সঙ্গী।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)