সমুদ্রের ফসল বয়ে ভোর তিনটে থেকে মোটরবোট এসে ভিড়তে থাকে বিশাখাপত্তনমের ল্যান্ডিং হারবার-এ। এগারোটা জেটিতে এসে লাগে ষাট-সত্তরটা বোট। কী না আসে তাতে! মার্লিনের মুড়োটাই বড়সড় কাতলার সমান। কাঁকড়ার মাথায় তিনটে কালো বুটি, যেন তিন চোখ। কাঁসার বগিথালা মাপের চিনে পমফ্রেট, পেল্লায় চিংড়ি, চ্যাটালো স্টিংরে। আরও আশ্চর্য, এত বড় মাছের বাজারে খরিদ্দার শুধু মেয়েরা। দরদাম করছেন, নগদ টাকা দিচ্ছেন, মাথায় মাল বয়ে তুলছেন অটো রিকশায়। এখানে টাটকা মাছ বিক্রেতাদের ৯৫ শতাংশ মেয়ে। আর মাছ ফেরিওয়ালাদের ১০০ শতাংশ মেয়ে।
শ্রীহরিপুরম বাজারে এম নাকাম্মা, কে কাসালাম্মা জানালেন, রবিবার ত্রিশ-চল্লিশ হাজার টাকার মাছ কেনেন তাঁরা। সপ্তাহের দিনগুলোতে হাজার কুড়ি টাকার। এ ছাড়া আছে শুঁটকি মাছের কারবার। সেখানে মেয়েরাই সব। তাঁরাই মাছ কেনেন, নুন মাখিয়ে শুকোন, বিক্রি করেন। বেজায় খাতির প্রবীণা পি মাসিনাম্মার— পাইকারি ব্যবসা করে কেন্দ্রীয় সংস্থার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। ভিন রাজ্যেও যায় তাঁর শুঁটকি-বাহী ট্রাক। মাছ-বিক্রেতা মেয়েরা তৈরি করেছেন নিজেদের কোম্পানি, ‘স্মল স্কেল ফিশারিজ়-ফিশ প্রোডিউসার্স কোম্পানি, গাজুওয়াকা’। মেয়েদের স্বনির্ভরতা নিয়ে কর্মরত একটি অসরকারি সংস্থার পক্ষে উজ্জয়িনী হালিম জানালেন, মাছের চিপস-সহ নানা রকম প্যাকেটের খাবার তৈরি করে রোজগার বাড়ানোর কাজে হাত দিয়েছেন এই মেয়েরা। চুক্তি করেছেন ‘আইএফবি’-সহ নানা সংস্থার সঙ্গে।
আর এ রাজ্যে? এ যদি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন না হয়ে রঙ্গমঞ্চের অভিনয় হত, তবে সূত্রধর এ প্রশ্ন করে নীরব হতেন, আলো মৃদু হয়ে আসত। সত্যিই তফাতটা নাটকীয়। মৌসুনি দ্বীপ, পাথরপ্রতিমা, বাসন্তী, কুলপির মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বললে আন্দাজ হয়, মাছের কারবারে এ রাজ্যের মেয়েরা কতখানি শ্রম দেন, আর বিনিময়ে পান কতটুকু। এখানে সমুদ্র থেকে ডাঙায় এসে মাছ ঢোকে আড়তে, নৌকার মালিকের সঙ্গে চুক্তি থাকে আড়তদারের। মাছ বিক্রেতারা আড়ত থেকে কিনে বাজারে বিক্রি করেন। এই খুচরো বিক্রেতাদের মধ্যে কিছু মেয়েও থাকেন। তবে এ রাজ্যে সামুদ্রিক মাছের ক্ষেত্রে মেয়েদের প্রধান কাজ শুকুনি-বাছুনির— তোপসে, ফ্যাসা, চিংড়ি, কাঁকড়া আলাদা করা। সস্তার মাছ নীচে বিছিয়ে শুকোনো, আর দামি মাছ টাঙিয়ে শুকোনো। দৈনিক মজুরি পুরুষদের পাঁচশো-ছশো টাকা, মেয়েদের দু’শো-তিনশো টাকা।
মেয়েদের বরাতই যেন অর্ধেকের। সুন্দরবন অঞ্চলে অগণিত মেয়ে বাগদার মীন, ছোট চিংড়ি, মাছ, কাঁকড়া ধরেন। পাথরপ্রতিমার সুপ্রিয়া পাল, বাসন্তীর লালবানু শেখ জানালেন, মেয়েরা মাছ বিক্রি করতে গেলে আড়তদার বাজারদরের প্রায় অর্ধেক দাম দেয়। “ডিম-ভরা কাঁকড়ার জন্য আমাকে দেবে ৪২০ টাকা কিলো। বাজারদর কিন্তু ৮৫০ টাকা।” বাগদার হাজার মীন বিক্রি হয় তিনশো থেকে পাঁচশো টাকায়। মেয়েরা দূরের বাজারে গিয়ে মাছ বিক্রি করতে পারবেন না, বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে। তা ছাড়া, এক-দু’দিন মাছ বিক্রি না হওয়ার ক্ষতি সইতে পারার মতো পুঁজি মেয়েদের নেই। এ সব তথ্য আড়তদার, পাইকারদের হাতের মুঠোয়। আর আছে বেশি দর দেওয়ার লোভ দেখিয়ে গায়ে হাত-দেওয়া ব্যবসায়ীরা। তাই স্ত্রী-পুরুষ মিলে নৌকায় তিন-চার দিন ধরে নদী থেকে মাছ, কাঁকড়া ধরে আনেন, কিন্তু পুরুষটিই বাজারে তা বিক্রি করেন। মেয়েটির ভাগ? “বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে দু’দশ টাকা চেয়ে নিই,” বললেন সুরাইয়া ঘরামি। বাড়ির কাজের ফাঁকে জাল বানান মেয়েরা। সুতোর দাম বাদ দিলে মজুরি দাঁড়ায় ঘণ্টায় সাত-আট টাকা।
বাজারের মারের চাইতেও মারাত্মক সরকারের মার। সুন্দরবনে মাছধরা বোটের লাইসেন্স-এর জন্য আবেদন করেও মিলছে না প্রায় দু’দশক। বাধ্য হয়ে ষাট-সত্তর হাজার টাকায় অন্যের লাইসেন্স-প্রাপ্ত নৌকা ‘লিজ়’ নিয়ে যাচ্ছেন জেলেরা। হতদরিদ্ররা যাচ্ছেন কপালের ভরসায়। তাঁদের নালিশ, বন বিভাগের কর্মীরা ধরতে পারলে কেড়ে নেয় জাল, নৌকা। অনেক টাকা ‘জরিমানা’ দিয়ে ছাড়াতে হচ্ছে। লাইসেন্স-প্রাপ্ত নৌকা ‘লিজ়’ দেওয়া অবৈধ। কিন্তু ব্যবসাটা লাভজনক, ঘরে বসে রোজগার হয় মালিকের। স্থানীয় নেতারাও তাতে যুক্ত। “গ্রাম পঞ্চায়েত, জেলা পরিষদ, মৎস্যজীবীদের সংগঠন, বন দফতর, নানা দিকের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটি তৈরি করা, এবং প্রকৃত মৎস্যজীবীদের চিহ্নিত করে লাইসেন্স পুনর্বণ্টনের প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমি,” বললেন বন দফতরের এক প্রাক্তন আধিকারিক। মুখ্যমন্ত্রীর সই নিয়ে ফাইল ঘুরে এসেছে, তবু সে প্রস্তাব কার্যকর করা যায়নি।
বৈধতার অভাবে শ্রমজীবীর হয়রানি, এ যেন পশ্চিমবঙ্গের বৈশিষ্ট্য। বিশাখাপত্তনমে মৎস্যজীবী মেয়েরা বললেন, তাঁদের তিন ধরনের পরিচয়পত্র রয়েছে। একটি নিজেদের সংগঠনের সদস্যপদের কার্ড। একটি দেয় মৎস্য দফতর, যাতে মেয়েরা ঢুকতে পারেন হারবারে, মাছ কিনতে। তৃতীয়টি মাছ-বিক্রেতার পরিচয়পত্র, যা দেয় পুরসভা। পশ্চিমবঙ্গে মৎস্যজীবীদের নালিশ, ব্লক অফিসে ফিশারি এক্সটেনশন অফিসারের কাছ থেকে মৎস্যজীবীর পরিচয়পত্র (যা থাকলে পাওয়া যায় জাল, নৌকা, বর্ষার দু’মাস রোজগারহীনতার জন্য ভাতা) বার করতে ঘুষ দিতে হয়। ইস্ট কোস্ট ফিশওয়ার্কার্স ইউনিয়ন-এর নেতা শ্রীকান্ত সাহু সাফ জানালেন, “যাঁরা মৎস্যজীবী নন, অধিকাংশ পরিচয়পত্র তাঁদের হাতে। রাজনৈতিক সংযোগে এটা হচ্ছে।” আর একটা লড়াই চলে উপকূল আর নদীর পাড়ের দখল নিয়ে। দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম-এর নেত্রী তাপসী দলুই জানালেন, যেখানে জেলেরা নৌকা শুকোন, জাল শুকোন, সেই জায়গাগুলো বন বিভাগ ঘিরে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। “আমি মেয়েদের নিয়ে গিয়ে সে সব খুঁটি উপড়ে দিয়ে আসি।”
বন দফতরের চোখে অবৈধ নৌকা বনসম্পদের ঝুঁকি। চোরাশিকারিরা নাকি হরিণ মেরে মাছের হাঁড়িতে তার মাংস লুকিয়ে রাখে। আর নদীজীবীরা বলেন, কেমন করে নেতাদের যোগসাজশে সুন্দরী গাছ নিকাশ করে ভেড়ি করা হচ্ছে। নদীর পাড় ঘিরে দিলে জল জমে, উঠে যায় শ্বাসমূলের উপরে, নিঃশ্বাস নিতে না পেরে ম্যানগ্রোভ মারা যায়। বন দফতর কি দেখছে না? তেমনই, ছোট নৌকা তো আটকাচ্ছে, ট্রলার আটকাচ্ছে কে? সমুদ্রের তলদেশ অবধি জাল নামিয়ে, সমস্ত জলজপ্রাণী নির্বিচারে টেনে তুলছে ট্রলার। ভারত-উপকূল জুড়ে ছোট মৎস্যজীবীদের হাহাকার, আগের মতো মাছ নেই।
এই বিপর্যয় সার্বিক, কিন্তু মেয়েদের কষ্টের মাত্রাটা আলাদা। বিশাখাপত্তনমের রাস্তায় যে মেয়েরা মাছ বিক্রি করেন, তাঁরা দুপুর দুটো-তিনটে অবধি গলা দিয়ে খাবার-জল নামান না। বাথরুম কই? মাছের জল মাথার পাত্র থেকে গায়ে পড়ে দুর্গন্ধ ছাড়ে। গৃহস্থ এঁদের বাইরে বসিয়ে মাছ কুটিয়ে নেয়, বাড়ির ভিতরে ঢুকতে দেয় না। এ রাজ্যে বুক-জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে বাগদার মীন ধরেন যে মেয়েরা, তাঁদের স্বাস্থ্যের কথা তোলাও পরিহাস। মীন ধরার কাজটাকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে সরকার দায় সেরে ফেলেছে। মেয়েরা ভুগছেন চর্মরোগে, প্রজনন-অঙ্গের প্রদাহে।
অন্ধ্রে একটা স্কিম চালু ছিল, যেখানে বরফবাক্স-সহ সাইকেল ভর্তুকিতে দেওয়া হত। বছর তিনেক তা বন্ধ— কেন্দ্রের অনুদান যাচ্ছে বড় এক্সপোর্টারদের প্রসেসিং, প্যাকেজিং-এর পরিকাঠামো তৈরিতে। এ দিকে একশো কুড়ি কোটি টাকা খরচে মাছ নিলামের নতুন বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে ল্যান্ডিং হারবারে। ও দিকে মেয়েরা বাধ্য হচ্ছেন মাথায় করে মাছ বইতে। বাংলায় বরফবাক্স কে কবে পেয়েছেন, মেয়েরা মনে করতে পারলেন না। প্রশাসনের নিষ্ঠুরতা আর আড়তদারের জোচ্চুরির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হবে, জেনেই মেয়েরা ঘরের কাজ সেরে বেরোন মাছ শুকোতে, উঠে বসেন মাছ-ধরা নৌকায়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)