কয়েক দিন আগে হয়ে গেল ১৭তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন। সেখানে চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে দেখাই যায়নি, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও দায়সারা ভাবে অনলাইনে কাজ সেরেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবর্তিত আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্রিকস-এর গুরুত্ব কমছে। যে কথাটা বেশি উঠে আসছে না, তা হল, চিন এবং রাশিয়া শুধু যে নিজেদের মধ্যেই সম্পর্ক গাঢ় করে তুলছে তা নয়, ব্রাজ়িলের সঙ্গেও দুই দেশ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে চলেছে। চিন বহু দিন ধরেই ব্রাজ়িলের গুরুত্বপূর্ণবাণিজ্যসঙ্গী, রাশিয়াও ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুলা ডা সিলভাকে সাদরে ডেকে নিচ্ছে নতুন জোটের সন্ধানে। অর্থাৎ, ব্রিকস-এর গুরুত্ব উপর-উপর কমলেও তার প্রধান তিন সদস্য নিজেদের মধ্যে সমানে সমন্বয় সাধন করে চলেছে। যে দেশটিকে নিয়ে সত্যিই কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না, সেটি হল ভারত। সার্ক, ব্রিকস, কোয়াড— ভারত আছে সর্বত্রই, আবার কোথাওই নেই।
নরেন্দ্র মোদীর ঘোষিত বিদেশনীতি হল কোনও বিশেষ রাজনৈতিক অক্ষের কাছাকাছি না থাকা। এর সঙ্গে কেউ নেহরুর নিরপেক্ষ থাকার বিদেশনীতির মিল পেলে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, নেহরু এবং মোদীর পথ দু’টির মধ্যে বিস্তর ফারাক। নেহরু একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শকে ভিত্তি করে এগিয়েছিলেন, আর মোদীর প্রায় কোনও আদর্শগত ভিত্তিই নেই। প্রায় বললাম এই কারণে যে, দুনিয়ার চরম দক্ষিণপন্থীদের মোদী বুকে টেনে নিতে ভালবাসেন, কিন্তু তাতেও চিঁড়ে ভেজে না। নেহরুর আদর্শ ছিল বলে তাঁর জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে টিটো, সুকর্ন, নাসেরের মতন রাষ্ট্রনায়কদের পাশে পেয়েছিলেন। মোদীর পাশে হাঁটার জন্য কেউ নেই।
বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বারে বারেই বলেন যে, বিশ্ব-রাজনীতির অসঙ্গতিগুলো ধরে সে মুহূর্তে যোগ্য সঙ্গী খুঁজতে হবে। কথাটা খারাপ না, কিন্তু অসঙ্গতি খোঁজার মূলমন্ত্র যদি হয় স্বল্পমেয়াদি মুনাফা, তা হলে বিপদ ঘটবেই। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর না রাশিয়া এসে পাশে দাঁড়ায়, না আমেরিকা দেয় প্রাপ্য গুরুত্ব। রাশিয়া এবং ইজ়রায়েলের সাম্প্রতিক আগ্রাসনে সামান্যতম হেলদোল না দেখিয়ে ভারত এত দিনে ইউরোপের কাছেও বহুলাংশে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, ফলে ‘গ্লোবাল সাউথ’ অর্থাৎ উন্নয়নশীল দেশগুলিকে কাছে পাওয়ার জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মূল ভরসা এখন ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুলা।
প্রশ্ন উঠতে পারে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতিকে যথাযথ রাজনৈতিক গুরুত্ব না দিলে আমেরিকা, ইউরোপেরও কি ক্ষতির সম্ভাবনা নেই? থাকতে পারে, কিন্তু ভারতের নিজস্ব ক্ষতির পাশে সেটা যৎসামান্য। প্রথমত, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এই দুই বাণিজ্যক্ষেত্রেই ভারতের রফতানির পরিমাণ আমদানির চেয়ে অনেক বেশি। সুতরাং, আমেরিকা বা ইউরোপ মুখ ঘুরিয়ে নিলে আখেরে বিপদ ভারতেরই। যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কসংক্রান্ত সব রকম ব্ল্যাকমেল সহ্য করতে হচ্ছে, চুপ করে দেখতে হচ্ছে ট্রাম্প মোদীর সঙ্গে বৈঠক বানচাল করে দিলেও হোয়াইট হাউস সাদরে লাল কার্পেট বিছিয়ে দিচ্ছে পাকিস্তানের সামরিক প্রধানের জন্য। ছয় বছর আগে মোদী ‘অব কি বার, ট্রাম্প সরকার’ বলে এলেও ট্রাম্পের কাছে ভারত যে এখনও তৃতীয় বিশ্বের বেশি কিছু নয়, সে কথা পরিষ্কার।
আর শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যই নয়, এই মুহূর্তে ভারতের যেন তেন প্রকারেণ বিদেশি পুঁজি দরকার। বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগ ভারতে ক্রমেই কমছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য জানাচ্ছে, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতে মোট প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৩৫.৫ কোটি ডলার— গত বছরের ১০০০ কোটি ডলারের তুলনায় প্রায় ৯৬.৫% কম। চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হলেও বিশ্বব্যাপী বিদেশি পুঁজির মাত্র ২ শতাংশ আসে ভারতে। এবং, জো বাইডেনের সময় থেকেই আমেরিকা ভারতকে উৎপাদন প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখছে। চিনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধে ভারতের লাভ বিশেষ হয়নি, তার বড় কারণ হল আমেরিকা পরোক্ষে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে মেক্সিকো বা ভিয়েতনামের মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল অর্থনীতিকে।
কয়েক মাস আগে ভারতের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা বর্তমান বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে ‘মহিমান্বিত বিদেশসচিব’ আখ্যা দিয়েছেন। জয়শঙ্কর ছ’বছর ধরে বিদেশমন্ত্রীর পদে আছেন— গরম ভাষণে তাঁর জুড়ি মেলা ভার, অথচ তাঁর সময়েই ভারতের বিদেশনীতির লেজামুড়ো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জয়শঙ্করের অদূরদর্শিতা সাম্প্রতিক কালে বার বার ভারতের মুখ পুড়িয়েছে। দু’বছর আগেই চিনের অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ভারতের মতো ছোট অর্থনীতি চিনের সঙ্গে কী করে পাল্লা দিতে পারে! অথচ আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-জাপানের সঙ্গে তৈরি কোয়াড নামক কূটনৈতিক মঞ্চটি তৈরিই হয়েছিল নিরাপত্তার বিষয়ে চিনের অর্থনৈতিক ক্ষমতা যাতে বাকিদের জন্য প্রতিবন্ধক না হয়ে দাঁড়ায় তা নিশ্চিত করতে। জয়শঙ্করের বক্তব্য প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল কোয়াড মঞ্চটির কার্যকারিতা সম্বন্ধে। ট্রাম্পের আমলে মঞ্চটির অক্ষমতা নিয়ে আর সন্দেহই রইল না। একই ভাবে অপারেশন সিঁদুরের পরেও জোর গলায় ‘কাশ্মীর প্রসঙ্গে ভারত আর কারও সালিশি মানবে না’ বলেই ট্রাম্পের মধ্যস্থতা নামক কিলটি বেবাক হজম করে ফেলতে হয়েছে।
তবে সবচেয়ে বড় ভুল, সার্ককে সরাসরি নাকচ করে দেওয়া— পাকিস্তানকে ঢিট করতে গিয়ে আঞ্চলিক প্রতিপত্তির অনেকটাই চিনের হাতে তুলে দেওয়া। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বাংলাদেশে চিনের প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু শুধু বাংলাদেশ বা পাকিস্তান নয়, দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই চিনের প্রভাব ভারতের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৩-এ মলদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট এসেই তাঁর দেশ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বার করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। বহু চেষ্টায় মলদ্বীপে ভারত খানিক প্রভাব পুনরুদ্ধার করেছে বটে, কিন্তু অন্য দিকে বিপত্তি অব্যাহত। যেমন, একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা জানিয়েছে যে, ডোকলাম উপত্যকায় ভুটানের প্রায় ২ শতাংশ জমিতে চিন তৈরি করছে সামরিক পরিকাঠামো— সেই ডোকলাম, যেখানে ২০১৭ সালে ভারতীয় এবং চিনা বাহিনীর সরাসরি সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছিল।
সীমান্তসুরক্ষা নিয়ে আশঙ্কা তো থাকছেই, ভারতের দিগ্ভ্রান্ত বিদেশনীতি অর্থনৈতিক সুরক্ষার পরিপ্রেক্ষিতেও কোনও দিশা দেখাতে পারছে না। তাইওয়ানের একাধিক সেমিকন্ডাক্টর সংস্থা ভারতে উৎপাদন নিয়ে প্রাথমিক আগ্রহ দেখালেও গত দু’বছরে পিছিয়ে এসেছে। পিছিয়ে আসার বড় কারণ ভারতের বর্তমান বিদেশনীতি, যেখানে পশ্চিমি দেশগুলির তুলনায় বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে রাশিয়া। রাশিয়ার সস্তা তেল ভারতকে গত তিন বছরে খানিক স্বস্তি দিলেও প্রশ্ন উঠছে রাশিয়ার কাছাকাছি থাকার দাম ভারতের জন্য বড় বেশি পড়বে কি না। তাইওয়ানের সংস্থাগুলি ভারতের পরিবর্তে বিনিয়োগ করছে জাপান বা জার্মানির মতো দেশে, আর আমেরিকা তো আছেই।
কিন্তু অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গায় যদি কোনও দেশকে নিয়ে ভারতের সত্যি চিন্তার জায়গা থাকে, তা হল ভিয়েতনাম। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের একাধিক বড় সংস্থা ভিয়েতনামে সমানে বিনিয়োগ করে চলেছে, আবার চিনের সঙ্গেও ভিয়েতনামের বাণিজ্যিক সম্পর্ক রীতিমতো ভাল। ফলে ভিয়েতনামে জাতীয় সম্পদের প্রায় ৪.৫% হল বিদেশি বিনিয়োগ, আর ভারতে ১ শতাংশেরও কম। এই হিসাবে ভিয়েতনাম বরং কোনও নির্দিষ্ট অক্ষের কাছাকাছি না থেকেও প্রায় সমস্ত উন্নত দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে পেরেছে। তবে বিদেশনীতির পাশাপাশি এ কথাও সত্যি যে, ভিয়েতনামের শ্রমদক্ষতার প্রতি উন্নত দেশগুলির এই মুহূর্তে অনেক বেশি ভরসা। ভারতের তরুণ শ্রমশক্তিকে গত ১১ বছর ধরে সরকার কী ভাবে বঞ্চিত করে চলেছে, তার ইতিহাস আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না— ফল হয়েছে এই যে, না দেশে আছে চাকরি, না বিদেশের আছে বিশ্বাস। যে কারণে ‘ভারতবন্ধু’ অ্যাপল বহু ঢক্কানিনাদের পরেও অধিকাংশ উৎপাদন এখনও চিনেই করে চলেছে।
সর্বাধিপত্যকামী শাসকরা আর কবেই বা বিশ্লেষণের পরোয়া করেন! সমস্যা এই যে, তাঁদের যাওয়ার সময়ে উন্নয়নশীল দেশকে স্বপ্ন দেখানোর রসদটুকুও আর থাকবে না, উন্নত হওয়া তো দূরস্থান।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)