E-Paper

সুখহীন নিশিদিন পরাধীন

ভারত বছরে মোট জিডিপি-র এক শতাংশের কম গবেষণায় ব্যয় করে; আমেরিকা, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া খরচ করে তার চার থেকে ছয় গুণ।

স্বাগতম দাস

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৭

তোতা কাহিনী’তে রাজা চেয়েছিলেন তাঁর রাজ্যের এক সাধারণ পাখিকে জ্ঞানী করতে। পণ্ডিতেরা সভা বসালেন, বইপত্র বাঁধা হল, নতুন স্কুল তৈরি হল, কিন্তু শেষে দেখা গেল— তোতার প্রাণ, গলার গান আর নেই, আছে শুধু বই আর খাঁচা। অমৃতকালের ভারতে উচ্চশিক্ষার ছবিটা যেন এর আধুনিক সংস্করণ। বিশাল ভবন, নতুন নীতি, ফান্ডিং এজেন্সি, চার্টার ও নির্দেশিকা— হারিয়ে গেছে জ্ঞানের স্বাধীনতা, শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, গবেষকের কৌতূহল। জ্ঞান নয়, প্রক্রিয়াটাই লক্ষ্য। পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ভারত আজ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু এই সংখ্যার চকচকে কাচের আড়ালে আছে ক্লান্ত শিক্ষক, দিশাহীন গবেষক, আর সেই সব তরুণ যাদের শিক্ষা ধীরে ধীরে পণ্য হয়ে উঠছে।

দিল্লির এক গবেষক ছাত্রের কথা শুনছিলাম, “ফেলোশিপ আসে দু’মাসে এক বার, কখনও তিন মাসেও না। হস্টেলের ফি তিনগুণ হয়েছে, টিউশন পড়িয়ে কোনও ক্রমে খরচ চালাই, গবেষণা করব কবে?” একই স্বর আজ হাজারো তরুণ গবেষকের। সরকারি বাজেটে বৃত্তির তহবিল ৬০ শতাংশ কমে যাওয়ার পরে ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট (নেট)-বহির্ভূত ফেলোশিপ এক প্রকার নামমাত্র। অনেকেই হস্টেল ছেড়ে সস্তা ঘরে থাকে, যতটা খেলে পেট ভরে তার অর্ধেক ভাত খায়।

ভারত বছরে মোট জিডিপি-র এক শতাংশের কম গবেষণায় ব্যয় করে; আমেরিকা, চিন, দক্ষিণ কোরিয়া খরচ করে তার চার থেকে ছয় গুণ। বাজেট বন্দোবস্তটি যেন সেই কৃষক যে বীজ বুনেছে কিন্তু জমিতে জল দিচ্ছে না। খেত শুকিয়ে যাচ্ছে, ফসল ফলছে না, অথচ বাইরে থেকে তাকালে সবুজের রং এখনও চোখে লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণার টাকায় ল্যাবের ভাড়া, যন্ত্রপাতি, এমনকি বিদ্যুতের বিল মেটানো কঠিন। অনুদান আসে দেরিতে, ফেলোশিপ বাড়ে নামমাত্র, অথচ ফি ও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়েছে পাহাড়প্রমাণ।

স্বাধীনতার পর কী-ই বা ছিল ভারতের অর্থনৈতিক সংস্থান? অথচ তখনই তৈরি হয় আইআইটি, আইএসআই, ইসরো-র মতো প্রতিষ্ঠান— রাষ্ট্রের লক্ষ্য ছিল জ্ঞান সৃষ্টি, মুনাফা নয়। গবেষণাখাতে অনুদান ও বৃত্তির জন্য সদ্যোজাত রাষ্ট্রের কোষাগারে খুব ঘাটতি হয়নি। সেই রাষ্ট্রই আজ ব্যবসায়ীর ভূমিকায় উচ্চশিক্ষার ময়দানে অবতীর্ণ। জেএনইউ-এ এককালীন মেডিক্যাল ফি ৯ টাকা থেকে বেড়ে ১০০০ টাকা হয়েছে, আইআইএসইআর-এ পাঁচ বছরে ফি বেড়েছে ২৭৬ শতাংশ, অথচ ফেলোশিপ বেড়েছে মাত্র ২৪ শতাংশ। কবে থেকে শিক্ষাকে অধিকারের বদলে ক্রয়ক্ষমতার নিরিখে দেখা এত স্বাভাবিক হয়ে গেল?

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও গজিয়ে উঠছে— বাহারি নাম, চকচকে ভবন, ভিতরে প্রায়শই মানহীন শিক্ষা। গত দশকে ৬৪২ থেকে ৯৯৩ বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেছে ভারত, যার মধ্যে ১৯৯টি বেসরকারি। কেউ জানে না এদের মান কেমন। শিক্ষা এখানে পণ্যে পরিণত— ছাত্ররা ক্রেতা, শিক্ষক বিক্রেতা। আর গবেষণাক্ষেত্রে মহামারির চেহারা নিয়েছে যে ভাবে হোক কিছু একটা ‘ছাপিয়ে ফেলা’র প্রবণতা। অনুঘটকের ভূমিকায় অবশ্যই এনআইআরএফ, তথাকথিত স্ট্যানফোর্ড লিস্ট বা সমধর্মী র‌্যাঙ্কিং-এর সার্কাস। সম্প্রতি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সততা নিয়ে গভীর সন্দেহের অবকাশ থাকছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাই নিম্নমানের বা সন্দেহজনক সাময়িকীতে গবেষণা-নিবন্ধ ছাপাতে বাধ্য হচ্ছেন, ফলে ‘রিট্র্যাকশন’ বা গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের হার দ্রুত বাড়ছে। ‘ইন্টিগ্রিটি ইনডেক্স’-এর নিরিখে এ সব প্রতিষ্ঠানের অনেক ক’টিই লাল সঙ্কেতে চিহ্নিত, যা এক নৈতিক অবক্ষয়ের ইঙ্গিত। গভীর অন্তর্দৃষ্টি-ঋদ্ধ জ্ঞানের বদলে এখন তৈরি হচ্ছে ইন্টারনেট-মন্থন করা বা চ্যাটজিপিটি দিয়ে বানিয়ে নেওয়া তথ্যের ভিড়। কিন্তু ভিতটা ক্রমেই ফাঁপা হচ্ছে।

অন্য দিকে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রক্তশূন্য। প্রায় ১৮,০০০ শিক্ষকপদ খালি, হাজার হাজার শিক্ষক ‘অ্যাড-হক’ হিসেবে কর্মরত, চাকরি চার মাস অন্তর নবীকরণের ভয়ে ঝুলে থাকে। যে শিক্ষক নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত, তিনি শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্থিতির বীজ কী ভাবে বুনবেন? এই অবস্থায় ‘হায়ার এডুকেশন ফাইনান্সিং এজেন্সি’ (সংক্ষেপে ‘হেফা’) নামের নতুন তহবিল প্রকল্প এনেছে নতুন মোড়। একে কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মনে করেন। তাঁদের যুক্তি, ‘হেফা’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বাস্তব প্রয়োজন— যেমন হস্টেল, গবেষণাগার, স্মার্ট ক্লাসরুম বা ভবন নির্মাণ— চিহ্নিত করে সেই অনুযায়ী তহবিল অনুমোদন করে, ফলে অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা বাড়ে। শুধু সরকারের তহবিলের উপর নির্ভর করলে তা অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করত, হেফা সেই চাপ কিছুটা লাঘব করতে পারে। পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মতো কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিজেদের আয় তৈরির সুযোগও এই ব্যবস্থায় রয়েছে।

হেফা-র নীতিতে গভীর উদ্বেগেরও কারণ আছে। সমালোচকদের মতে, উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন বলা হচ্ছে: যদি কিছু গড়তে চাও, ঋণ নাও। এই ঋণশোধের বোঝা কি শেষে এসে পড়বে শিক্ষার্থীদের কাঁধে? কারণ প্রতিষ্ঠানগুলি খরচ মেটাতে ফি বাড়াতে বাধ্য হবে। ভারতের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থীই সংরক্ষিত বা অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল শ্রেণি থেকে আসে, রয়েছে বিপুল সংখ্যক নারী শিক্ষার্থীও। ফি মাত্রাতিরিক্ত বাড়লে এরা সবার আগে হয়ে পড়বে প্রান্তিক। ফলে হেফা সরকারকে কিছুটা আর্থিক স্বস্তি দিতে পারে বটে, কিন্তু পরোক্ষ প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থীদের উপর, বিশেষত যারা আর্থিক ভাবে টলমল। উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ঋণগ্রস্ত হতে হবে, ঋণশোধের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আরও বেশি টাকা নেওয়া হবে বা ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অংশ ধীরে ধীরে চলে যাবে বেসরকারি সংস্থার হাতে— এমন এক চক্রের মধ্যে আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কি অমূলক? যে প্রতিষ্ঠান জাতির মেরুদণ্ড গড়ে তোলে, তাকে এখন বাজারের নিয়মে পরিচালিত হতে বলা হচ্ছে, এ কি বড় নীতিগত বিপর্যয় নয়?

আজ জ্ঞানের মুক্ত হাওয়া ভারতে ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। গবেষণার অর্থায়ন কেন্দ্রীভূত, ‘জাতীয় স্বার্থ’ নামের অস্পষ্ট ছাতার নীচে গবেষণার স্বাধীনতা সঙ্কুচিত। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অভাব আরও স্পষ্ট সাম্প্রতিক বাজেটে। গবেষণা ও বৃত্তিতে বড় কাটছাঁট হয়েছে। আর এরই মধ্যে স্থাপিত হয়েছে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’, যেখানে সিদ্ধান্ত নেবেন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। প্রশ্ন উঠছে, গবেষণার অগ্রাধিকার কি বিজ্ঞানী ও গবেষকের হাতে থাকবে, না কি আমলাতন্ত্রের হাতে? এই সঙ্কট শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও নৈতিকও। বিশ্ববিদ্যালয় একদা ছিল প্রশ্ন, বিতর্ক, নতুন চিন্তার পীঠস্থান। এখন ছাত্র আন্দোলন মানেই ‘অশান্তি’, তাৎক্ষণিক ফলপ্রসূ নয় এমন গবেষণা-বিষয় মানেই ‘জাতীয় স্বার্থের বাইরে’। উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকদের মতপ্রকাশের জায়গাটুকু পর্যন্ত টিকিয়ে রাখার লড়াই চলছে।

তবু আলো আছে। দেশের প্রান্তিক অঞ্চল থেকে আসা, প্রথম প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীরা এখনও লাইব্রেরিতে আলো নিবে যাওয়া পর্যন্ত পড়ে, ফেলোশিপ বন্ধ থাকলেও হাতখরচের ভরসায় গবেষণা করে। তারা জানে, সৎ ভাবে লেখা প্রতিটি গবেষণাপত্র এই অন্ধকারে মশালের মতো। তবে এই সংগ্রাম যথেষ্ট নয়। উচ্চশিক্ষার দায় নাগরিক সমাজেরও। বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচানো মানে গণতন্ত্র বাঁচানো। উচ্চশিক্ষা যুক্তিবাদ, মানবিকতা ও সামাজিক ন্যায়েরও ভিত্তি, তা এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পর্যাপ্ত অভিভাবকত্ব দাবি করে। আজ অনেক জরুরি বিদ্যমান প্রতিষ্ঠান ও কমিশনগুলিকে পুনর্গঠিত ও শক্তিশালী করা— বাজেট সঙ্কোচন, অনিয়মিত বৃত্তি এবং মান নিয়ন্ত্রণের অভাবে যারা ক্ষতিগ্রস্ত। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে গবেষণার ভিত্তি মজবুত করতে হবে, সে জন্য দরকার স্বাধীন, স্বশাসিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে গবেষণা ও উদ্ভাবন রাজনৈতিক তথা আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের বাইরে থাকবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

IIT ISI ISRO higher studies Research Work

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy