আজ অবধি পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে কোনও আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে নিমন্ত্রণ করেননি— যদি না সেই সেনানায়ক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট-এর পদটিও দখল করেন। যেমন আয়ুব খান বা পারভেজ় মুশারফ। জেনারেল আসিম মুনিরকে সম্প্রতি হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ পাঠিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই ধারা ভাঙলেন। জেনারেল আয়ুব খানের পর মুনির পাকিস্তানের দ্বিতীয় জেনারেল, যিনি ফিল্ড মার্শাল পদ পেয়েছেন। মুনিরই পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ, মনে করেন অনেকে। কিন্তু সে দেশে এক জন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী রয়েছেন, পার্লামেন্টও রয়েছে, মুনির এখনও অবধি কেবল সেনাপ্রধান। আমেরিকা অবশ্য প্রায়ই পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারের চেয়ে সামরিক বাহিনীর প্রধানকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কিন্তু ট্রাম্প আমন্ত্রণ পাঠালেন এমন সময়ে, যখন ভারত দাবি করছে যে পহেলগামের সন্ত্রাসী হানার পিছনে প্রধান পরিকল্পনা যাঁর, তিনি আসিম মুনির। মুনির এবং পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোণঠাসা করতে কূটনৈতিক চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। এ বিষয়ে ভারতীয় প্রচারের উল্টো দিকে অবস্থান নিল আমেরিকা। সম্প্রতি আমেরিকার এক শীর্ষস্থানীয় জেনারেল দাবি করেছেন যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সমবেত প্রচেষ্টার এক ‘অভূতপূর্ব অংশীদার’ পাকিস্তান। এর কিছু দিন পরেই ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে মধ্যাহ্নভোজে নিয়ন্ত্রণ করেন মুনিরকে।
মুনিরের এই আমন্ত্রণকে ভারতের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অসম্মান বলেই মনে করছে নয়া দিল্লি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচকরা তড়িঘড়ি দাবি করতে শুরু করেছেন যে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য যে অতি-উৎসাহী চেষ্টা চালাচ্ছিলেন মোদী, তা ব্যর্থ হয়েছে। সেটা হয়তো একটু বাড়াবাড়ি। মুনিরের আমন্ত্রণ ভারতকে নিঃসন্দেহে বিব্রত করেছে, কিন্তু তাই বলে ভারত-আমেরিকা সম্পর্কের স্মরণসভা বসানোর সময় এখনও আসেনি। আসলে, পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার এই মনোভাব অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। স্বাধীনতার পরপরই ভারত আর পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের ধাঁচটা স্থির হয়ে গিয়েছিল।
জওহরলাল নেহরু যখন ১৯৪৯-এর অক্টোবরে আমেরিকা সফরে যান, তাঁকে বেশ উষ্ণ, বন্ধুত্বপূর্ণ অভ্যর্থনাই দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান কিছুতেই নেহরুকে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে, শীতল যুদ্ধে আমেরিকার দিকে টেনে আনতে পারেননি। নেহরু স্পষ্ট করে দেন যে, ভারত নিষ্পক্ষ দেশগুলির সঙ্গে থাকবে, এবং বিশ্বশান্তির প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে। তার কয়েক মাস পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটল একেবারে অন্য রকম। ট্রুম্যান নিজের ব্যক্তিগত জেট প্লেন পাঠালেন লিয়াকতকে লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন নিয়ে আসার জন্য। মস্কোর আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে লিয়াকত আমেরিকা সফর করলেন, এবং সোভিয়েটের বিরুদ্ধে আমেরিকার পক্ষ নিতে রাজি হলেন। সেই সফরে যে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল, তা-ই নির্ধারিত করল আমেরিকা-পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্ককে। নানা আন্তর্জাতিক চুক্তিতে পাকিস্তান আমেরিকার ‘সহযোগী’ (ট্রিটি অ্যালাই) হল। যেমন, সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন, বা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন। এর ফলে পাকিস্তানের কাছে আমেরিকা দায়বদ্ধ রইল। পাকিস্তান কখনও আক্রান্ত হলে তার উদ্ধারে নামতে হবে আমেরিকাকে।
ভারত শীতল যুদ্ধের কোনও পক্ষই নেয়নি। সোভিয়েটের সঙ্গেও কোনও চুক্তি করেনি ১৯৭১ অবধি। তার পর ‘ভারত-সোভিয়েট শান্তি, মিত্রতা ও সহযোগিতা’ চুক্তিতে সই করে, কারণ আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেবে, এমন ভয় দেখা গিয়েছিল। সেই যুদ্ধ, যার শেষ হয় পাকিস্তানের বিভাজনে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায়। সে সময়ে আন্তর্জাতিক মহলে একটা প্রচ্ছন্ন বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল যে, ভারত-পাক সংঘাতে আমেরিকা যদি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়ায়, তা হলে শীতল যুদ্ধে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া এসে দাঁড়াবে ভারতের সমর্থনে। ইতিমধ্যে ভারত মস্কোর সহায়তা পেল ইস্পাত কারখানা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে, ভারতের নিজস্ব অস্ত্রশস্ত্রের ভান্ডার প্রসারিত করতে।
কিন্তু কূটনীতি চলে তার নিজস্ব গতিতে। সোভিয়েট ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার পাশাপাশি, পাকিস্তানের সঙ্গেও ভাল সম্পর্ক রেখে চলেছে। তাদের পরিকাঠামো নির্মাণে কিছু সহায়তা করেছে। সে রকম, আমেরিকাও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেনি। কৃষি, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, সংস্কৃতি-সহ নানা বিষয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে দু’পক্ষই সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় রাজি হয়েছিল, তাসখন্দ চুক্তি সই হয়েছিল। শীতল যুদ্ধে আগাগোড়াই দু’টি বৃহৎ ক্ষমতাশালী দেশ, আমেরিকা ও সোভিয়েট ইউনিয়ন, নিয়মিত সম্পর্ক রেখে গিয়েছে ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে।
শীতল যুদ্ধের সমাপ্তির পরে অবশ্য সেই সম্পর্কে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে। পাকিস্তান বিভিন্ন চুক্তিতে আমেরিকার সহযোগী থাকলেও, দু’দেশের সম্পর্ক বেশ কিছু ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। সম্পর্ক অবশ্য কখনওই ছিন্ন হয়নি। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ রাহুল বেদির মতে, মুনিরের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ ‘পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি, নমনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক’-কেই ফের সামনে আনছে। চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের কূটনৈতিক ও সামরিক ঘনিষ্ঠতার জন্য অস্বস্তিতে আমেরিকা। তা সত্ত্বেও দু’দেশের সম্পর্ক যে যথেষ্ট জোরালো, এ হল তার ইঙ্গিত।
অন্য দিকে, ২০০০ সালের পর থেকে ভারত এবং আমেরিকার সম্পর্কে দ্রুত উন্নতি হয়েছে। ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান, দু’পক্ষই সহমত হয়েছে যে, ভারতের সঙ্গে আরও নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করতে হবে আমেরিকাকে। চিনের উত্থান দু’দেশের কাছেই বিপদসঙ্কেত, কিন্তু সেটাই ঘনিষ্ঠতার একমাত্র কারণ নয়। বিজ্ঞান, মহাকাশ, উচ্চপ্রযুক্তি, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যৌথ উদ্যোগের মতো নানা বিষয়ে দু’টি দেশ পরস্পর সহযোগিতা করছে। রয়েছে প্রতিরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো বিষয়ও। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কই এখন ভারতের কাছে অপরাপর সম্পর্কের তুলনায় বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
তুলনায় পাকিস্তানে আমেরিকার বিনিয়োগ আগের চেয়ে কমেছে। তবে পেন্টাগন এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠতা দেখায় যে, দু’দেশের সম্পর্ক এখনও শক্তিশালী, সক্রিয়। ইরানের সঙ্গে সংঘাতের সময়ে আমেরিকা যে মুনিরকে আমন্ত্রণ পাঠাল, তাতেই আন্দাজ পাওয়া যায় যে, সঙ্কটের সময়ে পাকিস্তানকে নির্ভরযোগ্য মনে করে আমেরিকা। আফগানিস্তানে ইসলামিক স্টেট (কে)-এর সক্রিয়তা সামলানোর কাজে তার পাকিস্তানকে চাই। চিনের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের একটি বাড়তি খাত পাকিস্তান।
কিন্তু আর কিছু দিন পরেই নিরাপত্তা বিষয়ে চারটি দেশের (ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, আমেরিকার) ‘কোয়াড’ বৈঠকে শীর্ষ নেতাদের মধ্যে ট্রাম্পেরও আসার কথা। হোয়াইট হাউসে মুনিরের মধ্যাহ্নভোজ তখন আর কে মনে রাখবে? ট্রাম্পের সফরের কয়েক মাস পরে দিল্লিতে মোদীর অতিথি হবেন ভ্লাদিমির পুতিন। পাশাপাশি, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও চিনের সঙ্গেও ভারত সম্পর্ক ভাল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ সম্প্রতি শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন-এ অংশগ্রহণের সুযোগ নিয়ে চিনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর সঙ্গে মোদীর বৈঠকের পরিকল্পনাও চলছে।
নেহরু-প্রদর্শিত নিষ্পক্ষতা আজও ভারতের বিদেশনীতির ভিত্তিপ্রস্তর। গত সাত দশকে নানা দলের সরকারের শাসনকালে এই কৌশলগত স্বাতন্ত্র্য ভারতের কাজে এসেছে। ট্রাম্পের শাসনকালে ভারত-আমেরিকার সম্পর্ক আরও অনিশ্চিত, অস্থির হতে পারে। তাই অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কে উন্নতি করা দরকার ভারতের। কারও উপর অতিরিক্ত নির্ভরতার সময় এটা নয়। বিদেশ নীতিতে কোনও চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, রয়েছে কেবল কিছু চিরকালীন স্বার্থ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)