আষাঢ়ের প্রথম দিন। শুনলেই সে কোন যুগের এক নির্বাসিতের বেদনা মনে ভেসে ওঠে। কালিদাসের যক্ষ মেঘ পাঠিয়ে বার্তা দিয়েছিল প্রিয়াকে— তোমাকে ভুলিনি। আর এ বছর আষাঢ়ের প্রথম দিনটা ছিল এ রাজ্যের সমাজ-নির্বাসিত মানুষদের। সেই সব নারী-পুরুষ, যাঁরা আমাদের দুয়ার থেকে জঞ্জাল নিয়ে যান রোজ, তাঁদেরও প্রায় জঞ্জালের মতোই দেখে গৃহস্থ। যাঁরা ধাপার জঞ্জাল-পাহাড় থেকে কুড়িয়ে আনেন বোতল, চটি, কাপড়, টায়ার, ভাঙা বাসন। ফেলে দেওয়া খাবারও কুড়িয়ে নিয়ে যায় মেয়েরা, মাছ বা শুয়োরকে খাওয়াবে বলে। ১৬ জুন থেকে শুরু হল এই কর্মীদের নথিভুক্তি। এনজিও কর্মীরা তাঁদের আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের তথ্য ভরল স্মার্ট ফোনের মাধ্যমে। খুলল কেন্দ্রের পোর্টালের দরজা— উষা মণ্ডল, চম্পা পরামানিক, রশিদা খাতুনরা প্রবেশ করলেন সরকারের নথিতে। ময়লা-কুড়ানি থেকে স্বচ্ছতা কর্মী।
প্রকল্পের নাম ‘নমস্তে’। ‘ন্যাশনাল অ্যাকশন ফর মেকানাইজ়ড স্যানিটেশন ইকোসিস্টেম’-এর আদ্যাক্ষর যোগ করে এই সৌজন্যপূর্ণ নাম। সামাজিক ন্যায় ও সক্ষমতা মন্ত্রকের এই প্রকল্প জঞ্জাল-কর্মীদের সংগঠিত, নিয়মবদ্ধ কর্মিবাহিনীতে পরিণত করতে চায়। দেওয়া হবে পরিচয়পত্র, সুরক্ষা-পোশাক, শেখানো হবে নালা, সেপটিক ট্যাঙ্ক সাফ করার যন্ত্রের ব্যবহার। জঞ্জাল-কুড়ানো কর্মী থেকে বর্জ্যের ‘অন্ত্রপ্রনর’ করে তোলা হবে।
সত্যি হবে কি? ধাপার জঞ্জাল-স্তূপে দাঁড়ালে মনে হয়, এ জায়গা সব নিয়ম-নির্দেশের বাইরে। এই যে হাসপাতাল, ক্লিনিকে এত রঙের সঙ্কেত দিয়ে বিপজ্জনক বর্জ্য আলাদা করা হয়, ধাপায় সব মিলেমিশে একাকার। ধাপা-দুর্গাপুরের মেয়েরা বলছিলেন, জঞ্জাল বাছতে গিয়ে প্রায়ই হাতে ফুটে যায় ছুঁচ। সংক্রমণের ঠেলায় দু’দশ দিন কাজ বন্ধ। ধাপার ওই ষাট একর জমি এক নির্বাসন-ভূমি। এখানে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা যেন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সভ্য সমাজের কেউ নন। প্রতিটি কর্মীর রয়েছে কোনও মতে বেঁচে যাওয়ার গল্প— ময়লায় তলিয়ে যাওয়া থেকে, ডাম্পারে পিষে যাওয়া থেকে, পুলিশ, মস্তান, কুকুরের আক্রমণ থেকে। আগুন, ধোঁয়া, দুর্গন্ধ, দূষিত পদার্থে ভরা এই জঞ্জালভূমির মতো বিপজ্জনক, অস্বাস্থ্যকর জায়গা আর কোথায়?
এখানেই বড় হয় অনেক শিশু। ধাপা-সংলগ্ন একটি সরকারি প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বললেন, অনেক মা সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছেন কাজে। বুঝিয়ে স্কুলে পাঠানো কঠিন কাজ। তাঁর স্কুলের পড়ুয়া দুই ভাইবোনকে দেখা গেল, কাঁধে ঝোলা, হাতে শিক নিয়ে ধাপা-পাহাড়ে উঠছে। এক জন ক্লাস ফোর, অন্য জন ফাইভ। এক গাল হেসে বলল, “আজ ইস্কুল ছুটি।” স্কুল থেকে অল্প দূরে এক অসরকারি সংস্থার ক্রেশে থাকে জনা-চল্লিশেক শিশু। মায়েরা জানালেন, ছ’মাসের সন্তানকে নিয়েও কাজ করেন মেয়েরা। কুড়িয়ে-পাওয়া তোশকের চার দিকে গাছের ডাল পুঁতে, উপরে প্লাস্টিকের চাদর টাঙিয়ে ছোট ছোট জিরানোর জায়গা বানানো রয়েছে। শিশুরাও থাকে সেখানে। অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পের বার্ষিক সমীক্ষা অনুসারে, ৫৮ নম্বর ওয়র্ডে ছ’বছরের কম শিশুর সংখ্যা আট হাজারের বেশি। কেন্দ্র চলে সাকুল্যে দু’টি, নাম লেখানো শ’দুয়েক শিশুর। একটি অসরকারি সমীক্ষা (২০১৭) দেখিয়েছে, জঞ্জাল কুড়োনোর কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের অর্ধেকেরও বেশি শুরু করেছিলেন শৈশবে।
এই কর্মীরা আছেন, আবার নেইও। হতে পারে প্রতি দিন অন্তত হাজার দু’তিন মানুষ ধাপায় কাজ করেন। কিন্তু খাতা-কলমে ধাপা কেবল ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’— জঞ্জাল ফেলার জায়গা। এখানে প্রবেশ মানেই অবৈধ অনুপ্রবেশ। অতএব কয়েক প্রজন্ম মানুষের কাজের জায়গা হয়েও কারও ‘কর্মস্থল’ নয় ধাপা। মাথার উপর বৈশাখ-চৈত্রের রোদ, তার উপর জঞ্জালের স্তূপে লেগে থাকা আগুনের তাত, তবু জলের ব্যবস্থা নেই। বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া বোতল, আর বাবুদের ফেলা মিনারাল ওয়াটার বোতলের তলানি জল— তা থেকেই হাত ধুয়ে নিজে খাওয়া, শিশুকে খাওয়ানো।
ধাপার আশেপাশের ওয়র্ড বা গ্রামের (খানাবেড়িয়া, মাঠপুকুর, দুর্গাপুর, বানতলা, অনন্তবাদাল) অধিকাংশ বাসিন্দা আসেন জঞ্জাল কুড়োতে। আবার ঘটকপুকুর, মালঞ্চ, ক্যানিং, ডায়মন্ড হারবার, সোনাখালি, লক্ষ্মীকান্তপুর, মিনাখাঁ থেকে ট্রেনেও আসেন অনেকে। সমীক্ষা বলছে, ৫৬ শতাংশ কাজ করেন আট ঘণ্টা থেকে চোদ্দো ঘণ্টা। দশ জনে ছ’জন মেয়ে। তাঁরা এই বিপজ্জনক, সম্মানহীন কাজকে বাবু-বাড়ি কাজের চাইতে পছন্দ করেন, কারণ কাজের সময় থাকে নিজের হাতে। রোজগারও বেশি— দিনে দু’শো-তিনশো থেকে শুরু, হাজার-বারোশো টাকাও জুটে যেতে পারে। তাই মাসে ন’হাজার টাকায় পুরসভার মজদুরি, বা সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় একশো দিনের কাজের কর্মী হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন এই শ্রমিকেরা, আক্ষেপ করলেন কঠিন বর্জ্য বিভাগের মেয়র-ইন-কাউন্সিল দেবব্রত মজুমদার।
পুরকর্তারা চান, অন্য কাজে প্রশিক্ষণ দিয়ে জঞ্জাল-কর্মীদের ‘পুনর্বাসন’ করতে। তার সম্ভাবনা কতটুকু, সেটা একটা প্রশ্ন। আরও বড় প্রশ্ন, এ কাজের প্রয়োজন কি নেই? উৎসেই জঞ্জাল আলাদা করার লক্ষ্য সফল হয়েছে কতটুকু? বাড়ি বাড়ি নীল আর সবুজ বালতি পাঠানো হলেও, কাডবোর্ডের বাক্স আর এঁটোকাটা এখনও একই প্লাস্টিক ব্যাগে পোরে অভিজাত আবাসনও। এক দিকে ধাপা বর্জ্য সংশোধন এলাকায় নতুন নতুন কারখানা হচ্ছে— ফেলা খাবার থেকে বায়োগ্যাস তৈরির, প্লাস্টিক, থার্মোকল রিসাইক্লিং, জৈব বর্জ্য থেকে সার বানানোর। অন্য দিকে গরু-ছাগলের পচা দেহ থেকে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, ক্যাথিটার, সবই এসে পড়ছে ধাপায়। জৈবপ্রযুক্তি দিয়ে পুরনো জঞ্জাল স্তূপকে সবুজ-আচ্ছাদিত জমি করা হচ্ছে, কিন্তু টাটকা জঞ্জালের আমদানি বাড়ছে। হাওড়া, পানিহাটি, বিধাননগরের বর্জ্য এখন আসছে ধাপায়। দৈনিক বর্জ্যের পরিমাণ সাড়ে চার হাজার টন থেকে বেড়ে হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার টন।
জঞ্জালের বাড়তি জোগান আরও কর্মী টেনে আনছে। কলকাতার জঞ্জালের অন্তত ২০ শতাংশ যে পুনর্ব্যবহার হচ্ছে, তার কারণ, কলকাতার হাজার পনেরো-কুড়ি স্বনিযুক্ত কর্মী ধাপার জঞ্জালভূমি থেকে, উন্মুক্ত ভ্যাট থেকে, বাড়ি থেকে জঞ্জাল সংগ্রহ করেন। উদ্ধৃত সামগ্রীর কেনা-বেচা হয় দৈনিক অন্তত ষাট লক্ষ টাকার। জঞ্জাল-কুড়ানি থেকে বৃহৎ ব্যবসায়ী পর্যন্ত একটা শৃঙ্খল কাজ করে। কত মানুষ এর সঙ্গে জড়িত, কী তাঁদের পরিস্থিতি, তার তথ্য নেই। পুরসভা কখনও সমীক্ষা করেনি।
করার দায় কিন্তু ছিল। ২০১৪ সালে সুরাতে প্লেগ ছড়ানোর পর জঞ্জাল-ব্যবস্থা নিয়ে নড়ে বসে দেশ। তৈরি হয় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধি, ২০১৬। সেখানে জঞ্জাল অপসারণ এবং পরিবেশ সুরক্ষায় জঞ্জাল-কর্মীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে, তাঁদের আইনি বৈধতা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। যাতে ‘চোর,’ ‘ছেলেধরা’ বলে এঁদের হয়রান না করা হয়, দূর দূর করে তাড়ানো না হয়। পুণে, হায়দরাবাদ, ইন্দোর-সহ নানা শহর স্বনিযুক্ত জঞ্জাল-সংগ্রহ কর্মীদের পরিচয়পত্র দিয়েছে, তাদের সংগঠনের সঙ্গে কাজ করছে পুরসভা। পিছিয়ে বাংলা।
অবশ্য ভারত নামের দেশটিতে কোনও কিছুই এমনি-এমনি হয় না। জঞ্জাল-কর্মীদের অন্তর্ভুক্তির প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছিল লড়াই, কখনও নিজেদের শক্তিতে, কখনও ট্রেড ইউনিয়নের সমর্থনে। ইতিহাস বলে, শ্রমিক নেত্রী প্রভাবতী দাশগুপ্তের নেতৃত্বে ১৯২৭ সালে ধাঙড়-মেথরদের প্রথম ইউনিয়ন হয় কলকাতায়, ১৯২৮-এ হয় ঐতিহাসিক ধাঙড় ধর্মঘট। আর আজ? “আপনাদের দাবি কী?” বলতে মাঠপুকুরের সীতা বাগদি, পুতুল বাউরিরা হেসেই বাঁচেন না। “আমাদের দাবি কে শুনবে?” কেন, আপনাদের সংগঠন নেই? পার্টি করেন না? “আমাদের কোনও দল-টল নেই। আমাদের কেউ নেই গো। আমরা ধাপা পার্টি।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)