Advertisement
E-Paper

তবু এখনও বই-মায়া

শীত শেষ, বসন্তের সমাগমে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা উনিশ-বিশ অমলিন, নিজের আদি আত্মাকে ধরে রেখেছে। হয়তো বইমেলায় সেই পার্ক স্ট্রিট নেই, কিন্তু সল্ট লেক রয়েছে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৫:১৪
Share
Save

সে  ছিল এক মেলা ‘আমাদের যৌবনে কলকাতা’! সেই কলকাতা, যার নাকি বয়স হয়ে গেল নয়-নয় করে আটচল্লিশ। তবু এখনও সেই মেলায় মাঘ শেষের মায়াকুচি হাওয়া। ডিজিটাল প্রযুক্তির রমরমা আর কৃত্রিম মেধার বিস্ফোরণ সম্ভাবনার মধ্যেও রয়ে যায় অলৌকিক পার্চমেন্ট-এর সেই গন্ধ। যে গন্ধের খোঁজে আমরা অমল ধবল শৈশব থেকে নুন কাঁচা মরিচে পৌঁছে গেলাম।

শীত শেষ, বসন্তের সমাগমে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা উনিশ-বিশ অমলিন, নিজের আদি আত্মাকে ধরে রেখেছে। হয়তো বইমেলায় সেই পার্ক স্ট্রিট নেই, কিন্তু সল্ট লেক রয়েছে। অদূরে চলমান ধুলোপথযান নেই, মেট্রো রেলের প্রকাণ্ড স্টেশনের পাহারা রয়েছে। টিকিট কাটার জন্য ময়দান বাহিত বিরাট লাইন নেই, বিরাট তোরণ দিয়ে অনর্গল প্রবেশ আছে। সই সংগ্রহের ব্যগ্রতা কম, সেল্ফি তোলার ক্ষিপ্রতা বেশি। এ সেই মেলা যাকে এ বারের থিম রাষ্ট্র জার্মানির রাষ্ট্রদূত ফিলিপ আকারমান আখ্যা দিয়েছেন মহাকুম্ভ বলে (আর ফ্রাঙ্কফুর্টকে বলেছেন মক্কা)।

এ-হেন বইকুম্ভে কয়েকশো বছরের মনীষার আলো-অন্ধকার টানেল পার হয়ে অন্ধের মতো একই ভাবে হাতড়ে চলেছেন ওই তো লেখক মহাশয়। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে! এই বদলে যাওয়া সময় মাপতে মাপতে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাচ্ছে তাঁর। একটি অক্ষর থেকে অন্য অক্ষরের মধ্যে যানজট, ভালবাসা, উষ্ণতা এসে পথরোধ করছে। চোখে স্মৃতির ধুলো পড়ছে। ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনার মধ্যেই মিশে থাকছে অচেনা হাতের বরাভয়।উতরোল এই ধুলোওড়ানো উৎসবের মধ্যে, কান পাততে না পারা ক্যাকোফোনির মধ্যে, বিকেল আসছে নতুন পাঠকের মতো অনিবার্যতায়। থিম সঙ্গীতের ফাঁকে ফাঁকে ঘোষকের কণ্ঠ থেকে উড়ে আসছে সুসংবাদ। জানানো হচ্ছে, ‘সুরঞ্জনা আপনি কি আজও বইমেলায় রয়ে গিয়েছেন? যদি থাকেন, গিল্ড অফিসের সামনে চলে আসুন। আপনার জন্য ভিড়-নির্জনে অপেক্ষা করছেন শ্রীজীবনানন্দ!’ যত ভিড় ততই নাছোড় হয়ে চেপে বসছে, কারও কারও, নিজের মুদ্রাদোষে একলা হয়ে থাকার ভার। কেউ ভাবছেন, তিন নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে সোজা এসে একশো বিয়াল্লিশ নম্বর স্টল পার হলেই হয়তো দেখা যাবে, সে বাইরে বসে আছে যাঁকে পঁচিশ বছর আগের এক বইমেলায় দেখেছিলাম। সেল্ফি-প্রাণ মানুষরা তাঁকে আজ ঘিরে রেখেছে, আর তিনি আভাতি বেলা লবণাম্বুরাশে! লাতিন আমেরিকার স্টলে কলঙ্করেখার মতো জেগে উঠছে জাদুবাস্তবতার রাত। রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে অ্যাপ বিক্রি করছেন ডেনিম যুবতী।

‘আমরা জানি মেলা মানেই ধুলো/ স্মৃতির ধুলো বড়ই মারাত্মক/ আমরা জানি বিরহে বিপ্লবে,/ ঘোষক জানে অপেক্ষার হাত।’ বই-শিকারিদের সঙ্গে স্টলের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া প্রৌঢ় মন জানে, এখানেই তাঁর বাবার হাত ফিরে আসবে কখনও। অন্তত এক বার। ইতস্তত আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবে মলাট। নাগরদোলার মতো সময়ের এ এক বৃত্তপাক খেলা যেন। মেলা তো কখনও একা আসে না। আনে অসুখ আর ক্লান্তি, বিপণন, মশকরা, বিরহ-বিপ্লব, কফি সভ্যতা, পায়ের ব্যথা আর মনস্তাপ। আনে পুরনো বইকে নতুন মলাটে। যেখানে পাণ্ডুলিপির ধার ঘেঁষে আমাকে পাহারায় দাঁড় করিয়ে চলে গিয়েছে সমস্ত কবিতা-উৎসবের স্মৃতি, রচনাকৌশল, গিটারের নীল রিড। আমি হাতে মোবাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। কোথাও পৌঁছতে পারছি না।

কোথাও কি পৌঁছনোর ছিল? এই মেলা পুরোপুরি সেই স্থবিরতাকে গিলে ফেলার আগেই তাকে বোতলের লিমকায় মিশিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠতে থাকেন কেউ কেউ।

মধ্যবয়সে পৌঁছনো কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্রবল ভিড়ের মধ্যে মিহি জোছনা হয়ে ছড়িয়ে থাকে ডেড পোয়েটস সোসাইটির মতো এক সঙ্ঘ। গানের সুরের মতো বিকেলের দিকের বাতাসে সেই সব কবিদের দেখা যায়, ‘সে-সব কবি ক্ষুধা আগুনের প্রেম সেঁক/ চেয়েছিল— হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি।’ বহু অনুপস্থিত লেখকের নিঃশ্বাস ভেসে বেড়ায় এই ক’টা দিনের মাঠের এই সম্ভ্রান্ত পরিসরে।

এই তো নন্দিনী আর শুভঙ্করের গেরিলা যুদ্ধের মতো গোপন ভালবাসাবাসি টুকে রাখা যে কবি মানুষটা, আকাশের মতো চুল আর জোয়ার শেষ হওয়া সাগরের নির্লিপ্তি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, হাত বাড়ালেই তাঁর সই মিলবে। মেজাজ সুপ্রসন্ন থাকলে সইয়ের সঙ্গে দুটো রেখাও এঁকে দেবেন তিনি, পূর্ণেন্দু পত্রী যাঁরা নাম। দেখছি বুদ্ধদেব গুহকে। টকটকে রং আরও রাঙা ভিড়ের চাপে। বলা ভাল, নানা বয়সি বামাচাপে! উনি হেঁটে গেলে পাঠিকাদের তরঙ্গ বয়ে যেত, এই তো যেন কিছু দিন আগেই এই বইমেলাতে। সাদা ঝুলপি কালো চুল এবং সমুদ্রতীরের জামা (তখন এই প্রিন্ট আজকের মতো ফ্যাশনে আসেনি) পরা নীললোহিত সিগারটে উদাস টান মারছেন আর পাঠকরা লাইন দিয়েছেন তাঁর সইয়ের জন্য। ওই তো নিজস্ব মুদ্রার মতো মুচকি হাসিতে অডিটোরিয়ামে গল্পে মগ্ন হয়েছেন শঙ্খ ঘোষ আর অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, কবিতাপাগল মফস্‌সল থেকে আসা যুবক-যুবতী দূর থেকে মুগ্ধ চোখে দেখেই যাচ্ছে তাঁদের, আর ফেরার লোকাল ধরতে ক্রমশ দেরি হয়ে যাচ্ছে। হাতের বই হাতেই থেকে যাচ্ছে, সই করানোও হয়ে উঠছে না সম্ভ্রমে।

সময় তো বদলাবেই। তবু আজও মেলার মাটি ফুঁড়ে ওঠে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুমুখ। কোথাও নতুন টেরাকোটা কানের দুল অথবা কাঁধে বিড়ম্বিত ট্যাটু-র উৎকণ্ঠা জমে। কোথাও কেউ মেরুন বাইলুম হয়ে আকাশে বইয়ে দেয় আঁচল। আজও দু’দশকেরও বেশি প্রবাসী মনেও, বইমেলার ধুলো অপরিচিত লাগে না। বইমেলাকে ঘিরে গান, আড্ডা, দেখা হওয়া-না হওয়া, চকিত প্রেম-বিরহ, জ্ঞানান্বেষণ, ছাত্রসুলভ আগ্রহ, প্রার্থিত বইটি খুঁজে পাওয়ার আনন্দ, কোনও স্টলেই না ঢুকে স্রেফ ফিশফ্রাই খেয়ে ফিরে যাওয়া আমোদগেঁড়ের ঢল— সবই তো উনিশ-বিশ একই আছে।

পরিচিতের মুখ কমেছে, কিন্তু বেড়েছে নতুন পরিচিতের ভিড়। প্রবীণ লেখকেরা স্টলে স্টলে ছবি হয়ে রয়েছেন, তাঁদের ছেড়ে যাওয়া এখনও গরম আসনে সাবলীল জায়গা করছেন আজকের সময়ের কথা বলা কবি বাউল দার্শনিক প্রাবন্ধিক অনুবাদকরা।

এখনও এই মেলার কত স্টলে নেমে আসে যে কত আলো। গেটের সামনে অপেক্ষারও শেষ নেই যেন। প্রবল ভিড়ের মধ্যে একটি কফির কাপ চুপ করে থাকে অন্য কাপটির সামনে। প্রথমেই যা বলেছি। ডিজিটাল-বিশ্ব, সোশ্যাল মিডিয়া আর সেল্ফি-স্নানের মধ্যেও সেই গন্ধটা আজও ঠিক একই রয়ে গিয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

book fair International Kolkata Book Fair

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}