এ বার থেকে “এ বাবা, মেয়েদের মতো কাঁদছিস?” বলার আগে লোকে দু’বার ভাববে! ঝাপসা চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কথাটা ভেসে উঠল মনে। তখন বিশ্বকাপ নিয়ে মাঠে চক্কর দিতে দিতে হরমনপ্রীত কউরের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে ঝুলনের। ঝুলন গোস্বামী ছিলেন এ দিনের ম্যাচের বিশ্লেষক, ক্রীড়া সাংবাদিক। জয়ের মুহূর্তে সব ভুলে তিনি দৌড়ে গেলেন, আবেগ লুকোনোর কোনও চেষ্টাই করলেন না। দু’জনে মুখোমুখি হয়ে বিজয়ীর চিৎকার, এবং পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কান্না! ট্রফি উঠে গেল ঝুলনের হাতে। আবেগে ভেসে গেলেন মিতালি রাজ, স্মৃতি মন্ধানা। অঞ্জুম চোপড়া মাঝখানে স্টেডিয়ামে নাচতে চলে গেলেন, আবার এসে সবার সঙ্গে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়ালেন। মুখে হাসি, চোখে জল নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেন। ঝুলনকে রুমাল এগিয়ে দিলেন মহিলা ক্রীড়া সাংবাদিক মায়ান্তি ল্যাংঙ্গার। কোথাও এতটুকু বিসদৃশ লাগল না কিছু।
এই দৃশ্য আগে দেখেছি কি? এই যে সবাই মিলে এক সঙ্গে নির্দ্বিধায় কাঁদতে পারলেন ওঁরা, একটি মেয়ে কপালে টিপ পরে দিনের সেরা খেলোয়াড়ের সম্মান পেলেন! ‘মেয়েদের মতো’ কাঁদতে কাঁদতে বিশ্বজয়ের উদ্যাপনে মেতে গেলেন সবাই। জনসমক্ষে চোখের জলকে পূর্ণ মর্যাদা দিলেন, নিজেদের আবেগের প্রকাশকে স্বীকৃতি দিলেন— এ যদি বেড়া ভাঙা না হয়, তা হলে কী?
বিশ্বকাপ ম্যাচ শেষে মহিলা কণ্ঠের সংযত উচ্ছ্বাসে যে ভাষ্য ভেসে আসছিল, তাতে বার বার মনে করানো হচ্ছিল যে এই জয় ঐতিহাসিক নানা কারণে। মনে হচ্ছিল, কেবল ক্রিকেটের ইতিহাসে নয়, ভারতের মেয়েদের ইতিহাসেও এই জয় একটা দাগ রেখে যাবে। সাধারণত ‘মহিলা খেলোয়াড়’ , ‘মহিলা চলচ্চিত্র নির্দেশক’— এই সব কথায় ‘মহিলা’ শব্দটি যেন এলেবেলে, দুধেভাতের নজরেই দেখা হয়ে থাকে। ‘বিশেষ ছাড়’-এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিত থেকে যায়। এই চোরা অবমাননা থেকে বাঁচতেই হয়তো অনেক জ্ঞানীগুণী মেয়েও নিজেকে ‘মহিলা বিজ্ঞানী’ বা ‘মহিলা শিল্পী’ বলে পরিচয় দিতে চান না। নিজেকে ‘নারীবাদী’ বলতেও তাঁরা চান না। তাঁদের কাছে এ হয়তো পুরুষের সমান গুরুত্ব, মর্যাদা দাবি করার একটা পথ।
অথচ, পিতৃতান্ত্রিক সমাজের এক জন ‘মহিলা’ হিসেবে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা এক জন পুরুষের থেকে আলাদা। তাই মেয়েদের কাজে, সৃষ্টিতে, সেই পার্থক্যের ছাপ পড়াই প্রত্যাশিত। আশাপূর্ণা দেবী বা লীলা মজুমদারের সাহিত্য গড়পড়তা পুরুষ লেখকের লেখার থেকে নানা ভাবে আলাদা। কিন্তু ‘আলাদা’ মানেই কি নিকৃষ্ট? এখানেই আপত্তি। বিশ্বকাপ জেতার ফলে ‘মহিলা’ ক্রিকেটের প্রতি সেই অবজ্ঞার মনোভাব সাম্যে উন্নীত হবে কি না, তাচ্ছিল্য উত্তীর্ণ হবে কি না সম্ভ্রমে, সে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। তবু অনেকটা কাজ যে এগিয়ে দিলেন হরমনপ্রীতরা, তাতে সংশয় নেই।
ম্যাচের শেষে উপস্থাপক এ-ও মনে করাচ্ছিলেন যে রিচা ঘোষ থেকে শেফালি বর্মা, প্রত্যেকে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে উঠে এসেছেন। ম্যাচ জয়ের মুহূর্তে উঠে আসছিল মেয়েদের নানা প্রতিকূলতা, লিঙ্গবৈষম্যের বেড়া ভাঙার বিবরণ। অনেক আশা-জাগানো কথা। এখানেই মিলে যাচ্ছিল ক্রিকেটের ইতিহাসের সঙ্গে নারী-ইতিহাস। কোথাও যেন অনুভব করছিলাম যে, এই লড়াই জেতার পরে মাঠের বর্তমান যোদ্ধাদের সঙ্গে উপস্থাপক, ধারাভাষ্যকার, ক্রীড়া সাংবাদিক— সবাই যেন এক পিতৃতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে সহযোদ্ধা, সহমর্মী হিসেবে একাত্ম বোধ করছিলেন।
তবু শেষ অবধি যা মনকে অভিভূত করল, তা হল ওই মেয়েগুলির নিজেদের আবেগকে প্রকাশ্যে উজাড় করে দিতে পারার মতো সাহস! হৃদয়-ছাপানো উচ্ছ্বাস। মহিলা খেলোয়াড় বলেই কি উদ্যাপনে এত আবেগের আধিক্য? না কি আমি মহিলা বলেই আরও একাত্ম বোধ করছিলাম? চোখের জলের ভাষাটা তো বড্ড আপন! মূল আবেগ তো ভারতীয় হিসেবেই! বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের যে সুর ছোটবেলা থেকে মনে গেঁথে গিয়েছে, এই জয়ে তা যেন আর এক বার মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছিলাম। তবু যখন ওই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা বলছিলেন, সুখে-দুঃখে তাঁরা কী ভাবে একে অন্যের পাশে ছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল, এ যেন অতি চেনা ‘মেয়েলি’, ‘ঘরোয়া’ কথা সব। ঘরের মাঠেই জয় করে নিল বিশ্ব।
চোখে জল নিয়েই গর্বিত হয়ে দেখলাম যে ঝুলন গোস্বামী বলছেন, ২০১৭ সালে, তাঁর শেষ বিশ্বকাপ ফাইনালে পরাজয়ের পর, ঝুলনের ঘরে এসে হরমনপ্রীত আর স্মৃতি বলেছিলেন যে পরের বার ঝুলন টিমে থাকুন বা না থাকুন, ঝুলনের জন্যে কাপটা জিতবেন তাঁরা। ২০২২ সালে তা আর হয়নি, কিন্তু এ বারে হল। এবং তাঁরা দু’জনে ঝুলনকে বলতে ভোলেননি— এটা তোমার জন্য, তোমাদের জন্য। বলতে বলতে ঝুলন কাঁদলেন, আমিও কাঁদলাম। বড় সুখের সে কান্না। পূর্বনারীর প্রতি এই কৃতজ্ঞতা, এই সম্মান, উত্তর-প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা, প্রায় প্রত্যেককেই বলতে শুনলাম। হরমনপ্রীত বললেন এই জেতা শেষ নয়, এটা শুরু। এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। এ ভাবেই এ দেশের মেয়েরা একে অপরের পাশে দাঁড়ানো অভ্যাস করুন, লিঙ্গ-পরিচয়ের বেড়া ভেঙে উঠে আসুন। নারী-পুরুষ পরিচয় ভুলে আমরা একটু মন খুলে কষ্টের, আনন্দের, স্বস্তির কান্না কাঁদতে পেরে ধন্য হই। হৃদ্রোগের সম্ভাবনা কমাই, হৃদয়ের প্রসার ঘটাই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)