সেই হাওয়া
একটা সময়ে ইংরেজি নববর্ষের ‘গ্রিটিংস কার্ড’-এ যা বলার বলা হয়ে গিয়েছে ভেবে নিত যারা, তাদের ‘ওভার ট্রাম্প’ করার জন্য এসে যেত ফেব্রুয়ারি। বাতাসে তখন পালাবদলের গন্ধ। আকাশে ঝকঝকে তারা। রাতের হাওয়ায় শিরশিরানি থেকে গিয়েছে। পর্দা টেনে দিয়ে ব্যাগের ভিতর থেকে খাতাটা বার করেছিল মেয়েটি। সেই খাতার মলাটের ভিতর থেকে দুরুদুরু বুকে বার করে আনা চিঠিতে তাকে প্রেমের প্রস্তাব জানিয়েছিল যে ছেলেটি, তার হাতের লেখা আর কবিতার মতন ভাষায় মেয়েটি প্রথমেই প্রভাবিত। তাদের প্রেম ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে অনেক বছর পার করে ফেলার পর মেয়েটি জানতে পেরেছিল, সেই হাতের লেখা বা চিঠির ভাষা কোনওটাই তার প্রিয়জনের লেখা নয়। প্রেম বিশারদ বন্ধু লিখে দিয়েছিল মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে। কার প্রেমে পড়েছিল, ভাবতে ভাবতে মেয়েটির কেটে যায় বাকি জীবন। এখন নিজের মেয়ে যখন একটানা মেসেজ করে যায় ফোনে, মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় এক বার জিজ্ঞেস করতে, মেয়ে যাকে ভাবছে উল্টো দিকের মানুষটা সে-ই তো? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’জনের মধ্যে ‘ভিডিয়ো কল’ হচ্ছে দেখে যেন খানিক স্বস্তি পান! প্রযুক্তি কতখানি বদলে দিল প্রেম আর সম্পর্ককে!
‘যেথা আমি যাই নাকো…’
‘ইমোজি’ বা ‘রিপ্লাই’-এর থেকেও আধুনিক প্রেমের সব থেকে বড় ‘সমস্যা’ নীরবতা। একটানা প্রশ্ন করে যাওয়ার পরেও উল্টো দিক থেকে কোনও জবাব নেই মেসেজের। ফোন করলেও বেজে যাচ্ছে। এই অবস্থায় প্রেমের কঠিন পরীক্ষা! বার বার যোগাযোগ করে যাওয়ার চেষ্টা করে গেলে এর পর ‘ব্লক লিস্ট’। অস্থির এই সময় পার করে ‘মানভঞ্জন’ হলে আবার একে একে সাড়া দেওয়া সব মাধ্যমে। ‘পূর্বরাগ’ শুরু হয়েছে বুঝতে পারা যেত যখন ভুল করে মেসেজ চলে আসত অথবা আমি যে তোমায় খুঁজেছি বোঝানোর জন্য অনেক বছর আগের ছবি বা লেখাতে আচমকা ‘রিঅ্যাকশন’। এই যে প্রতি মুহূর্তে বলে চলা মনের কথাগুলোর আগে লিখে দেওয়া থাকে ‘এনক্রিপ্টেড’, এই ‘এনক্রিপশন’ বাড়তি ভরসা জোগায় বইকি! ব্যাগের ভিতর, খাতার মলাটের ভিতর থেকে চিঠি উদ্ধারের ভয় নেই। গোপন কথা লিখে ফেলতে চিন্তা নেই, ইচ্ছেমতন ‘ডিলিট’ করা যায়, ইচ্ছেমতন নির্ধারিত সময় পরে ‘ডিভাইস’ থেকে সব মেসেজ মুছে ফেলা যায়। কয়েক দিন কথা বলার পর অনায়াসেই জানতে চাওয়া যায়, ‘‘সামনাসামনি দেখা করা যায় কবে?’’ সম্পর্ক স্থাপন করার সময় যে দূরত্ব নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ থাকে, প্রযুক্তি তাকে করে দিয়েছে অনেক সরল। বারাসত থেকে বার্লিন, আন্দুল থেকে আমস্টারডাম— কথা হতে হতে চার হাত এক হয়ে যাচ্ছে অচিরেই। বেশ কিছু দিন আগেও সম্পর্ক নিয়ে যে বিরহের আখ্যান রচিত হত, সেই বিরহ এখন আর সে ভাবে সকলের সমষ্টিগত হয়ে ওঠে না, কারণ বিরহের সেই দেখা না-পাওয়া, কথা শুনতে না-পাওয়ার সমস্যা আজকের সময়ে বিরল। ঠিকঠাক নেট কানেকশন মেঘ আর অলকাপুরীর আলেখ্যকেই আজ দূর গ্রহের করে দেয় যেন! শরদিন্দুর সেই গল্পটা ‘গোপন কথা’— একটি ছেলে আর মেয়ের কিছু কথা হয়েছিল। তার পর আর কোনও দিন দেখা হয়নি— এই প্লটকেও আজকের দিনে দুর্বল করে দেয়। ইচ্ছে থাকলে এই পৃথিবীতে কেউ বা কিছুই আর গোপন নয়। ডিজিটাল ডেটা হারাতে দেয় না কিছু বা কাউকেই। প্রেম না-থাকুক, প্রেমের গোপন কথোপকথন থেকে যায় কোনও না কোনও ডেটা সেন্টারে।
ডিজিটাল ডেটিং
আপনি আপনার প্রেমিক/ প্রেমিকা সম্পর্কে কতটা জানেন? তাঁর পছন্দ, তার খারাপ লাগা? আপনি যা জানেন, তার থেকে তাঁর ডিভাইস অনেক বেশি জানে। আর সেই সূত্র তাঁরই দেওয়া— বিভিন্ন ‘সার্চ হিস্ট্রি’, নানাবিধ লেখা বা ছবি পোস্ট করা এবং শেয়ার করার মাধ্যমে। সম্পর্কের শুরুর দিকে বাড়তি দায়িত্ব থাকে একে অপরকে খুশি করার। থাকে নতুন নতুন ভাবে অবাক করার উদ্যোগ। ডিজিটাল প্রোফাইল সহজেই জানিয়ে দেয় পছন্দ-অপছন্দের একটা প্রাথমিক তালিকা। বিগত বছরগুলি যদি ধারাবাহিক ভাবে কেউ খেয়াল করেন তা হলেই জানতে পারবেন অন্য জন কেমন গান শোনেন, কোথায় কোথায় খেতে যেতে ভালবাসেন, প্রিয় রাজনৈতিক দল, প্রিয় ফুটবল ক্লাব, পছন্দের কবি, ভাল লাগা প্রকাশ করার মুহূর্তে প্রিয় শব্দ। বিতর্ক কী ভাবে করেন, রেগে গেলে কতখানি প্রতিক্রিয়া জানান— তার একটা ধারণাও পাওয়া যায়। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যেত ফেক প্রোফাইলের গল্প। যেখানে এক জন মানুষ সম্পূর্ণ অন্য মানুষ সেজে কথা বলতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে সেই প্রবণতা যেমন কেটেছে, তার পাশাপাশি অন্যরাও সহজে বুঝতে পারেন কোনটা আসল প্রোফাইল। প্রোফাইল অনুসরণ করে শুধুমাত্র তাঁর পছন্দ-অপছন্দ জেনে নেওয়াই নয়, বিভিন্ন সময়ে তাঁকে চমকে দিতেও কাজে দেয়। চার বছর আগে কোনও জায়গায় সামুদ্রিক মাছে ‘অ্যালার্জি’র কথা লিখে রাখা মনে রেখে রেস্তরাঁয় অর্ডারের সময় বলা, ‘‘সি ফুডটা আমাদের দেবেন না।’’ অন্য দিকে থাকা মানুষটা তখন অবাক! কী ভাবে জানল! আর এই জানার জন্য প্রিয় রং, প্রিয় গানের প্রশ্নগুলি আধুনিক সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই আর করতে হয় না। এর পর থাকে আরও একটি স্তর। যেখানে সম্পর্কের বেশ কিছু দিন পরে জানতে পারা যায়, সামনে থাকা ব্যক্তি আর তাঁর ডিজিটাল প্রোফাইল সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বরের। তাই যাঁরা আর একটু সাবধানি, তাঁরা প্রোফাইল দেখে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বা আলোচনার সময়ে দেখে নেন লিঙ্গসাম্য নিয়ে নিজের প্রোফাইলে গলা-ফাটানো লোকটা আদপে রূপান্তরকামীদের নিয়ে কী ভাবেন বা পোষ্যদের উপর অত্যাচার নিয়ে লিখে লাইক কুড়িয়ে পাওয়ার পর বাস্তব জীবনে কী ভাবেন।
‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’
এ পৃথিবীর সব কিছুই পরিবর্তনশীল। সময়ের সঙ্গে তাই প্রেমের ধারণাও গিয়েছে বদলে। জ্যোৎস্না রাত, জোনাকি বা ‘ঝিকিমিকি তারা এই মাধবী রাত’ সে ভাবে জীবনে যোগ না-হলেও সারা দিন কানে কানে লেগে থাকা, ফিসফিস করে নিঃশ্বাসের শব্দ দুই গোলার্ধে থাকা মানুষের মাঝেও সম্ভবপর হয়ে গিয়েছে প্রযুক্তির দৌলতে। মনখারাপ করা মুখ স্ক্রিনে দেখে প্রিয়জন যখন স্ক্রিন ঘুরিয়ে নিজের দেওয়ালে দু’জনের একসঙ্গে কাটানো ছবি দেখায় তখন মুখে নিজের থেকেই এসে যায় হাসি। মেসেজে রেখে দেওয়া স্পেস, পাঠিয়ে ডিলিট করে দেওয়া, বেশ কিছু ক্ষণ অবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দু’জন দু’জনকে দেখা— প্রেম তো জড়িয়ে আছে ফোন, ইয়ারফোন থেকে চার্জার হয়ে ল্যাপটপে। পাতা পড়ার শব্দ পাশাপাশি বসে না-শুনতে পেলেও আমার ভাগে যখন রাত— তোমায় ডেকে নিতাম তোমার বিকেলে। শান্ত কোথাও দাঁড়িয়ে একসঙ্গে শুনতে পাওয়া যেত— কী ভাবে বসন্ত আসবে। বিষাদের মতো বিরহও এখন ব্যক্তিগত। আমি যতই চাই আমার দুঃখকে আপামর করে নিতে, ঘুরেফিরে সে আমার আঙিনাতেই লুটিয়ে লুটিয়ে পড়ে। তাই ঢেউয়ের পর ঢেউ পেরিয়ে আমি পৌঁছে যেতে থাকি তোমার কাছে, তোমার দিকে। প্রেম কালে কালে তার ডালপালা মেলে যাবে। কখনও মেঘকে দূত করে। কখনও আবার ডেটা প্যাকে। একই সঙ্গে ‘এনক্রিপ্টেড’ মেসেজে।
(লেখক গবেষক। মতামত নিজস্ব)