অপারেশন সিঁদুর-এ ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের মাটিতে অবস্থিত ন’টি সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটি ধ্বংস করার পর এক মাস কেটে গিয়েছে। এই অভিযানের বিশ্লেষণ থেকে কয়েকটি প্রাথমিক কিন্তু স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ উঠে আসছে। প্রথমত, ভারত তীব্র আক্রমণ করেছিল, কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট, এবং সতর্ক। সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে আক্রমণ করা হয়েছিল রাতে। বস্তুত, সামরিক অভিযান হিসাবে, এবং তার পরিচালনাগত দিক থেকে অপারেশন সিদুঁর অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তান সর্বোচ্চ মাত্রায় সতর্ক থাকা সত্ত্বেও ভারত তাদের প্রতিরক্ষা ব্যূহ ভেদ করে অভীষ্ট লক্ষ্যে হানা দিতে সক্ষম হয়, এবং বেশ কয়েক জন কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদীকে হত্যা করে (উল্লেখ্য যে, তাদের শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং পুলিশের বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্তা)।
স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে যতগুলি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযান হয়েছে, অপারেশন সিঁদুরের লক্ষ্য ছিল সেগুলির মধ্যে বিস্তৃততম। কিন্তু, এই অভিযানের গোড়ায় ভারত সচেতন ভাবেই পাকিস্তানের সামরিক ও প্রশাসনিক লক্ষ্যগুলিতে আক্রমণ করেনি। বার্তাটি স্পষ্ট ছিল— ভারতের উদ্দেশ্য সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অভিযান; পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নয়। কিন্তু, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী লড়াইয়ের তীব্রতা বাড়াতে মনস্থ করে, এবং ভারতকে বাধ্য করে আক্রমণের তীব্রতা বাড়াতে।
দ্বিতীয় কথা হল, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের অবস্থান কী হবে, এই অভিযানের পরে সেই প্রশ্নটির উত্তর অপরিবর্তনীয় ভাবে পাল্টে গেল। সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রে এত দিন ভারতের যে দ্বিধা ছিল, এ বার তা ঝেড়ে ফেলা হল। কাশ্মীরের প্রশ্নটি যাতে ‘আন্তর্জাতিক’ না হয়ে ওঠে, তা নিশ্চিত করতে ভারত এত দিন কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার ফলহীন পথে হেঁটেছে— গোটা দুনিয়ার সামনে একের পর এক প্রমাণ পেশ করে গিয়েছে, কিন্তু তাতে বিশেষ কোনও লাভ হয়নি। এমনকি, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের অধীনস্থ টেররিজ়ম স্যাংশনস কমিটি দীর্ঘ দিন ধরে পাকিস্তানকে ছাড় দিয়েছে, পরিষদের এক স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রের প্রশ্রয়ের ছায়ায় লুকিয়ে থেকে নিজেদের মতো চলতে।
ভারত বৈশ্বিক কূটনীতির পথ থেকে সরে আসছে না, কিন্তু অতঃপর আর শুধু সেই কূটনীতির উপরেই নির্ভরশীলও থাকবে না। এখন থেকে ভারত সন্ত্রাসবাদের উত্তর দেবে সামরিক শক্তি দিয়ে; এবং যে কোনও প্রত্যাঘাতের জবাব দেবে স্পষ্ট এবং অটুট আত্মবিশ্বাসের জায়গা থেকে। প্রয়োজনে ভারত আরও কঠিন পরিণতির পথে হাঁটতেও প্রস্তুত।
ভারত কী করবে না, সেটাও স্পষ্ট— বস্তুত, সেটাই আমার তৃতীয় পর্যবেক্ষণ— ভারত অতঃপর পাকিস্তানকে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রের জুজু দেখিয়ে ভারতকে, এবং গোটা দুুনিয়াকে পণবন্দি করে রাখতে দেবে না। ২০১৬ সালে ভারত সীমানা টপকে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল; ২০১৯ সালে আকাশহানা দিয়েছিল পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া অঞ্চলে। অর্থাৎ, ভারত ক্রমেই নিজের অভিযানের পরিসীমা বাড়িয়েছে। এ বার নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত টপকে পাকিস্তানের প্রাণকেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে ভারতীয় সেনা। কাজেই, পাকিস্তানের তরফে মারাত্মক কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের হুমকি যে নিতান্তই ফাঁপা, ভারত তা দুনিয়ার সামনে প্রমাণ করে দিয়েছে। এ কথা প্রমাণিত যে, পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতিতে না পৌঁছেও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রিত, সুপরিকল্পিত সামরিক আক্রমণ সম্ভব।
পাকিস্তান বুঝে নিতে পারে যে, অতঃপর সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটলে ভারত পূর্ণ শক্তিতে প্রত্যাঘাত করবে। পাকিস্তানি সেনাকর্তারা এর পর যখনই তাঁদের ভাড়াটে সৈন্যদের কাশ্মীর বা অন্যত্র ছায়াযুদ্ধ করতে পাঠাবেন, তাঁদের নিজেদের প্রশ্ন করতেই হবে— এই হামলার প্রত্যুত্তরে যে সামরিক প্রত্যাঘাত ভারত করবে, সেটা সইবার মূল্য কি এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য দেওয়া উচিত?
বস্তুত, পাকিস্তান এ বার উপলব্ধি করতে পারে যে, আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার ফলে সে দেশের সাধারণ মানুষের জীবনধারাটিই শুকিয়ে যেতে পারে— অর্থাৎ, তৈরি হতে পারে তীব্র জলসঙ্কট। অপারেশন সিঁদুর আরম্ভ হওয়ার আগেই ভারত ঘোষণা করেছিল যে, সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি আপাতত স্থগিত রাখা হল। জল বন্ধ করার কোনও অভিসন্ধি ভারতের তরফে এখনও দেখা যায়নি— তার জন্য প্রয়োজনীয় বাঁধ ও জলাধার নির্মাণের কাজ ভারত শুরুই করেনি— কিন্তু, ‘করতে পারে’, এমন একটি সম্ভাবনাই উপমহাদেশের ভূ-রাজনীতির সমীকরণগুলিকে পাল্টে দেয়। শান্তির জন্য ভারত আর শুধু আলোচনা চালিয়ে যেতে রাজি নয়; ভারত এখন বলছে, জলের জোগান অব্যাহত রাখতে হলে সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়া বন্ধ করতেই হবে।
সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসূত্র কতখানি গভীর, এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিষয়ে তার অবস্থান কেমন বিপজ্জনক, অপারেশন সিঁদুর গোটা দুনিয়ার সামনে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছনোর জন্য পর্দার আড়ালে কী ধরনের দর-কষাকষি চলল, সেই আলোচনার কুশীলব কারা, এ সবই নিশ্চয় ক্রমশ প্রকাশ্য। কিন্তু, এটা অনস্বীকার্য যে, ভারত এমন প্রবল সামরিক চাপ তৈরি না করলে, এবং পাকিস্তান আক্রমণের মাত্রা বাড়ানো বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে সামরিক অভিযান বন্ধ না করলে এই যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছনো সহজ হত না।
অদূর ভবিষ্যতে ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তাৎপর্যপূর্ণ উন্নতি ঘটবে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ, দু’পক্ষের মধ্যে এই পরিস্থিতিতে কোনও আলোচনার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত— বিশেষত কাশ্মীর প্রশ্ন। কিন্তু, এই দ্বিপাক্ষিক সমস্যার মূল কারণও কাশ্মীর নয়, তার চূড়ান্ত সমাধানের রাস্তাও কাশ্মীর হয়ে যায় না। এটা ভারতের এলাকার উপরে নিজেদের দাবির যৌক্তিকতা খাড়া করার জন্য পাকিস্তানি প্রচারমাত্র। এবং, এই অবস্থানের গোড়ায় রয়েছে একটা অপযুক্তি— পাকিস্তানের নতুন সামরিক প্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরও সম্প্রতি এই যুক্তিটি ব্যবহার করলেন— যে দেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নন, সে দেশে মুসলমানদের পক্ষে বাস করা অসম্ভব।
এই পরিস্থিতি যত দিন না পাল্টায়, তত দিন ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য। যদিও ভারতের লক্ষ্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা নয়, বরং আর্থিক উন্নয়ন এবং উচ্চ প্রযুক্তি-নির্ভর বৃদ্ধি, কিন্তু পাকিস্তানেও এমন সদিচ্ছার বাতাস বইবে, সেটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। ভারত দেখিয়ে দিয়েছে যে, তারা পাকিস্তানের উস্কানি প্রতিরোধ করতে এবং পাল্টা জবাব দিতে সক্ষম— কিন্তু, ভারতকে ক্রমাগত নিজেদের কৌশল নিয়ে চর্চা করে যেতে হবে, পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে, এবং প্রস্তুত থাকতে হবে। তার জন্য সামরিক ক্ষমতাবৃদ্ধি যেমন প্রয়োজন, তেমনই চাই কূটনৈতিক দুর্বলতাগুলি মেরামত করা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দিকে জোর দেওয়া, এবং মাঝেমধ্যেই এমন হিংসা, ক্ষতি এবং অব্যবস্থার জন্য নাগরিকদের প্রস্তুত রাখা।
ভারতের অনেকগুলি সুবিধা আছে। আমাদের জিডিপি পাকিস্তানের এগারো গুণ; সামরিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেও দু’দেশের তুলনা হয় না। কিন্তু, অন্য দিকে দেশের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থার উপরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কঠোর, জাতীয় বাজেটও তাদেরই নিয়ন্ত্রণে; এবং দীর্ঘ কাল ধরে চিন এবং তুরস্কের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের ফলে তারা বড় মাপের সামরিক সংঘাতও ঠেকাতে পারে। বস্তুত, এ বারই তুরস্কের ড্রোন এবং চিনা সামরিক সরঞ্জাম (যেমন, জে-১০সি ফাইটার জেট এবং পিএল-১৫ গাইডেড মিসাইল) তাদের সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করেছে, এবং ভারতের বায়ু প্রতিরক্ষাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। কাজেই, সামরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে ভারতের শক্তি বেশি হলেও পাকিস্তানের ক্ষমতা আছে ভারতের বড়সড় ক্ষতি করার।
আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় ভারত যে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির প্রমাণ দিয়েছে, তা প্রশংসনীয়। ভারত প্রমাণ করেছে যে, প্রয়োজন হলে তারা দ্রুত, নিখুঁত এবং সুনির্দিষ্ট সামরিক আক্রমণে পাকিস্তানের সন্ত্রাস-পরিকাঠামো ধ্বংস করতে সক্ষম। এবং, চরম আবেগের মুহূর্তেও ভারত শান্ত থাকতে পারে, হিসাব করে পদক্ষেপ করতে পারে।
সাম্প্রতিক ঘটনাক্রমে ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্নটি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় ভারতকে সর্বশক্তি দিয়ে পথ খুঁজে চলতে হবে।
প্রোজেক্ট সিন্ডিকেটসাংসদ, কংগ্রেস
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)