E-Paper

তিনি একাই ‘একশো’

কর্তব্যপরায়ণ, সৎ, সংবেদনশীল মানুষ সন্তোষ দত্তের দু’টি সত্তা, অভিনেতা ও আইনজীবী। একই সঙ্গে মঞ্চ, ওকালতি, সিনেমা চালিয়ে গেছেন।

অমিত দাস

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৪১
নির্বিকল্প: ‘এক মিনিট!’ জয় বাবা ফেলুনাথ-এর স্মরণীয় দৃশ্যে জটায়ুরূপী সন্তোষ দত্ত।

নির্বিকল্প: ‘এক মিনিট!’ জয় বাবা ফেলুনাথ-এর স্মরণীয় দৃশ্যে জটায়ুরূপী সন্তোষ দত্ত।

শরৎকাল, ১৯৮৭ সাল। ঠান্ডা তখনও তেমন পড়েনি। কিন্তু আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে তিনি চলেছেন। মানিকদার অমোঘ ডাক তো তিনি উপেক্ষা করতে পারতেন না, এ দিকে ফুসফুসে থাবা বসিয়েছে কর্কটরোগ। বার বার যাচ্ছেন ঠাকুরপুকুরে রেডিয়েশন নিতে। কর্তব্যে তিনি অবহেলা করবেন না, অসুস্থ শরীর নিয়েও সুকুমার রায় তথ্যচিত্রের ডাবিং সেরেছেন। ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে শেষ দিকে কোর্টে যেতেন, দাঁড়িয়ে সওয়াল করার ক্ষমতা ছিল না, অনুমতি নিয়ে চেয়ারে বসে তাঁর বক্তব্য আস্তে আস্তে বলতেন। মামলায় জেতার পর বলেছিলেন, “কেসটায় হার হলে লোকে বলত, সন্তোষ দত্ত অসুস্থ, অসুখের কারণে পয়সা নিয়ে মামলা ছেড়ে দিয়েছে।”

কর্তব্যপরায়ণ, সৎ, সংবেদনশীল মানুষ সন্তোষ দত্তের দু’টি সত্তা, অভিনেতা ও আইনজীবী। একই সঙ্গে মঞ্চ, ওকালতি, সিনেমা চালিয়ে গেছেন। শো করে যত রাতেই ফিরুন, ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় কোর্টের দিকে রওনা হতেন। এক বার দুর্গাপুরে নাট্যোৎসব, সন্তোষ দত্ত ট্রেন ধরে সকালে দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় এসে মামলা লড়ে বিকেলের ট্রেনে দুর্গাপুরে ফিরলেন অভিনয় করতে।

তাঁর জন্ম ১৯২৫ সালের ২ ডিসেম্বর, উত্তর কলকাতায়। বর্ধমানে ছিল দেশের বাড়ি। পিতা পূর্ণচন্দ্র দত্তের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সন্তোষ সর্বকনিষ্ঠ, পড়াশোনা এক সাধারণ স্কুলে। সাদামাঠা জীবনে বন্ধু ছিলেন তাঁর বাবা। গিরিশ ঘোষের নাটকের বই বাবা-ছেলে মিলে পড়তেন। অল্পবয়সে বাবার ক্লাবে নাটকে অংশগ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগর কলেজে বি এ পড়তেন, কলেজের অনুষ্ঠানে নানান নাটকে অভিনয়ও করতেন।

যখন মাত্র উনিশ বছর বয়স, ব্যাঙ্কে চাকরি শুরু করার আগে অন্য একটা জায়গায় চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন। সেখানে নিয়োগকর্তাদের প্রথম পছন্দই তিনি। যিনি দ্বিতীয় ছিলেন, তাঁর আসলে চাকরিটা খুব প্রয়োজন বুঝে সন্তোষ দত্ত বলে এলেন, তিনি চাকরিটা নেবেন না।

তাঁর যে অভিনয়ের সহজাত ক্ষমতা আছে, সেটা বাড়িতেই বোঝা গিয়েছিল। প্রায় প্রত্যেক সংসারে যা হয়ে থাকে, মাঝেমধ্যেই তাঁর বয়স্ক বাবা-মায়ের মধ্যে টুকটাক লেগে যেত আর অচিরেই তা ঝগড়ায় পরিণত হত। এক দিন সন্তোষ দত্ত, দরজা বন্ধ করে আয়নার সামনে বাবা-মা’র সেই ঝগড়াটা অনুকরণ করে যাচ্ছিলেন, হুবহু দু’জনের মতো গলা করে। হঠাৎ দেখেন, পিছনের জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর বাবা পুরোটা শুনছেন। বললেন, “ভালই তো হচ্ছে!” ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে সিনেমা-থিয়েটার দেখেছিলেন, প্রমথেশ বড়ুয়ার মুক্তি থেকে শুরু করে কে এল সায়গলের প্রায় সব ছবিই। তখন অহীন্দ্র চৌধুরী শিশির ভাদুড়ি দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের যুগ— বাবা-ছেলে কিছুই বাদ দিতেন না।

সন্তোষ দত্তের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের যোগাযোগ— ব্যাঙ্কে চাকরি করার সময় নাটকের অভিনয় থেকে। ‘আনন্দম’ সংস্থার নাটকটি ছিল সুকুমার রায়ের চলচিত্তচঞ্চরী। সন্তোষ দত্ত করবেন ভবদুলালের ভূমিকায়। সেই নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল মহারাষ্ট্র নিবাসে। পথের পাঁচালী বিদেশ থেকে পুরস্কার নিয়ে ফিরে এলে আনন্দম সংস্থা ঠিক করে, পথের পাঁচালী-র টিমকে সংবর্ধনা জানাবে। ভয়ে সন্তোষ দত্তের পা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। পরে তিনি লিখেছেন, “দর্শকবৃন্দের প্রতিক্রিয়া আগের মতোই, কিন্তু সব ছাপিয়ে সব সময়েই একটি ভারী গলার প্রাণখোলা হাসি কানে বেজেছে। সেই হাসি সত্যজিৎ রায়ের।” নাটকটি দেখে ভারী খুশি হয়ে সত্যজিৎ রায় সন্তোষ দত্তকে ডেকে পাঠান, তাঁকে নিয়ে যান সবিতাব্রত দত্ত। সন্তোষ দত্ত লিখেছেন, “আমার এই পাঁচ পাঁচ হাইট আর গুলি গুলি চোখ নিয়ে পিটপিট করে চাইতে গেলাম তাঁর দিকে। ওই বিরাট মানুষটিকে সেই দিনই প্রথম দেখলাম।”

ডাক পেলেন সত্যজিৎ রায়ের পরশ পাথর ছবিতে, ১৯৫৮ সালে। কাজটি করার সময়ে দারুণ প্রেরণা পেয়েছিলেন পরিচালকের একটি বক্তব্যে। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, “সন্তোষ, আপনার জন্য ৭৫০ ফিট অ্যালট করে রেখেছিলেম, আপনি ২৫০-এই শেষ করে দিয়েছেন। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ।” তার পর একে একে সমাপ্তি, মহাপুরুষ ও গুপী গাইন... ইত্যাদি ছবিতে তাঁকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় কাজ করেন। আরও নানা নামী পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করেছেন, একের পর এক ছায়াছবিতে। তবে বাঙালির কাছে তাঁর আসল খ্যাতি, ‘লালমোহন গাঙ্গুলি’ তথা ‘জটায়ু’র ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য। সোনার কেল্লা ও জয় বাবা ফেলুনাথ, এই দুই ছবিতে তিনি জটায়ুর চরিত্রে বাঙালির মননে একেবারে পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সত্যজিৎ রায় এক রকম বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর গল্পের অলঙ্করণে জটায়ুকে সন্তোষ দত্তের আদলেই আঁকতে। বাস্তবের সন্তোষ দত্তও জটায়ু চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলেন। সন্তোষ দত্ত গাড়ি কেনার সঙ্গে সঙ্গে আমরা গোরস্থানে সাবধানে বইয়ে দেখতে পাই— লালমোহনবাবুর গাড়ি কেনার কথা।

জয় বাবা ফেলুনাথ সিনেমার শুটিংয়ের আগের দিন সন্তোষ দত্ত প্রচণ্ড নার্ভাস। সত্যজিৎ রায় বলেছেন, কাল আড়াই কেজি ওজনের ছুরিগুলো তাঁর দিকে তাক করে ছুড়ে মারা হবে, আবার ছুরিগুলো ছুড়বেন কামু মুখোপাধ্যায়। অদ্যই শেষ রজনী ধরে নিয়ে, ভাবতে ভাবতে বাড়িতে এসে ড্রয়ার খুলে দেখলেন, তাঁর সব বিমার প্রিমিয়ামগুলো দেওয়া আছে কি না। অভিনেতা দীপঙ্কর দে-র কাছে তাঁর কোষ্ঠীটা ছিল। বাঁচবেন না মরবেন, জানার জন্য তাঁকে পর পর সাত বার ফোন করে দেখলেন, নম্বরটি ব্যস্ত বা এনগেজড। বিরক্ত হয়ে উঠছেন যখন, পিছন থেকে তাঁর স্ত্রী প্রতিমাদেবী বললেন, কী করে লাইন পাবে, তুমি তো তোমার নিজের নম্বরটাই বার বার ডায়াল করছ! শুটিংয়ে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে গেলেন, “আজ কী হবে জানি না বাপু। একটু এ দিক-ও দিক হলে গায়ে না গেঁথে যায়।” সেই ছুরি ছোড়ার দৃশ্য অবশ্য অন্য ভাবে তোলা হয়েছিল।

মঞ্চেও তিনি সমান সফল। নিজের চোখে দেখেছেন শিশির ভাদুড়ি থেকে শম্ভু মিত্র, নান্দীকার ও আধুনিক গ্রুপ থিয়েটারের অভিনয়। কিন্তু অভিনেতা সন্তোষ দত্তের বিচরণ ছিল স্বকীয়। বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছদ্মবেশী নাটক, নিমু ভৌমিকের সঙ্গে দ্বৈত ভূমিকায় ভ্রান্তিবিলাস, রবি ঘোষের সঙ্গে কনে বিভ্রাট, শ্রীমতী ভয়ঙ্করী, ব্যাপিকা বিদায়— পেশাদার মঞ্চে দাপটে অভিনয় করে গিয়েছেন।

পেশাদার মঞ্চে তাঁর আগমন ১৯৭০-১৯৭১’এ। শুরু করেছিলেন নট-নটী নাটক রঙ্গনাতে আর বিষ নাটক শ্যামাপ্রসাদ মঞ্চে। নট-নটী’তে দানাকালীর চরিত্রে তিনি; যে দৃশ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ দানাকালীর জিভে নাম লিখে দিচ্ছেন, সন্তোষ দত্ত ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো পাঁচ-ছয় হাত দূরে ছিটকে পড়তেন, তার পর হামাগুড়ি দিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের কাছে আসতেন। নিয়মিত ব্যায়ামের ফলে এত শারীরিক সক্ষমতা ছিল যে মাত্র এক-দু’দিন ছাড়া সামান্য আহতও হননি। ‘ওয়ান ওয়াল’ থিয়েটারেও অনেক অভিনয় করেছেন। মফস্‌সলের প্রচণ্ড শীতে ছদ্মবেশী নাটকের এমনই এক শোয়ে তিনি দুটো সোয়েটার ও টুপি পরে মঞ্চে নামলেন। এ নাটকে তিনি মঞ্চে আসার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের হাসি শুরু হত, কিন্তু সে দিন দর্শক চুপচাপ। ব্যাপার বুঝে সংলাপের মধ্যেই টুপি খুললেন, অমনি হাসি শুরু।

উকিল হিসেবেও সন্তোষ দত্ত ছিলেন রসিক। এক মামলায় এক ডাক্তারকে জেরা করার সময় প্রশ্ন করলেন, যিনি খুন হয়েছেন তাঁর দেহের ক্ষতগুলি তো অন্য ভাবেও হতে পারে! যত বার প্রশ্ন করা হচ্ছে, ডাক্তারবাবু প্রতি বার বলছেন, “হতেও পারে, নাও হতে পারে।” এমন বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সন্তোষ দত্ত নাটকীয় ভাবে প্রশ্ন করলেন, “আপনি কি মানুষ?” ডাক্তারবাবুও সেই একই তোড়ে ‘হতেও পা...’ বলে থেমে গেলেন। উকিলমশাই, জজসাহেব, ঘর-ভর্তি সবাই হেসে উঠলেন।

কোর্টের সবাই তাঁর দ্বৈত সত্তার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। এক বিচারকের এজলাসে সন্তোষ দত্ত যত বার সাক্ষীকে প্রশ্ন করছেন, তত বার বিচারক নাকচ করে দিচ্ছেন। এমন কয়েকবার হতে সন্তোষ দত্ত বিরক্ত হয়ে মামলার ব্রিফ তাঁর জুনিয়রকে দিয়ে বললেন, এ ঘরে আর মামলা করা যাবে না। বেরোতে উদ্যত হতেই জজসাহেব বললেন, মি. দত্ত এটা ঠিক নয়, আপনি আমার চেম্বারে আসুন, আমি উঠে যাচ্ছি। চেম্বারে গেলে বললেন, আজ তো বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যায় তো আপনার শো আছে, আপনার গলার অবস্থা তো ভাল নয়, এত রাগ করলে হবে? পকেট থেকে এক শিশি হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ ওঁর হাতে দিয়ে বললেন, ছ’টা করে গুলি স্টেজে নামার আগে অবধি তিন বার করে খাবেন।

শেষ দিকে যেন মুষড়ে পড়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মানিকবাবু, তনুবাবু বা তপন সিংহের ছবিতে অভিনয় করে যে আনন্দটা তিনি পেতেন, তা আর পান না, “যেখানে ছবির ডায়ালগের মধ্যে কোনও সামঞ্জস্য নেই, আমাকে জোর করে সেই সব লাইন বলতে হচ্ছে, সেখানে নিজের থেকেই কাজের প্রতি একটা অনীহা এসে যায়, ভাল ভাবে অভিনয় করার কোনও ইচ্ছা আর আসে না। মানসিক কষ্ট পেলেও এই সব ছবিতে অভিনয় করছি স্রেফ পয়সা রোজগারের জন্য।” ৫ মার্চ ১৯৮৮, চলে গেলেন। সত্যজিৎ রায়ও ফেলুদাকে নিয়ে ছবি করা বন্ধ করে দিলেন, জটায়ুই নেই যে!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Tollywood

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy