Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
জনস্বাস্থ্যের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ এতখানি পিছিয়ে পড়ল কেন
Medical Negligence

অবহেলার চিকিৎসা

সরকারি প্রতিবেদন থেকেই আমরা জানতে পারি, পৃথিবী জুড়ে হৃদরোগ, ডায়াবিটিস, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের অসুখ, ইত্যাদি অ-সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ‘ভয়ঙ্কর’ শব্দটা প্রকৃতার্থেই বলা।

কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৬:০৭
Share: Save:

কয়েক দিন আগে শিক্ষাবিষয়ক এক আলোচনাসভায় এক শিক্ষক জানালেন, বিশেষত ছাত্রীদের স্কুলে অনুপস্থিতির একটা বড় কারণ মায়েদের হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়া। এমন হলে মেয়েদের স্কুল ছুটি করে সংসারের কাজ হাতে নিতে হয়। বক্তার ধারণা, ইদানীং এই প্রবণতা বাড়ছে। সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, বাড়ার কারণ কী?

বাস্তবিকই ঘটনাটা সারা রাজ্যে ঘটছে, নাকি এটা কেবল সুন্দরবন অঞ্চলের ওই শিক্ষকের এলাকার বৈশিষ্ট্য, তা সরাসরি জানার উপায় নেই। কিন্তু, পারিপার্শ্বিক তথ্য থেকে এ বিষয়ে কিছুটা আঁচ করা যেতে পারে। সরকারি প্রতিবেদন থেকেই আমরা জানতে পারি, পৃথিবী জুড়ে হৃদরোগ, ডায়াবিটিস, দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের অসুখ, ইত্যাদি অ-সংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ‘ভয়ঙ্কর’ শব্দটা প্রকৃতার্থেই বলা। ভারত সরকারের হিসাব অনুযায়ী, তিন দশক আগে অ-সংক্রামক রোগের প্রকোপ ছিল ৩০ শতাংশ, এখন সেটা প্রায় দ্বিগুণ। এই স্বীকৃতির পাশাপাশি, ভারত সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্য সরকার অ-সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ করেছে; কিন্তু বাস্তবত, যুদ্ধটা কতখানি রোগের বিরুদ্ধে, সেটা ভুক্তভোগীরাই জানেন। ভুক্তভোগীদের বড় অংশই গরিব মানুষ, এবং তাঁদেরও বেশির ভাগ গ্রামের বাসিন্দা, টাকা নেই বলে যাঁদের বেঁচে থাকার হক নেই।

স্বাভাবিক ভাবেই, রোগ প্রতিরোধে যুদ্ধের মতো হিংস্র সঙ্কল্পের বদলে কিছু লোকহিতৈষী পরিকল্পনা ও তাদের রূপায়ণটাই ছিল কাম্য— বিশ্বের তাবৎ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এমনই বিধান দিয়ে চলেছেন। বিধানগুলো কল্পনাপ্রসূত নয়, নানা অভিজ্ঞতার ফসল। সেগুলোর মধ্যে একেবারে গোড়ার কথা হল, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা। সরকার বিধানগুলো সম্পর্কে সম্যক অবগত, দলিল-দস্তাবেজে সেগুলো জপ করা হয়। যেমন, ভারত সরকারের ২০২২-এর একটি প্রকাশনাতে বলা হচ্ছে, কী ভাবে সরকার সংবিধানের ২১ নম্বর এবং ৪৭ নম্বর ধারা মেনে লোকসাধারণের ‘মানবিক মর্যাদা, জীবনযাপনের অধিকার, দূষণমুক্ত বাতাস ও স্বাস্থ্য’ এবং ‘পুষ্টির মাত্রা, জীবনযাপনের মানোন্ননয়ন ও উন্নত জনস্বাস্থ্যের প্রতি দায়বদ্ধ’। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্ভবত কথার চেয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী— তাই প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ে কী করা হয়েছে বা পরিকল্পনাগুলো কী, সে সম্পর্কে লোকপরিসরে খুব কিছু পাওয়া যায় না।

তবে বাস্তবত, দুই সরকারের গতিবিধি থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ে আগ্রহ দেখতে পাওয়া কঠিন। বরং মানুষের স্বাস্থ্যকে একান্ত ভাবে বৃহৎ হাসপাতাল-নির্ভর করে তোলার তর সইছে না। ভারত সরকারের আয়ুষ্মান ভারত, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি প্রকল্পের উৎকর্ষ নিয়ে তুমুল বিজ্ঞাপন, অথচ প্রাথমিক স্বাস্থ্যের অবস্থা দিনে দিনে করুণতর। ফলে, অ-সংক্রামক ব্যাধি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছে গেলেও, তার মোকাবিলা করার উপায় নেই। বস্তুত, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি ইত্যাদি পতঙ্গবাহিত রোগ ও নানা প্রকারের অ-সংক্রামক ব্যাধির মোকাবিলার করার কাজটাতেই আমরা বহু দেশের থেকে, এমনকি বহু দরিদ্র, সুযোগবঞ্চিত দেশের থেকেও পিছিয়ে আছি। এর কারণও সেই প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতি অবহেলা।

অবহেলার চেহারটা ঠিক কী রকম? শুদ্ধ বাতাস, আলো, জল, সাফাই-ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি যে উপাদানগুলো ছাড়া স্বাস্থ্যের কথা কল্পনাই করা যায় না, সেই ক্ষেত্রগুলোতে অর্জনের একমাত্র দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে অকর্মণ্যতা। আর তার বাইরে, সরাসরি চিকিৎসা পরিষেবার দিকে তাকালে একটা কঙ্কাল ছাড়া কিছু দেখা যায় না। স্বাস্থ্য মানে কেবল চিকিৎসা নয়, এই সত্যটির পাশাপাশি এটাও মানতে হবে যে, স্বাস্থ্যের একটা বড় উপাদান হচ্ছে চিকিৎসা। কোনও লোকসমুদয়ে স্বাস্থ্যের অবস্থা কী রকম, তার একটা সূচক হল সেই সমুদয়ে কত চিকিৎসক আছেন। এটা থেকে মানুষের চিকিৎসার সুযোগ বিষয়ে অনেকটা অনুমান করা যায়। শুধু তা-ই নয়, চিকিৎসকের সংখ্যা চিকিৎসা বাদ দিয়েও লোকসমাজে রোগ প্রতিরোধে এবং স্বাস্থ্যচেতনার বিকাশ ঘটায়।

ভারতে সাধারণ ভাবেই চিকিৎসকের অভাব আছে, কিন্তু অভাবটা শহরের তুলনায় গ্রামে অনেক গুণ বেশি। গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে এই অভাবের তীব্রতা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না। যেমন, দেশে প্রতি আট হাজার লোকসংখ্যা-পিছু এক জন করে সরকারি অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসক আছেন, কিন্তু কেবল গ্রামাঞ্চলের হিসাব ধরলে অনুপাতটা দাঁড়ায় সতেরো হাজারে! আমাদের রাজ্যের অবস্থাটি কী রকম? খারাপের মধ্যেও খারাপ। এ রাজ্যে গড়ে প্রতি সরকারি অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক-পিছু লোকসংখ্যা হচ্ছে এগারো হাজার, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সংখ্যাটা হচ্ছে ছাব্বিশ হাজার!

কেরল ও তামিলনাড়ুতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা মজবুত হওয়ার কারণে সাধারণ ভাবেই স্বাস্থ্যের মান অনেক উন্নত। রাজ্য দু’টিতে প্রতি সরকারি অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসক-পিছু লোকসংখ্যা হচ্ছে যথাক্রমে সাড়ে পাঁচ হাজার ও সাত হাজার; গ্রামাঞ্চলে সংখ্যাগুলো মোটামুটি আট হাজার করে। সরকারি চিকিৎসকের পাশাপাশি অ-সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যাও এই দুই রাজ্যে অনেক বেশি, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। যত দূর জানি, কেরল ও তামিলনাড়ুতে কোথাও হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দেওয়ালে লেখা থাকে না, ‘ডাক্তারবাবু ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মারধর করিবেন না’, যেটা এ রাজ্যে খুবই দৃশ্যমান।

পরিকাঠামোগত এই পার্থক্য থেকে শুধু লোকেদের স্বাস্থ্যগত পার্থক্যই হয় না, সমাজমানসেরও পার্থক্য হয়। যেমন এ রাজ্য যখন চিকিৎসকদের দৈহিক সুরক্ষা নিয়ে উথালপাথাল, তখন কেরল বা তামিলনাড়ুতে কোথাও ধর্না চলছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওষুধের দাবিতে, কোথাও অবস্থান চলছে কোনও ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের দাবিতে। সরকারি নীতির সঙ্গে সমাজমানসের সম্পর্কটা পরিপূরকের: ক্ষেত্রবিশেষে কোনওটা আগে আসে, কোনওটা পরে। আগে নীতি বদলাক, তার পর সমাজ বদলাবে, কিংবা উল্টোটা— কেরল-তামিলনাড়ুর লোকেরা এ রকম গোঁ ধরে রাখার কারণ খুঁজে পায়নি। ঠিক সেই কারণেই, তাঁদের ব্যবস্থায়— কেবল নিপা বা কোভিড নয়— যে কোনও ধরনের সংক্রামক বা অ-সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের প্রস্তুতিটা দেখার মতো।

সেই প্রস্তুতিতে এক দিকে যেমন আছে জনসংখ্যা-পিছু চিকিৎসকের লভ্যতা, তেমনই আছে একেবারে বনিয়াদি স্তরেও রোগনির্ণয়ের মোটামুটি ব্যবস্থা। গ্রামাঞ্চলে লোকসংখ্যা এবং ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ানের অনুপাত কেরল ও তামিলনাড়ুতে প্রতি পঁচিশ হাজার জনসংখ্যা-পিছু এক জন ল্যাব-টেকনিশিয়ান। সর্বভারতীয় গড় হচ্ছে সাঁইত্রিশ হাজার, আর পশ্চিমবঙ্গে ঊনসত্তর হাজার! অর্থাৎ, যেখানে কেরল ও তামিলনাড়ুতে গ্রামাঞ্চলের লোকেরা মোটামুটি সহজেই, এবং বিনা খরচে, সাধারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো করিয়ে নিতে পারেন, এবং ডাক্তারবাবুরা আগে থেকেই তাঁদের সু-চিকিৎসা করার সুযোগ পান, সেখানে আমাদের রাজ্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরকারি ব্যবস্থা প্রায় অদৃশ্য। সরকারি নথি থেকে দেখতে পাচ্ছি, কেরলে ব্লক স্তরের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর প্রায় নব্বই শতাংশে এক্স-রে’র ব্যবস্থা আছে; ইসিজি-র ব্যবস্থা আছে ষাট শতাংশে, আর স্ক্যান করার ব্যবস্থা চল্লিশ শতাংশে। শুধু তা-ই নয়, একেবারে বনিয়াদি স্তরের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর বড় অংশেই এই সুবিধাগুলো আছে। অর্থাৎ, সেখানে চিকিৎসাব্যবস্থা হাসপাতাল ও শহরের উপরে নির্ভরশীল নয়। এ রাজ্যের অবস্থা আমরা অভিজ্ঞতায় জানি।

চিরকাল শুনে আসছি, কেরলের সঙ্গে তুলনা কোরো না, ওরা আলাদা! ইদানীং ‘আলাদা’র দলে যোগ হয়েছে তামিলনাড়ু। কিন্তু, এই আলাদার দোহাই কত দিন? সমস্যা হচ্ছে, দোহাই ছাড়লে বাস্তবিক কিছু করতে হবে। অন্তত ওই মায়েদের কাছে পৌঁছতে হবে, যাঁদের আকস্মিক অসুস্থতা তাঁদের বাচ্চাদের স্কুলে গরহাজির করে দিচ্ছে। বাংলার রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজ সেটা করতে রাজি আছে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। কেননা, তার জন্য প্রথমেই একটা ধ্রুবক মেনে নিতে হবে: মানব-প্রজাতির প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব প্রজাতিগত; কারও টাকা নেই বলে তাঁর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত থাকবে না, এই ধারণাটাই একটা অসভ্যতা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE