সুনালী খাতুন কি ভারতীয় বাঙালি? এটাই সম্ভবত ২০২৫-এর মোক্ষমতম প্রশ্ন। নিছক বাংলাভাষী হওয়ার ‘অপরাধ’-এ দিল্লির পুলিশ সুনালীকে তাঁর পরিবার-সহ আটককরে ‘ভারতঘর’ নামক ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠায়, সেখান থেকে তাঁকে ‘পুশব্যাক’ করে বাংলাদেশে। ভারতের নাগরিকত্ব প্রমাণ করার মতো যথেষ্ট কাগজপত্র ছিল এই কাগজকুড়ানির— ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তোয়াক্কা করে না সে সবের। নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনও সুযোগ দেয় না তাঁকে। অন্তঃসত্ত্বা সুনালীর প্রথমে ঠাঁই হয় বাংলাদেশের রাস্তায়, তার পর সেখানকার কারাগারে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ‘মানবিক কারণ’-এ সুনালীকে দেশে ফিরিয়ে আনল সরকার।
বাংলাভাষী হওয়ার অপরাধেই সুনালীর এই হেনস্থা? না কি, মুসলমান বলে? উত্তর হল, তিনি বাংলাভাষী মুসলমান বলে। ভারতে এই মোদী কালপর্বে মুসলমানদের কত রকম হয়রানির শিকার হতে হয়েছে, সে হিসাব কষা মুশকিল— কিন্তু, তাঁদের পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকিটি বিভিন্ন কারণে বাস্তবায়িত হয়নি। সুনালী খাতুন বাংলাভাষী মুসলমান, ফলে তাঁকে বাংলাদেশি হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া গিয়েছে, তাঁর মতো আরও অনেক বাঙালি মুসলমানকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে চিহ্নিত করেছে গৈরিক বাস্তুতন্ত্র। অর্থাৎ, তাঁর এই হয়রানির পিছনে বাঙালি পরিচিতিটির ভূমিকা রয়েছে। এই মুহূর্তে প্রশ্ন হল, বাঙালি কি সুনালী খাতুনকে ‘বাঙালি’ বলে মনে করে?
এই প্রশ্নটায় এসে দাঁড়ালেই উত্তর জটিল হতে আরম্ভ করে। ভারতে ভাষাগত অস্মিতা রয়েছে, এমন সব গোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালি অন্তত দু’দিক থেকে আলাদা। এক, বাঙালিত্বের সংজ্ঞা এবং পরিধি নির্ধারণ করে— অন্তত, জনপরিসরে যাদের সেই নির্ধারক ক্ষমতা হিসাবে পরিচিত হওয়ার মতো গলার জোর এবং প্রতিপত্তি আছে— মোট জনসংখ্যার একটা অতি ক্ষুদ্র অংশ, ঐতিহাসিক ভাবে যাদের পরিচিতি ‘ভদ্রলোক’। মূলত উচ্চবর্ণ হিন্দু, উচ্চ ও উচ্চমধ্যবিত্ত, এবং শহরের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়। এবং দুই, এই ভদ্রলোক শ্রেণি দীর্ঘ দিন ধরেই জীবন-জীবিকার জন্য বাংলা ভাষার উপরে নির্ভরশীল নয়— অন্তত দু’প্রজন্ম ধরে তারা ইংরেজি-নির্ভর, ‘বিশ্বনাগরিক’। ফলে, ‘ভদ্রলোক’-এর বাঙালি জাতিকল্পনা ক্রমশ হয়ে উঠেছে কিছু সাংস্কৃতিক চিহ্ন-নির্ভর, যা মূলত আলঙ্কারিক, ব্যবহারিক নয়। সেই নির্মিত পরিচিতির বাইরে রয়ে যান বঙ্গবাসীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ— ভদ্রলোকের সংজ্ঞা যাঁদের বাঙালি বলে যদি স্বীকার করেও, ‘প্রথম শ্রেণির বাঙালি’ হিসাবে গণ্য করে না।
বাঙালিত্বের এই সংজ্ঞা মানলে সুনালী খাতুনকে ‘বাঙালি’ হিসাবে স্বীকার করা সত্যিই মুশকিল হবে। শহুরে ভদ্রলোক বাঙালির সাংস্কৃতিক চিহ্ন দূরে থাক, গ্রামবাংলার ব্যবহারিক বাংলা সংস্কৃতি থেকেও সুনালী বিচ্ছিন্ন— তার একমাত্র কারণ, দারিদ্র তাঁকে দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে জন্মভিটে থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গিয়েছে অনেক দূরের অনাত্মীয় শহরে। সেখানে কোনও ‘বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন’-এ সুনালীদের ঠাঁই হয় না; সে ঠাঁই পেতে তাঁরা আগ্রহী, তেমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই। বিভিন্ন ভিডিয়োয় তাঁর বাংলা উচ্চারণে শুনছি, তাতে মিশে গিয়েছে হিন্দি টান, হিন্দি শব্দ। ঠিক যেমন, ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি পরিবারের ছেলেমেয়েদের কথায় বাংলা বাক্যের সিংহভাগ জুড়ে থাকে ইংরেজি শব্দ, ইংরেজি বাক্যরীতি।
সুনালীকে ভারতীয় বাঙালি বলে মানব কি না, এই প্রশ্নটাকে ২০২৫-এর মোক্ষমতম প্রশ্ন হিসাবে চিহ্নিত করার কারণ— বাঙালি অস্মিতার রাজনীতি যদি তৈরি করতে হয়, তা হলে তার পরিধি নির্দিষ্ট করতে হবে, এবং সেই পরিধি থেকে বেছে নিতে হবে এই রাজনীতির মূল প্রশ্নগুলো। এ বছরই বাঙালিত্ব নিয়ে যত প্রশ্ন উঠেছে, তার মধ্যে এই ভাগটি স্পষ্ট। এক গোত্রের প্রশ্ন সুনালী বা আমির শেখদের নিয়ে— রাষ্ট্র তাঁদের ভারতীয় বাঙালি সত্তা স্বীকার করতে নারাজ। আর অন্য গোত্রের প্রশ্ন ‘জনগণমনঅধিনায়ক’ নিয়ে, শেষ অবধি যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বৈধতাকে অস্বীকার করতে চায়। দুটো প্রশ্নের রাজনৈতিক পরিধি যে পৃথক, তা নিয়ে সংশয় নেই। তাতে সমস্যাও নেই। কিন্তু ভদ্রলোক বাঙালির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে যদি প্রথম প্রশ্নটি আদৌ বাঙালিত্বের প্রশ্ন হিসাবে গণ্যই না হয়, সমস্যা সেখানে। এমনকি, সুনালী বা আমির শেখের মতো মানুষরা যদি হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের ঔদ্ধত্য এবং সন্ত্রাসের সম্মুখীন না হতেন, তবে কি আজ যাঁরা সত্যিই তাঁদের অবস্থায় ক্ষুব্ধ, তাঁরাও যথেষ্ট বাঙালি ভাবতেন এই লোকগুলিকে?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সবচেয়ে বড় দায় ‘ভদ্রলোক’ সমাজেরই। তার কারণ, জনবাদী রাজনীতি নিজের মতো করে এ সব প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে নিয়েছে। এখানে মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই বলার। কোভিডের সময় যখন পরিযায়ী শ্রমিক নিয়ে প্রথম হইচই আরম্ভ হল, তিনি তখনই বলেছিলেন, যে বাঙালিরা বাংলার বাইরে কাজ করছেন, তাঁরা রাজ্যে ফিরে আসুন— সরকার তাঁদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করবে। সে কাজের অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতখানি, আদৌ সবার জন্য কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব কি না, রাজ্যে যথেষ্ট কাজ থাকলে এই মানুষগুলো আদৌ অন্য রাজ্যে যেতেন কি না— প্রতিটিই ন্যায্য প্রশ্ন, এবং তার কোনওটির উত্তরই সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নেই। কিন্তু, তাঁর রাজনীতি কী ভাবে বাঙালি সত্তাকে দেখে, এই অবস্থান থেকে সেটা স্পষ্ট— যিনিই নিজেকে ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করতে ইচ্ছুক, মুখ্যমন্ত্রী তাঁকেই বাঙালি বলে স্বীকার করতে, তাঁর আশ্রয় হয়ে উঠতে প্রস্তুত। এই সংজ্ঞার আর কোনও সাংস্কৃতিক শর্ত নেই— সব শ্রেণির বাঙালির নিজস্ব সাংস্কৃতিক চিহ্নের স্বীকৃতি আছে, কিন্তু কোনওটাকেই অন্য কোনওটির চেয়ে অধিক হিসাবে দাবি করা নেই। গত কয়েক বছরে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রশাসনিকতাকে নিয়ে গিয়েছেন যে প্রত্যক্ষ হস্তান্তরের নীতিতে— কোনও ক্ষেত্রে সরাসরি নগদ হস্তান্তর, কোনও ক্ষেত্রে কাজ তৈরি— তাঁর বাঙালিত্বের সংজ্ঞাও সেই নীতিতেই বাঁধা। এই হস্তান্তর শুধু বাঙালিদের জন্য নয়, কিন্তু কেউ বাংলায় আশ্রয় চাইলে তিনিও সুযোগ পাবেন।
গত কয়েক মাসে বাঙালি সত্তার যে রাজনীতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন, তাতেও এই অবস্থানটি স্পষ্ট। ‘ভাষা আন্দোলন’ ইত্যাদি কথা উচ্চারণ করেছেন বেশ কয়েক বার, কিন্তু সে প্রশ্নের গভীরে ঢোকেননি। আরও লক্ষণীয়, এক বারের জন্যও ‘ভদ্রলোক’-এর সংজ্ঞায় বাঙালিত্বকে নির্দিষ্ট করতে চাননি। বরং বুঝিয়েছেন, বাংলায় থাকা এবং নিজেকে বাঙালি মনে করাই বাঙালি হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অনুমান করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এটা একটা সুচিন্তিত রাজনৈতিক অবস্থান— কারণ, বৃত্তের পরিধি এতেই সবচেয়ে বড় হয়, সবচেয়ে বেশি মানুষকে একমাত্র এ পথেই বাঙালি সত্তার রাজনীতির পরিসরে আনা সম্ভব হয়।
সরকারের দেওয়া আর্থিক সুযোগসুবিধা ‘ভদ্রলোক’ বাঙালির প্রয়োজন নেই, তাঁদের জন্য বাজার রয়েছে। ফলে, জীবনধারণের জন্য বাঙালিত্বের এই সংজ্ঞাও তাঁদের প্রয়োজন নেই। প্রশ্ন হল, নবজাগরণের উত্তরাধিকার এবং একটি কল্পিত জাতিগত উচ্চ অবস্থানের গৌরব তাঁদের এতখানি প্রভাবিত করবে কি যে, তাঁরা এই বৃহৎ বাঙালিত্বের সংজ্ঞাকে সক্রিয় ভাবে অস্বীকার করবেন? সাংস্কৃতিক চিহ্নের গৌরবরহিত এই সংজ্ঞাকে মানার বদলে ক্রমশ সঙ্কীর্ণ করতে থাকবেন নিজস্বতার বৃত্ত?
হিন্দুত্ববাদী শক্তি কিন্তু ভদ্রলোক বাঙালির এই এলিট অবস্থানকে এখনও আক্রমণ করেনি। বাংলাদেশে উগ্রপন্থী ইসলাম যেমন সরাসরি আক্রমণ করেছে ‘ছায়ানট’-এর মতো প্রতিষ্ঠানকে, তার তুল্য কিছু এই বঙ্গে ঘটেনি— ঘটবে, তেমন আশঙ্কা অন্তত এখনও নেই। ২০২১-এ নরেন্দ্র মোদী রীতিমতো রবীন্দ্র কবিতা আওড়াচ্ছিলেন,এ বার ‘বঙ্কিমদা’-কে স্মরণ করেছেন। বাঙালি ভদ্রলোকের পরিচিতির মধ্যে হিন্দু উচ্চবর্ণের যে উপাদানগুলি রয়েছে, হিন্দুত্ববাদীদের স্বভাবতই তাতে সমস্যা নেই।
প্রশ্ন হল, ভদ্রলোক বাঙালিও কি হিন্দুরাষ্ট্রের মধ্যে তাদের গজদন্তমিনারের এই স্বীকৃতিতেই সন্তুষ্ট হবে, না কি বৃহত্তর সংজ্ঞায় বাঙালির উপরে যে নির্ভুল আক্রমণ চলছে, তাকে তার জাতিসত্তার বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসাবে দেখবে, তাকে প্রতিরোধ করতে চাইবে? ২০২৫ বাঙালিকে এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিল। ভদ্রলোক বাঙালিকে এ বার বলতেই হবে, সুনালী খাতুনকে তাঁরা যথেষ্ট বাঙালি বলতে সম্মত কি না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)