এসএসসি কাণ্ডে প্রচারমাধ্যমে তিনটি দিক প্রাধান্য পাচ্ছে: চাকরিহারাদের বেদনা, রাজনৈতিক তরজা ও বিচারবিভাগীয় সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক মোকাবিলা। এর পাশাপাশি প্রকৃত সমস্যাটিকে ছাপিয়ে উঠছে নানা ধরনের উত্তেজক অনুষঙ্গ। কিন্তু আরও কয়েকটি কথা এ প্রসঙ্গে বলা জরুরি বলে মনে হয়। উপসর্গকে আমরা অনেক সময়ই মূল অসুখ রূপে শনাক্ত করি। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের চাকরি খোয়ানোর প্রশ্নেও সেটাই প্রকট।
আজকের বাজারে চাকরি, বিশেষত সরকারি চাকরি চলে যাওয়া দুর্ভাগ্যের। কিন্তু একের পর এক যে সব ঘটনা আমাদের সামনে উঠে আসছে, তাতে বোঝা উচিত, সাময়িক উত্তেজনার আঁচে গা গরম করার বিষয় এটি নয়। উপসর্গকে ব্যাধি হিসেবে দেখলে অসুখ সারবে না, ভুগব আমরাই। আমরা মুখে বলি যে, শিক্ষকের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখন, ইস্কুলে ও টিউটোরিয়াল হোমে, কিংবা পরীক্ষকের ভূমিকায়— শিক্ষকের প্রধান ভূমিকা, পরীক্ষা পাশের কান্ডারির। কোনও কোনও শিক্ষক অবশ্যই ব্যতিক্রমী। তাঁরা শিক্ষার্থীর সম্ভাবনাগুলি শনাক্ত করতে পারেন, তার পরিচর্যা করে বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেন।
আজকের দুনিয়া যে দ্রুত পাল্টাচ্ছে, সেই আবহে শিক্ষা জিনিসটা কী, সেটা কে কাকে কী ভাবে দেয়, এ সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসছে। আমাদের কাজের ধরন ও প্রকৃতিতে পরিবর্তন ঘটে চলেছে, এ পথে চলার সামর্থ্য আমাদের প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা কতটুকু দিতে পারছে, এ প্রশ্ন প্রতি দিন জরুরি হয়ে উঠছে। একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে ‘যোগ্য’ ‘অযোগ্য’র মাপকাঠি খাড়া করে খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার যে চেষ্টা চলছে, তার সঙ্গে এ সব প্রসঙ্গের সম্বন্ধ কত গভীর, বিশেষত যখন চাকরিটাই লক্ষ্য, কাজটা উপলক্ষ। ঠিকই, যে পরিস্থিতিতে ‘ভদ্র’ গোছের জীবিকার সংস্থান করাই কঠিন, সেখানে উপার্জনের কোনও একটা উপায় হিসাবে শিক্ষকতা বেছে নেওয়ার প্রবণতা উপেক্ষা করা যায় না। আর এর সঙ্গে কোথাও বাঙালির প্রথামনস্ক সমাজমনেরও সংযুক্তি রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পাশ করে আর কিছু না হোক শিক্ষকতার পেশা বেছে নেওয়ার রীতি অনেক দিনের।
শিক্ষাগত যোগ্যতা তথা ডিগ্রি থাকলেই পড়ানোর যোগ্যতা থাকে, এ আমরা স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছি। এও ধরে নিয়েছি, ভাল পড়ানোর অর্থ পাঠ্যবস্তুকে সহজ করে বুঝিয়ে দেওয়া, সঙ্গে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিলেবাস শেষ করা, ভাল নোট দেওয়া এবং পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নতালিকার যথাযথ ‘পূর্বাভাস’ দিতে পারা। গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে সমীক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে দেখেছি। আজ সরকারি শিক্ষকেরা যে হারে বেতন পান, সকলের তাতে খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু আর সব বাদ দিয়ে বাস্তবে কাজের ঘণ্টা ও বাৎসরিক পাওনা ছুটির নিরিখে যদি দেখি, তাতে শিক্ষকদের অবদানের হিসাব কী ভাবে করা হবে?
এটা ধরে নেওয়া হয় যে, ক্লাসে পড়ানোর পরেও বাড়তি সময় ও দীর্ঘ অবকাশকে শিক্ষক তাঁর নিজের দক্ষতাবৃদ্ধির অনুশীলনে, ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনায় ব্যয় করবেন। ক’জন তা করেন? বাসে-মেট্রোয়-ট্রেনে-স্টাফরুমে শিক্ষকদের আলোচনা শুনলেই বোঝা যায়, লেখাপড়ার মতো তুচ্ছ গতানুগতিক বিষয়ের তুলনায় ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ, রাজনীতির কেচ্ছা, মহার্ঘ ভাতার আলোচনা, পরচর্চা ও সমাজমাধ্যমে চ্যাটের মতো মহৎ ব্যাপারেই তাঁরা ব্যস্ত থাকেন। এঁরা ক্লাসে পড়াতে যান, কিন্তু নিজেদের পড়াশোনা ভাবনাচিন্তার পরিধিকে বাড়ানোর জন্য কতটুকু উদ্যোগ করেন? প্রসঙ্গত, উন্নত কয়েকটি দেশে স্কুলশিক্ষকদের পড়াতে গেলে বিশেষ লাইসেন্স লাগে। যেমন, নিউ জ়িল্যান্ডে শিক্ষকের কাজের পূর্ণ খতিয়ানের ভিত্তিতে (অভিভাবক ও পড়ুয়াদেরও মতামত নেওয়া হয়) তিন বছর অন্তর তার নবীকরণ করাতে হয়। ভাবতে পারি আমরা?
সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা রোজ কত ক্ষণ স্কুলে থাকেন, ‘সরকারি কাজ’-এর অছিলায় কত বার তাঁদের নিয়মিত ক্লাস নেওয়ায় বাধা পড়ে, সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে কত জন ‘প্রাইভেট’ পড়ান, সে সব সমস্যারই বা কী হবে? তাই, ‘শিক্ষকতা যখন চাকরি’, বিষয়টি এ ভাবে না দেখে ‘চাকরি যখন শিক্ষকতা’, এ ভাবে দেখাই সমীচীন।
কয়েক বছর আগে উত্তরপ্রদেশের স্কুলশিক্ষা নিয়ে লেখায় প্রাক্তন আইএএস অনিল স্বরূপ সে রাজ্যে ‘এডুকেশন মাফিয়া’র উল্লেখ করে সাড়া ফেলেছিলেন। বাস্তব হল, ওটা কেবল উত্তরপ্রদেশেই আটকে নেই। ভারতের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার চালিকাশক্তি দু’টি: দলগত কায়েমি স্বার্থের সরাসরি হস্তক্ষেপ, আর স্বার্থের প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠা ‘রেন্ট সিকিং’ বা ‘ফড়ে’ অর্থনীতি। অর্থাৎ, রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতাশালী সক্রিয় দালালচক্র যেখানে তাদের প্রশ্রয়ধন্যদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়ে নিজেরাও মোটা উপার্জন করে।
সরকারি স্কুলশিক্ষকদের চাকরি বাতিলের মূল অভিযোগ ছিল নিয়োগ প্রক্রিয়ায় গভীর অনাচার। আদালতের পর্যবেক্ষণ, গোটা প্রক্রিয়ার রন্ধ্রে রন্ধ্রে এত দুর্নীতি যে যোগ্য-অযোগ্য বাছাই করাটাই দুঃসাধ্য! এখন মূল সমস্যা থেকে আমাদের নজর ঘুরে গিয়েছে। ‘মানবিক কারণ’ নামে একটি অত্যন্ত সুবিধাজনক ধূম্রজাল আমাদের চোখের সামনে টাঙানো হয়েছে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এ সবের পিছনে দেখছেন রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা তছনছ করে দেওয়ার বিরোধী চক্রান্ত। বিরোধীদের বক্তব্যেও গৎবাঁধা কথা ছাড়া কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না। দলমত নির্বিশেষে সঙ্কীর্ণ স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ও তাদের ধামাধরা গণমাধ্যম যে কোনও বিষয় নিয়েই ক্লান্তিহীন ধামাকা-উদ্গিরণে ব্যস্ত।
অথচ একের পর এক যে ধরনের ঘটনা সামনে উঠে আসছে তাতে সকলেরই বোঝা উচিত, সাময়িক উত্তেজনার আঁচে গা গরম করার বিষয় এগুলি নয়। যোগ্য শিক্ষকদের চাকরি পাওয়া অবশ্যই উচিত, কিন্তু তাঁরা কী ভাবে তাঁদের যোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব প্রমাণ করবেন, তারও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি থাকা উচিত। শিক্ষক ক্লাসে কী পড়ালেন, তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার্থী সেই ক্লাসে কী শিখল, এবং সেই শিক্ষার সচেতন প্রয়োগ কতটা করতে পারল।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)