E-Paper

না শিক্ষক, না শিক্ষা

লেখাপড়ার তবে কী হবে? যেমন শিক্ষাগত সব বিতণ্ডায়, তেমনই শিক্ষক নিয়োগের কুনাট্যেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর কথা কখনও শোনা যায় না, শোনা হয় না। তারা হল পড়ুয়ার দল।

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৫ ০৬:৪৭

পশ্চিমবঙ্গে আজ শিক্ষার সার্বিক সঙ্কট। একটা বিপত্তির আড়ালে আর একটা ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের লজ্জাকর তরজায় উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। মর্মান্তিক কৌতুক, আজ এ কথা পাড়লে লোকে বলবে, এ সব প্রশ্ন তুলে নজর ঘোরাচ্ছ কেন? কারণ স্কুলশিক্ষায় প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সর্বস্তরে ধারাবাহিক অনাচারে রাজ্য তোলপাড়। সেই বিপর্যয়েরও একটা দিক এই মুহূর্তে কারও গোচরে নেই। বিপুল সংখ্যক হবু-শিক্ষক বছরভর রোদে পুড়ে জলে ভিজে রাস্তা কামড়ে আছেন, কোনও দিনই চাকরি পাননি বলে। তাঁদের কথা আমরা ভুলতে বসেছি, কারণ আর এক দল শিক্ষক, গতকাল অবধি যাঁরা প্রথম দলের ঈর্ষার পাত্র ছিলেন, তাঁরাও আজ চাকরি খুইয়ে রাস্তায়। শিক্ষক হওয়ার বদখেয়ালে কি তরুণ প্রজন্মটাই পথে বসবে?

লেখাপড়ার তবে কী হবে? যেমন শিক্ষাগত সব বিতণ্ডায়, তেমনই শিক্ষক নিয়োগের কুনাট্যেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গোষ্ঠীর কথা কখনও শোনা যায় না, শোনা হয় না। তারা হল পড়ুয়ার দল। শিক্ষকের একান্ত অভাব ও পরিকাঠামোর দৈন্যের কথা আমরা শুনে শুনে ক্লান্ত; সুপ্রিম কোর্টের এই রায় যেন রাজ্যের শিক্ষার জর্জরিত কলেবরে মারণ কষাঘাত। যেটুকু লেখাপড়া শিক্ষককুল বহু কষ্টে বজায় রাখছিলেন— হয়তো পার্শ্বশিক্ষকদের মতো বঞ্চনার শিকার হয়ে, হয়তো অবসরের পরও ছাত্রদের মায়া কাটাতে না পেরে— এ বার হয়তো তাতে সত্যিই ধস নামল। কারণ, কেবল যে কর্মরত শিক্ষকদের সংখ্যা এক কোপে কয়েক হাজার কমল তা নয়, শিক্ষককুলের উৎসাহ-উদ্যম-সম্মান-মনোবল বিপন্ন হল। কর্মহারা শিক্ষকেরা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াতেন। তাঁদের ছাত্ররা নেহাত শিশু নয়, তারা দেখতে বুঝতে ভাবতে শিখেছে। শিক্ষা ব্যাপারটাই এ বার তারা কী চোখে দেখবে? বীতশ্রদ্ধ হতাশার চোখে? এমনিতেও হাজার সূত্রে আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেমেয়েরা সেই পাঠের তালিম পেয়ে চলেছে, তা এ বার চূড়ান্তে পৌঁছবে। রাজ্যভর কিশোর-কিশোরীর এই সিনিসিজ়মের অঙ্কুরোদ্‌গমের চেয়ে মর্মান্তিক কিছু হতে পারে না।

অথচ এই বিপর্যয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কী করে চলবে, তা নিয়ে কর্তৃপক্ষের মুখে একটা কাজের কথা শোনা গেল না। কর্মহারা বিধ্বস্ত শিক্ষকদের হুজুগের বা হুকুমের ঢঙে কাজে ফিরতে বলা কোনও সমাধান নয়; বিচ্ছিন্ন ভাবে যাই হোক, ব্যাপক ভাবে তাঁদের ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ। শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভে এই ভয়াবহ ঘাটতি তবে কী ভাবে পূরণ হবে?

পশ্চিমবঙ্গে যত শিশু-কিশোর সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার আওতায় আছে, অন্য কোনও রাজ্যে তা নেই। আমাদের একটা বিরল সুযোগ ছিল, ব্যবস্থাটা আরও উন্নত করে নজির তুলে ধরার। তার বদলে শিক্ষাকাঠামোর গাঁটগুলো ক্রমশ আলগা হয়ে পড়ছে। অতিমারির সময় ধাঁচাটা মস্ত নাড়া খেয়েছিল, উপশমের কোনও সংহত চেষ্টা হয়নি। এ বার শিক্ষক-নিয়োগ বিপর্যয়ে তাতে লাগল আরও প্রবল ধাক্কা। হাই কোর্টে প্রাথমিকের নিয়োগ মামলার শুনানি আসন্ন। তার পরিণতি জানা নেই কিন্তু আশঙ্কার সমূহ কারণ।

সরকার তথা শাসক দল কর্মহারা শিক্ষকদের বলছে তাদের উপর ভরসা রাখতে। বহু বছরের সাধনায় যারা অনাচারকে এই তুঙ্গে ঠেলে দিয়েছে, যাদের অপকীর্তির ফলেই শিক্ষকরা আজ বিপন্ন, তাদের উপর ভরসার কী কারণ থাকতে পারে তা বোধের অতীত। একমাত্র যুক্তি হতে পারে যে, এরা সরকারপক্ষ, বিহিতের ক্ষমতা এদেরই আছে, আর কারও নেই। করলেও তারা, না করলেও তারা।

ক্ষমতা থাক, সদিচ্ছা আছে কি? সুপ্রিম কোর্টের রায়দানের পর আজ অবধি খানিক স্ববিরোধী ও বিভ্রান্তিকর উক্তি ছাড়া কিছুই মিলল না। সীমাহীন বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে ‘যোগ্য’ আর ‘অযোগ্য’ শব্দ দু’টি নিয়ে। এর কোনও প্রতিশব্দ রায়ের বয়ানে নেই। আছে এক দিকে ‘টেন্টেড’ বা দাগি, অন্য দিকে ‘নির্দিষ্ট ভাবে দাগি বলা যাচ্ছে না’ এমন প্রার্থী— অতীব দুঃখের বিষয় যে, তাঁদের স্পষ্ট ভাবে নির্দোষ বলা হয়নি, কারণ আদালতের বিচারে পুরো প্রক্রিয়াটা এতই ভ্রষ্ট যে, দ্বিতীয় দলেও কিছু দাগি প্রার্থী মিশে থাকতে পারে।

রায়ের বয়ানটা ক’জন পড়েছেন জানি না। ওটি ইন্টারনেটে লভ্য, মাত্র ৪১ পাতা, আইনি খটমট এড়িয়ে বোধগম্য ইংরেজিতে লেখা। পড়লে হতবাক হতে হয়, দুর্নীতি কত ব্যাপক, বিচিত্র ও কায়েম হয়ে পড়েছিল বলে সর্বোচ্চ আদালতের অভিমত। ফলে কেবল আইনগত নয়, একটা বড়সড় নীতিগত প্রশ্ন উঠছে। যতই বিলম্বে ও অপূর্ণ ভাবে হোক, নিছক কৌশলগত অবস্থান থেকে বেরিয়ে কর্তৃপক্ষের একটা ন্যূনতম নীতিবোধ, শিক্ষার প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা কোনও না কোনও উপায়ে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে প্রকাশ করতেই হবে। এক দশকের নৈতিক ঘাটতি পূরণ অন্তত কিছু মাত্রায় হোক।

শিক্ষক-নিয়োগের পুরো বিষয়টা আইনের আবর্তে নিমজ্জিত। আইন-আদালতের দোহাই দিয়ে সরকার যা করছে বা করছে না তা নিয়ে বিতণ্ডা চলছে, বিভ্রান্তি বাড়ছে। সেই বিতর্কের সঙ্গে আপাত-অসম্পর্কিত দু’টি কাজ কিন্তু সরকার করতে পারে যার সুফল এমনিতেই কাম্য, উপরন্তু স্বচ্ছতা ও সদিচ্ছার নজির স্থাপন করে নিয়োগ সমস্যার উপরও খানিক ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

কোনও রকম তথ্য প্রকাশে সরকার মাত্রেই যে অনীহা, তাতে প্রথম প্রস্তাবটা দুরাশার মতো শোনাবে। জনসমক্ষে, হয়তো ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘোষণা করা হোক রাজ্যের প্রত্যেক স্কুলে কোন শ্রেণিতে কত শিক্ষক পদ; বাস্তবে কত জন বহাল আছেন; তাঁদের কত জন পুরো বেতনে পূর্ণ সময়ের, কত জন পার্শ্বশিক্ষক বা খুচরো ভাবে নিযুক্ত; এবং উঁচু ক্লাসে কে কোন বিষয় পড়ান। সেই সঙ্গে অবশ্যই আদালতের সাম্প্রতিক নির্দেশে শিক্ষকসংখ্যা কোথায় কতটা কমল।

শুনেই কর্তারা আঁতকে উঠবেন: আবদার না কি, এত তথ্য জোগাড় করা কি ছেলেখেলা? তথ্যগুলি কিন্তু সরকারের নাগালে এমনিতেই থাকা উচিত, নইলে মাসে-মাসে শিক্ষকদের মাইনে হত না, শূন্য পদের হিসেব কষে চাকরির বিজ্ঞপ্তি জারি করা যেত না। কম্পিউটার নামক যন্ত্রের দৌলতে বিপুল তথ্য ও সংখ্যা জড়ো করা যায়, এমনিতেই জড়ো থাকা উচিত। ফাঁকফোকর থাকলে তা পূরণ করা অপরিহার্য। বাঙালির সন্তানের শিক্ষা নিয়ে অনেক লুকোচুরি হয়েছে, সেই খেলার অবসান হোক।

সব শেষে— কারণ তারাই সবার আগে— সেই ছেলেমেয়েদের কথা, যাদের লেখাপড়া আবার একটা নতুন ঘা খেল। সেই ক্ষতি কী ভাবে পূরণ করা যায়, সেই মর্মে শিক্ষাকর্তাদের মৌন ভেঙে একটা স্পষ্ট হদিস না দিলেই নয়। বঞ্চিত শিক্ষকদের পাইকারি আহ্বানে স্কুলে ফিরতে বলে বিশেষ লাভ হবে এমন লক্ষণ নেই। একটা উপায় শিক্ষা দফতর ভেবে দেখতে পারে: স্থানীয় ও সাময়িক ভাবে, সম্পূর্ণ প্রধান শিক্ষকদের সিদ্ধান্তে, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দরকার মতো নিয়োগ করা। না, স্বেচ্ছাশ্রমের কথা বলছি না। সঙ্কট তরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্মানজনক দক্ষিণার ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। কেউ না চাইলে নেবেন না, বা স্কুলের হিতার্থে টাকাটা দান করবেন। কেন্দ্রীয় সরকার কম্পোজ়িট গ্রান্ট বন্ধ করায় রাজ্যভর স্কুল দেউলিয়া হওয়ার মুখে।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ডাকায় দুটো সুবিধা। তাঁদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতা প্রশ্নাতীত; এবং ভবিষ্যতে তাঁদের চাকরির দাবিদার হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে নিয়োগ যেন কোনও মতেই কেন্দ্রীয় ভাবে না হয়, নইলে আজকের পটভূমিকায় পুরো ব্যবস্থাটা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। স্থানীয় ভাবে কি স্বজনপোষণ বা দুর্নীতির অবকাশ নেই? অবশ্যই আছে, কিন্তু তুলনায় সামান্য, বিশেষত যদি শাসক দল তার শাখা সদস্যদের সংযত রাখতে পারে।

বাংলার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বাঁচুক। বাংলার শিক্ষক, হবু শিক্ষক, একদা শিক্ষকদের কী হবে? স্তোকবাক্য ফন্দিফিকির পরিহার করে, বুকে হাত রেখে এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউ দিতে পারব না। রাজ্যভর মানুষের সত্যিকারের শিক্ষার দাবিতে যে দিন আকাশ ভরবে, সে দিনই শাসক বাধ্য হবেন সাদা মনে সত্যিকারের কিছু কাজ করতে।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bengal Teacher Recruitment Case West Bengal SSC Scam

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy