বর্ষা মিটতে পাতলা হয় মেঘ। তাই আকাশ জুড়ে চলাচলে গতি বাড়ে তার। সে ভাসতে থাকে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। আলোর রং বদলায়। আমাদের একলা মন আর টিকতে পারে না। বিচ্ছিন্নতার পাঁচিল ভেঙে প্রকৃতি যেন তাকে টেনে আনে অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যের অনুষঙ্গে। মহালয়ার সকাল যেমন ভেঙে দেয় সব একপেশে আগল।
পাঁচ দশক আগে মফস্সলের স্কুলে সহপাঠী ছিল শ্রীকান্ত। মূর্তি গড়ত অনায়াস দক্ষতায়। গঙ্গার ধারে, স্কুলের কাছেই ওদের বাড়ি, লাগোয়া মূর্তি বানানোর কারখানা। মিড-ডে মিল নেই, টিফিনে শুকনো ডাব বা অপুষ্ট বাতাবিলেবুতে চলত পড়ুয়াদের ফুটবল-বিলাস। খেলায় শ্রীকান্তের তত আগ্রহ নেই। টিফিনের পর অধিকাংশ দিন ও আর ক্লাসই করত না। স্কুল ছুটি হলে সহপাঠীরা কেউ কেউ ওদের বাড়ির দিকে গেলে দেখত, সে একমনে মূর্তি গড়ছে, যেন চেনেই না আশপাশের কাউকে!
বড় হতে-হতে সে কেমন বদলে যেতে লাগল। বেপরোয়া ভাব, ঘোলাটে চোখ, নখের পাশে মাটির দাগ উধাও, মূর্তি গড়তে বসে না আর। দূরত্ব বেড়েছে বন্ধুদের সঙ্গেও। স্কুল-কলেজ বেয়ে বন্ধুরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, খবর এল, শ্রীকান্ত পাগল হয়ে গেছে। রাস্তার ধারে বসে দিনরাত বিড়ি টানত, ডাকলেও কথা বলত না। কাজ, কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত বন্ধুরাও কি ক্রমশ ভুলছিল ওকে? ওর মৃত্যুর খবরটাও এল অনেক পরে, বাসি হয়ে। এ-সবের অনেক আগে, মেঘে ঢাকা এক বিকেলে মূর্তি গড়ার ফাঁকে শ্রীকান্ত বলেছিল, “পুজোমণ্ডপে পুরুত প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন মূর্তির, তবু দেখ, আমরাও কি প্রাণ দিই না? খড়ের কাঠামোর গায়ে, একমাটি-দোমাটির ভিতর আমরা তো একটু একটু করে প্রাণই ভরে দিই। প্রাণের যোগ ছাড়া মাটি কখনও প্রতিমা হতে পারে?”
আজ ভাবি, সত্যিই তো। শিল্পীর হাতের মাটিতে প্রাণের স্পর্শ, অনুভবের সংবেদ তৈরি না হলে কী করে গড়ে উঠবে প্রতিমা? একটা গভীর যোগ থাকে বলেই তো মণ্ডপে প্রতিমা চলে যাওয়ার পর ফাঁকা পটুয়াপাড়ার বুকের ভিতর কষ্ট নামে!
হেড স্যর ছিলেন সত্যেনবাবু। যে কোনও বিষয় পড়াতে পারতেন, প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্নের আবহে ছাত্রমনে সাহস তৈরি করে দিতেন। অবসরের পর সাহিত্যই ছিল তাঁর সঙ্গী। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ে মগ্ন তিনি বলতেন, “জীবনের আগুনে শুদ্ধ না হলে কোনও লেখাই কালজয়ী হয় না। প্রকৃত লেখকেরা আপন প্রাণ ভেঙেই প্রাণসঞ্চার করেন লেখায়। পাঠক নিজের প্রাণ দিয়ে তার সঙ্গে যোগ তৈরি করেন। তখন এক হয়ে ওঠে বহু। এ এক অন্তঃশায়ী বহুত্ববাদ।”
পাড়া জুড়ে ব্রাহ্মণদের বাস, মহালয়ার পক্ষকাল আগে বাড়ি-বাড়ি তর্পণ শুরু হত। মহালয়ার সকালে শেষ। আসগরচাচা, শফিকুলভাই দূরদূরান্ত থেকে ফি-বছর ব্রাক্ষণ-বাড়ি এসে তর্পণের তিল দিয়ে যেতেন। তর্পণে অত তিল লাগত না, অবশিষ্ট তিলে গৃহিণীরা বানাতেন নাড়ু। পুজোর নৈবেদ্যে অন্যতম উপকরণ। আসগরচাচা হাতে ধরে প্রকৃতি চিনিয়েছিলেন। বলতেন, “নানা গাছের, নানা মাটির আলাদা-আলাদা গন্ধ, মন দিয়ে অনুভব করলে মালুম পাবে!”
বাবা তাঁর মাকে হারিয়েছিলেন শৈশবেই। উল্টো দিকের বাড়ির পড়শি ঠাকুমাই হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত পিতামহী। মা-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল ভালবাসার। হিমেল কার্তিকে মাকে বলতেন, “বৌমা, পূর্বপুরুষেরা এই সময় নেমে আসেন আমাদের কাছাকাছি। তাঁদের পথ দেখাতে হয় আলো জ্বেলে। আলো চিনে তাঁরা বুঝতে পারেন, আমরা তাঁদের সঙ্গে আছি, ভুলিনি। জীবনের এই যোগ ছিঁড়ে দিয়ো না।” তাঁর বিশ্বাসে মর্যাদায় নব্বই ছুঁয়েও মা ধরে আছেন সেই সংযোগ।
সালেমনদিদির দাওয়ায় বসলে মনটা ভরে যেত। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘সালেমনের মা’ কবিতার সেই সালেমন, অকারণ স্নেহ করতেন। অনর্গল বলে যেতেন তাঁর সুভাষকাকার গল্প। কাছেই আহম্মদদার বাড়ি, ‘পায়ে পায়ে’ কবিতায় যে আহম্মদের মায়ের কথা লিখেছেন কবি। সালেমনদিদি বলতেন, “ধর্ম, জাত এ সবের কোনও গুরুত্ব নেই ভাই, আত্মীয়তা হয় মানুষের সঙ্গে মানুষের।” সালেমনদিদি চলে গেছেন কবেই, বছর কয়েক আগে আহম্মদদাও— ওঁদের অকৃত্রিম উদারতার স্মৃৃতিটুকু রেখে।
মহালয়ার ভোরে গত কাল গঙ্গার ঘাটে যখন উচ্চারিত হল তর্পণের মন্ত্র, মনে পড়ল শ্রীকান্ত, হেড স্যর, আসগরচাচা, ঠাকুমা, সালেমনদিদির কথাগুলো। ওর মধ্যে তো তর্পণ-মন্ত্রেরই নির্যাস। মন্ত্র যখন বলে: ব্রহ্মলোক অবধি যাবতীয় লোক, দেবগণ, পিতৃগণ, সপ্তদ্বীপবাসী মানব ও ত্রিভুবনের যাবতীয় পদার্থ আমার দেওয়া জলে তৃপ্ত হোক, বা, যাঁরা বন্ধু ছিলেন এবং যাঁরা বন্ধু নন, যাঁরা জন্ম-জন্মান্তরে আমাদের বন্ধু ছিলেন, যাঁরা আমাদের থেকে জল প্রত্যাশা করেন, তাঁরা তৃপ্তি লাভ করুন, অথবা, ব্রহ্ম থেকে তৃণ পর্যন্ত সমস্ত লোকের তৃপ্তি হোক, তখন মনে পড়ে, বন্ধু-অবন্ধু-মানব-জীবজগৎ-ত্রিভুবনের যাবতীয় যোগের মধ্যেই আমাদের মূল সুরটি বাঁধা— ওই বহুত্ববাদে, বহুযোগে। সেই সংযোগের আয়োজন জেগে উঠুক শারদোৎসবে।
বাংলা বিভাগ, বিধাননগর কলেজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)