Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
‘জান কবুল আর মান কবুল’
BJP

বাংলায় ভোটের ফল সর্বভারতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ স্থির করবে

আগামী ২ মে ভোটের যে ফল আমরা জানতে পারব— তা শুধু বাংলা ও জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘোরাবে না, দেশের নাগরিক আন্দোলনেরও নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে।

প্রত্যয়ী? নন্দীগ্রামে বিজেপির প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থনে জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ৩০ মার্চ, ২০২১। পিটিআই।

প্রত্যয়ী? নন্দীগ্রামে বিজেপির প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীর সমর্থনে জনসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ৩০ মার্চ, ২০২১। পিটিআই।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২১ ০৪:৪৯
Share: Save:

আর তা হলে মাত্র এক মাস? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পরিবর্তন’-এর দশ বছর পরে এ বার বিজেপির ‘আসল পরিবর্তন’ আসবে? না কি, দু’শো আসন জেতার রণহুঙ্কার দিয়েও শেষ পর্যন্ত বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে হার মানবে?

এর উত্তর পেতে আর ঠিক এক মাসের অপেক্ষা। ২ মে নির্বাচনের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে ঠিকই। তার সঙ্গে এক মাস পরের এই নির্বাচনী ফলাফল জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যতের গতিপথও ঠিক করে দেবে। আর সে কারণেই বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের দিকে শুধু বাংলার নয়, গোটা দেশেরই নজর।

গত দু’মাসে কলকাতার কফি হাউস থেকে সংসদ ভবনে কফির আড্ডায় একটা প্রশ্ন বার বারই উঠে আসছে— বিজেপি হঠাৎ এমন পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কেন? নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ হঠাৎ কেন সব ছেড়ে বাংলায় ‘জান কবুল আর মান কবুল’ করে ফেললেন?

এই প্রশ্নের মধ্যেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলাফলের দিকে কেন জাতীয় রাজনীতি তাকিয়ে রয়েছে, তার উত্তর।

ধরা যাক, অমিত শাহের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে বিজেপি ২০০-র বেশি আসনে জিতে নবান্ন দখল করল। সে ক্ষেত্রে বিজেপি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে জয়ের রাস্তাও অনেকখানি মসৃণ করে ফেলবে। বিজেপি-বিরোধী একটা জোট তৈরি করা দরকার বলে যে ইতিউতি আলোচনা চলছে, শরদ পওয়ার থেকে তেজস্বী যাদব, হেমন্ত সোরেন থেকে ডিএমকে-র স্ট্যালিন যে কংগ্রেসের শরিক হয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তা আসলে এই বিরোধী জোটের সলতে পাকানোরই চেষ্টা। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি বাংলার মাটিতে ‘বাংলার মেয়ে’-কে হারাতে পারলে নতুন করে বিরোধী জোটের আশা ক্ষীণতর হবে।

কংগ্রেসের নিজের দুর্বলতার জন্য এখনও রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে কোনও শক্তপোক্ত বিরোধী জোটের আশা দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অসম, তামিলনাড়ু, কেরল ও পুদুচেরিতেও নির্বাচন। এর মধ্যে কংগ্রেস কেরলে ক্ষমতায় এলে, এবং অসমে বিজেপিকে হারাতে পারলে, হয়তো রাহুল গাঁধীর অনুগামীরা তাঁকে নিশ্চিন্তে ফের কংগ্রেস সভাপতির পদে বসিয়ে ফেলবেন। কিন্তু কংগ্রেস সভাপতি হলেই বিরোধী জোটের নেতৃত্ব রাহুলের হাতে চলে আসবে, এমন নয়। তাঁর নেতৃত্ব সব আঞ্চলিক দল মেনে নেবে, এমন গ্যারান্টি নেই। কারণ তামিলনাড়ুতে এডিএমকে-বিজেপি জোটকে হারাতে পারলে ডিএমকে-র জোটসঙ্গী হিসেবে কংগ্রেস তার সাফল্য দাবি করতে পারে, কিন্তু তাতে রাহুল গাঁধীর কৃতিত্ব কিছু নেই। কেরলে কংগ্রেস জিতলেও বলা হবে যে, সে রাজ্যে এমনিতেই পাঁচ বছর অন্তর সরকার বদল হয়। সর্বোপরি তামিলনাড়ু-কেরলে বিজেপির শক্তি নগণ্য। তাই সেখানে কংগ্রেস সফল হলেও বলা যাবে না যে, রাহুল মোদী-শাহের বিজেপিকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।

এখানেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বাড়তি মাত্রা বহন করে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির অশ্বমেধের ঘোড়া রুখে দিলে গোটা দেশে একটাই স্পষ্ট বার্তা যাবে— তা হল, তিনি নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে হারিয়েছেন। ফলে জাতীয় রাজনীতিতেও নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হিসেবে তিনিই উঠে আসবেন।

এই রাজনৈতিক সম্ভাবনা বস্তুত বিজেপিরই তৈরি করে দেওয়া। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে কাউকে মুখ্যমন্ত্রীর মুখ করেনি। আসলে বিজেপির এমন কোনও মুখ নেই, রাজনৈতিক ওজনের নিরিখে যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ধারেকাছেও আসেন। ফলে কাউকে মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী করা হলে তাঁর সঙ্গে মমতার তুল্যমূল্য বিচার হত। বিজেপি ভোটের লড়াইয়ে আগেই পিছিয়ে পড়ত। এমন নয় যে, বিজেপি কোনও রাজ্যেই কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে না। ঘোষণা হোক বা না হোক, মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিংহ চহ্বাণ, ছত্তীসগঢ়ে রমন সিংহ, রাজস্থানে বসুন্ধরা রাজেরাই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে তেমন কেউ নেই বলেই লড়াইটা হয়ে দাঁড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ বনাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রধানমন্ত্রী মোদী কেন্দ্রে তাঁর সরকারের কাজের খতিয়ানকে বাংলার ভোটে বাজি ধরেছেন। বাংলায় কার্যত মোদীই বিজেপির মুখ। অন্য দিকে অমিত শাহ কার্যত নিজেই পশ্চিমবঙ্গের ভোট পরিচালনার দায়িত্বে। এর পরেও বিজেপি হেরে গেলে প্রশ্ন উঠবে, জাতীয় রাজনীতিতে তেমন শক্ত প্রতিপক্ষ নেই বলেই কি মোদীর জয়ের রথ অব্যাহত?

বঙ্গ-ভোটে ‘বিজেপির চাণক্য’ অমিত শাহ বাজি ধরেছেন তাঁর রাজনৈতিক অঙ্ককে। যে অঙ্ক কষে তিনি আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, বিজেপি ২০০-র বেশি আসন জিতবে। ভোট শুরুর পরে দফায় দফায় ভোটের ফলের ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন। এর আগে দিল্লি বা রাজস্থানের ভোটে যে শাহি-ভবিষ্যদ্বাণী মিলেছে, এমন নয়। কিন্তু বাংলার ভোটে স্রেফ দলের ক্যাডারদের চাঙ্গা করতে শাহ দু’শো আসনের কথা বলে নিজের রাজনৈতিক বিচক্ষণতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছেন, তা-ও ভাবা কঠিন। শাহ ২০১৯-এর ভোটে যখন লোকসভায় ২০টি আসন জয়ের কথা বলেছিলেন, তখন অনেকেই বিশ্বাস করেননি। বিজেপি ১৮টি আসন পেয়েছিল। এ বার দু’শোর বদলে বিজেপি একশো-র কম আসন পেলে অমিত শাহ নিজেও কি জানেন না, তাঁর ‘চাণক্য’-র তকমা নিয়েই প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হবে?

আর সত্যিই ‘আসল পরিবর্তন’ হলে?

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি যদি এই প্রথম ক্ষমতায় আসে, তা হলে বিজেপির গেরুয়া বসন থেকে স্রেফ হিন্দি বলয়ের পার্টি-র তকমা অনেকটাই ঘুচে যাবে। অসম-সহ উত্তর-পূর্বের নানা রাজ্যে পা রাখলেও বিজেপি এখনও উৎকল-বঙ্গ, বা কর্নাটক বাদে বিন্ধ্যের ও-পারে ক্ষমতা দখল করতে পারেনি। নবান্ন দখল হলে সেই অভাব অনেকটাই পূরণ হবে। বাংলা জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভূমি ও কর্মভূমি। কেন্দ্রে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা কায়েমের পর বাংলায় সরকার গঠন হলে বিজেপির একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হবে। সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপির নেতাদের কাছে তাই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির পতাকা ওড়ানো বরাবরই অন্য আবেগ বহন করে।

বিজেপি বরাবরই মুসলিম-তোষণের বিরুদ্ধে। এক সময় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিজেপির প্রধান অভিযোগই ছিল মুসলিম-তোষণ। এখন মমতার বিরুদ্ধেও বিজেপির প্রধান হাতিয়ার সেটাই। সেই ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির জন্যই মমতা সিএএ-এনআরসি’র বিরোধিতা করছেন বলে অভিযোগ।

এই একই কারণে পশ্চিমবঙ্গের পরে পাঁচ রাজ্যের ভোটে জাতীয় রাজনীতিতে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য অসম। গত পাঁচ বছর বিজেপি সেখানে ক্ষমতায়। পশ্চিমবঙ্গের মতো অসমেও সিএএ-এনআরসি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্ন। অসমে সিএএ-এনআরসি এখন বিজেপির কাছে এমনই সমস্যা যে, তা কার্যকর করতে গেলেও বিপদ, না করলেও বিপদ। সে কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার নয়া নাগরিকত্ব আইন পাশের এক বছর পরেও তার নিয়মবিধি তৈরি করে আইন কার্যকর করেনি। এখন পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের ভোটে বিজেপি এক সঙ্গে হেরে গেলে গোটা দেশেই নয়া নাগরিকত্ব আইন প্রশ্নের মুখে পড়বে। একই ভাবে দুই রাজ্যেই বিজেপি জিতলে বিজেপি দাবি করতে পারবে যে, মানুষ নয়া নাগরিকত্ব আইনের পক্ষেই ভোট দিয়েছে। দিল্লি-কলকাতা-গুয়াহাটিতে সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে একেবারে ইতি টেনে দিতে চাইবে বিজেপি।

একই কথা প্রযোজ্য তিন কৃষি আইনের ক্ষেত্রেও। চার মাস ধরে দিল্লির সীমানায় কৃষক আন্দোলন চলছে। কৃষকরা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় থাকায় সরকারের সঙ্গে কৃষক সংগঠনগুলির আলোচনা ভেস্তে গিয়েছে। তার পরে সরকারও অনড় মনোভাব দেখিয়েছে। পাঁচ রাজ্যের মধ্যে অন্তত পশ্চিমবঙ্গ-অসমে সাফল্য পেলেই বিজেপি দাবি করবে, দেশের কৃষকরা মোদী সরকারের কৃষি সংস্কারে সিলমোহর দিয়েছেন। উল্টো দিকে কৃষক সংগঠনগুলিও গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। বাংলা-সহ ভোটমুখী রাজ্যে কৃষক নেতারা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করেছেন। বিজেপি জিতলে তাঁদের আশাভঙ্গ হবে। অন্য দিকে, কৃষকদের জমি রক্ষায় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনের বাংলায় বিজেপি হারলে কৃষক নেতারাও ফের তেড়েফুঁড়ে ওঠার রসদ পাবেন।

আগামী ২ মে ভোটের যে ফল আমরা জানতে পারব— তা শুধু বাংলা ও জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘোরাবে না, দেশের নাগরিক আন্দোলনেরও নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

BJP TMC West Bengal Assembly Election 2021
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE