আর জি কর মেডিক্যালে অভয়ার নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার এখনও বছর ঘোরেনি, এরই মধ্যে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ফের একটা গণধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসায় এ রাজ্যের অনেক মানুষই মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। দু’টি ঘটনার মধ্যে অদ্ভুত সাদৃশ্য। দু’টি ঘটনাই ঘটেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে, অভিযোগের আঙুল নির্যাতিতাদের সহাধ্যায়ী-সহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-কর্মীদের দিকে, এবং অভিযুক্তদের রাজনৈতিক পরিচয় অভিন্ন।
নির্যাতিতার বয়ান অনুযায়ী, তিনি দুপুরে পরীক্ষার ফর্ম ভরতে এসেছিলেন, হয়ে গেলে চারটে পর্যন্ত ইউনিয়ন রুমে ছিলেন। এর পর বাড়ি ফিরতে চাইলেও অভিযুক্ত প্রাক্তনীর নির্দেশে তাঁকে সন্ধে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত সেখানে বসিয়ে রাখা হয়। পরে সেখানেই শুরু হয় শ্লীলতাহানি। তার পর টেনেহিঁচড়ে গার্ড রুমে নিয়ে গিয়ে, কর্তব্যরত নিরাপত্তারক্ষীকে বার করে দিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়। পাহারায় ছিল এক সহপাঠী ও এক সিনিয়র, এদেরই কেউ হয়তো ঘটনার ভিডিয়ো তোলে। ধর্ষিতাকে ভিডিয়ো দেখিয়ে বলা হয়, এ যেন প্রকাশ্যে না আসে। ডে-কলেজে কী ভাবে নির্যাতিতা ও নির্যাতকেরা রাত পর্যন্ত কলেজের ভিতরে রয়ে গেল, ঘটনার সময় ভাইস প্রিন্সিপাল কলেজে থাকলেও এর বিন্দুবিসর্গ কেন টের পেলেন না, সে প্রশ্নও উপেক্ষার নয়।
এর পরেও শাসক দলের নেতানেত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রীরা বারো ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করার কৃতিত্ব জাহির করতে নির্দ্বিধ। ভাবখানা এমন, যেন অভিযুক্তরা দ্রুত গ্রেফতার হওয়া মানে ধর্ষণের বিষয়টি গৌণ হয়ে যাওয়া। মনে রাখতে হবে, নির্যাতিতা হকিস্টিকের আঘাত থেকে বাঁচতে মৃতের মতো পড়ে থেকে প্রাণে বেঁচেছেন, নিজে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করতে সক্ষম হয়েছেন। কে বলতে পারে, নির্যাতিতা মারা গেলে আর জি করের মতো রাতারাতি যাবতীয় সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করে পুরো বিষয়টা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হত না!
এটা স্পষ্ট যে, এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্ত ও তার সাহায্যকারীরা শুধু অকুতোভয়ই নয়, নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা সম্পর্কে অসীম আত্মপ্রত্যয়ী ছিল। রাজনৈতিক মত-নির্বিশেষে এই মুহূর্তে সব অভিভাবকের মনে হয়তো এক গভীর শঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছে: শিক্ষাঙ্গনের ভিতরেই যদি শিক্ষার্থীরা সুরক্ষিত না থাকেন, কোন ভরসায় তাঁরা সন্তানকে সেখানে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকবেন!
যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হল, দুষ্কৃতীরা এ রাজ্যে এত বেপরোয়া ও দুঃসাহসী হয়ে উঠল কী ভাবে? উত্তরের একাংশ নিশ্চয়ই লুম্পেনদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং শাসকের প্রশ্রয়সূচক ‘ছোট ঘটনা’ বা ‘এমন তো কতই হয়’ তত্ত্বের মধ্যে নিহিত। একটু পিছিয়ে গেলে দেখা যাবে, তদন্ত সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে পুলিশ অফিসারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছিল, তাঁকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের পদে বদলিও হতে হয়েছিল। হয়তো এ ঘটনা থেকেই আইন-প্রয়োগকারীরা বুঝেছিলেন, শাসকের সুরে সুর মিলিয়ে না চললে বিপদ।
কামদুনি, হাঁসখালি বা আর জি কর, প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসকের অবাঞ্ছিত মন্তব্য তদন্তের গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করেছে বলে অনেকের মত। বিরোধীদের অভিযোগ, ভয়েই হোক বা আনুগত্য প্রদর্শনের বাধ্যবাধকতায়, শাসকের আগাম ঘোষিত মত বা সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত প্রমাণে অনেক ক্ষেত্রেই তদন্তকারীরা ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’-এর পন্থা নিচ্ছেন। বগটুই গণহত্যায় কেমন করে কেস সাজাতে হবে, সে বিষয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে অনুব্রত মণ্ডলের দেওয়া ‘পরামর্শ’-এ তদন্তকারী অফিসারদের মৌন সম্মতি বিরোধীদের অভিযোগকেই প্রতিষ্ঠা দেয়। এ অবস্থায় শাসকের বরাভয়ে আস্থাবান দুষ্কৃতীদের পক্ষে শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ, খুনের মতো গুরুতর অপরাধে লাগামহীন হয়ে ওঠা অস্বাভাবিক নয়।
বিচারের দীর্ঘসূত্রতাও এক পরিপূরক প্রণোদনা। বিলম্বিত বিচার সর্বদা দোষীর প্রতি আনুকূল্য প্রলম্বিত করে। এ দেশের আইন অনুযায়ী বিচারের নামে কোনও অভিযুক্তকেই অনির্দিষ্টকাল বন্দি করে রাখার সংস্থান নেই। নিষ্পত্তিতে দেরি হলে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্তও এক সময় জামিন পেয়ে যায়। আইনি প্রক্রিয়া দীর্ঘ হলে, বিচারের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে জামিন অভিযুক্তের অধিকারের মধ্যেই পড়ে, মানবিকতার স্বার্থে তা জরুরিও।
তবে প্রভাবশালীর ক্ষেত্রে জামিন ও মুক্তি যেন সমার্থক। কোনও ভাবে জামিন পেলেই তাঁরা ঘরে ফেরেন, অনুরূপ দুষ্কর্মেরও পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। আদালতে এক-একটা তারিখ পড়ে, ভয়ে বা লোভে সাক্ষীর স্মৃতি ঝাপসা হয়, প্রমাণ লোপাট হয়, অনেক ক্ষেত্রে অভিযুক্তের জীবদ্দশায় মামলার নিষ্পত্তি অধরা থেকে যায়। সুতরাং অপরাধীরা বিশ্বাস করে, ন্যায়বিচার ‘বিলম্বিত’ হতে হতে এক সময় হয়তো ‘প্রত্যাখ্যাত’ হবে। তাই তারা ভয় পায় না। দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাদের ‘গডফাদার’দেরও বিচারের আওতায় আনা এবং বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত সম্পূর্ণ করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না গেলে এমন অপরাধ যে বেড়ে চলবে, তাতে সংশয় নেই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)