Advertisement
৩০ মার্চ ২০২৩
BJP

চলছে বিদ্বেষের নিবিড় চাষ

মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার যেখানে বারে বারে ক্ষুণ্ণ হয়, প্রশ্ন তুললে জোটে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা, সেখানে  কিসের গণতন্ত্র?

স্বর্ণাভ দেব
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২১ ০৪:৩১
Share: Save:

সদ্য কপ্টার দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে বাবার। দেশের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়তের সঙ্গে একই কপ্টারে ছিলেন তিনি। তখনও সম্পন্ন হয়নি শেষকৃত্য। ব্রিগেডিয়ার লখবিন্দর সিংহ লিড্ডারের ১৬ বছরের কিশোরী কন্যা আশনাকে আক্রমণ করার জন্য এমন সময়টাকেই বেছে নিল গেরুয়া বাহিনী। পদস্থ সেনা অফিসারের কন্যাকে দেওয়া হল ধর্ষণের হুমকিও!

Advertisement

অপরাধ? মাস দুয়েক আগে টুইটারে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে সমালোচনা করেছিলেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের। লখিমপুর খেরিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অজয় মিশ্রের ছেলের বিরুদ্ধে কৃষক হত্যার অভিযোগ ওঠার পরে কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা সেখানে যেতে গেলে সীতাপুরের অতিথি নিবাসে আটক করা হয় তাঁকে। সেখানে প্রিয়ঙ্কার ঘর ঝাঁট দেওয়া নিয়ে যোগীর কটাক্ষের বিরুদ্ধে টুইট করেছিলেন আশনা। যোগীকে নখদন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করে লিখেছিলেন, “উত্তরপ্রদেশকে আগে টালমাটাল অবস্থা থেকে উদ্ধার করুন।” এর পর থেকেই বিজেপির আইটি সেলের নিশানা হয়ে যান তিনি। সেনা অফিসার বাবার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার আগেই পর পর আক্রমণে বিপর্যস্ত নাবালিকা শেষ পর্যন্ত নিজের টুইটার অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে দেন। এ নিয়ে টুইটারে অনেকেই আশনাকে সমর্থন জানিয়ে নানা পোস্ট করলেও সমাজমাধ্যমটিতে সদ্যপ্রয়াত সেনা অফিসারের মেয়ে এখনও নিষ্ক্রিয়।

এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজমাধ্যমে এ যেন এক পরম্পরা হয়ে উঠেছে। যখনই সরকারের স্বার্থ, উদ্দেশ্য নিয়ে কেউ সরব হয়েছে, সমালোচনা করেছে, সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠেছে অলক্ষ্য এক গেরুয়া বাহিনী। এই ঘটনা কেবল দেখিয়ে দিল, এমন আক্রমণ থেকে রেহাই মেলে না গেরুয়া বাহিনীর কাছে সবচেয়ে বড় জাতীয়তাবাদের প্রতীক যে সেনাবাহিনী— তার শীর্ষব্যক্তির পরিবারেরও।

একাধিক বার এমন দেখলাম আমরা, গত কয়েক বছরে। কার্গিল যুদ্ধে মনদীপ সিংহ যখন মারা যান, তখন তাঁর শিশুকন্যাটির বয়স মাত্র দুই। সেই কন্যা গুরমেহর কৌর কয়েক বছর আগে, ২০১৬ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিয়ো আপলোড করে শান্তির পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে জানান, তাঁর বাবার হত্যাকারী পাকিস্তান নয়। তাঁর বাবাকে কেড়ে নিয়েছে যুদ্ধই। গুরমেহর প্রশ্ন তোলেন, দু’টি বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্রান্স-জার্মানি যদি সন্ধি করতে পারে, অতীত ভুলে জাপান-আমেরিকা যদি এগোতে পারে, তা হলে ভারত-পাকিস্তান কেন নয়? তিনি চান অবিলম্বে দু’দেশের লড়াই বন্ধ হোক, যাতে ভবিষ্যতে আর কোনও মেয়েকে যুদ্ধের কারণে তার বাবাকে হারাতে না হয়। সে বারও শুধুমাত্র এমন মন্তব্যের জন্যই গেরুয়া বাহিনীর বিষনজরে পড়ে যান গুরমেহর। এর পরই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রামজস কলেজে আরএসএস-এর ছাত্র সংগঠন এবিভিপি-র হামলার প্রতিবাদ করেছিলেন গুরমেহর। তার পর আর রাখঢাক না করে তাঁর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে গেরুয়া শিবির। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে প্রাণনাশ তো বটেই, ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়। বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদেরও তোপে পড়েন গুরমেহর। চাপের মুখে দিল্লি ছেড়ে যেতে বাধ্য হন তিনি।

Advertisement

অবসরপ্রাপ্ত নৌসেনা অফিসার সি উদয় ভাস্করের কন্যা স্বরা আরও বেশি আক্রমণের শিকার। বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে সরব হওয়া স্বরাকে নিত্য দিন ভয় দেখানো হয়, ধর্ষণ ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়।। শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যাওয়া সেই হুমকি-পোস্টে ‘লাইক’ও করেছিলেন বিজেপির সাংসদ লাল্লু সিংহ! তবে স্বরা দমেননি। আক্রমণও অব্যাহত থাকে।

বলা বাহুল্য, এই গৈরিক দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ— সবই চলতে থাকে নেটমাধ্যমে। তাই তাদের নেতা বা নীতি আক্রান্ত হলেও বীরবিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা। এমনই এক ঘটনায় কয়েক বছর আগে জঙ্গি হামলায় নিহত এক সেনার স্ত্রী বলেছিলেন, “আজ আমার ঘর খালি হয়েছে। কাল অন্য কারও হবে। আমার অনুরোধ, ফেসবুক যোদ্ধারা এই লড়াই এ বার থামান। এত উন্মাদনা থাকলে সীমান্তে যান, যুদ্ধে লড়ুন। আমরা যুদ্ধ চাই না। এর পরিণাম যে কী, আপনারা বুঝবেন না।”

বাহিনীর কথা বাদই দিই, সাধারণ মানুষও বোঝেন কি? পুলওয়ামা হামলার পরে বালাকোটে সার্জিক্যাল স্ট্রাইককে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে প্রচারের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে, সেনার আবেগ উস্কে জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ভোটে জেতা তাই সহজ হয়। প্রসঙ্গত, দেশের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এমন ঘটনায় নীরব থাকেন। এক জন ক্রিকেটারের আঙুলে চোট নিয়ে যিনি টুইট করতে পারেন, সদ্য পিতৃহারা সেনাকন্যার পাশে তিনি দাঁড়াতে পারেন না। তাঁর দলেরও কেউ দাঁড়ান না পাশে।

চার পাশে ঘৃণার এই নিবিড় চাষকে নিশ্চুপ থেকে মদত দেওয়ার মাধ্যমে কি আদতে রাজধর্মই টাল খাচ্ছে না? ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না ভাবমূর্তি? না কি গোটা বিষয়টিতে প্রচ্ছন্ন মদতের মাধ্যমে বার্তা এমনটাই যে, শাসক দল বা সরকারের সমালোচনা মোটেই মেনে নেওয়া হবে না। তা হলে কি শুধু রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সেনাকে? বিপুল জনাদেশ নিয়ে দেশ শাসনের ভার পেয়েছেন যাঁরা, তাঁদের গদি কি এতই ঠুনকো যে, বিরুদ্ধ মতের ঝাপ্টায় চৌচির হয়ে পড়বে?

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করি আমরা। কিন্তু মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার যেখানে বারে বারে ক্ষুণ্ণ হয়, প্রশ্ন তুললে জোটে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা, সেখানে কিসের গণতন্ত্র? গণতন্ত্রে সমালোচনা বা বিরুদ্ধ মতপ্রকাশের পরিসর উন্মুক্ত রাখা জরুরি। কোনও ভাবে সেই পথ রুদ্ধ হলে তার দায় বর্তায় শাসকের উপরেই, যা রাজধর্ম পালনের পরিপন্থী। ১৯ বছর আগে ভয়াবহ দাঙ্গার পরে দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রিত্বের সিঁড়ি বেয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়া মানুষটিকে আজ সেই মন্ত্র স্মরণ করাবেন কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.